Ajker Patrika

শিক্ষক সমাজের নিগ্রহ

এম আর খায়রুল উমাম
আপডেট : ২৩ আগস্ট ২০২২, ১০: ৩৩
শিক্ষক সমাজের নিগ্রহ

বেশ কিছুদিন আগে বিভিন্ন শ্রেণি-পেশার ব্যক্তিদের আড্ডা চলছে। সেদিন এসএসসি পরীক্ষার ফল বের হয়েছে। আড্ডায় একজন বলেন, এবার পাঁচটা স্কুল থেকে কোনো শিক্ষার্থী পাস করতে পারেনি। এ কথা শোনামাত্র একজন ব্যবসায়ী বলে ওঠেন, ‘এখন আর শিক্ষকেরা স্কুলে পড়াতে চান না। সারা দিন প্রাইভেট পড়াতেই ব্যস্ত থাকেন।

আমাকে যদি দায়িত্ব দেয় তাহলে আমি এক দিনেই সব ঠিক করে দিতে পারি।’ কীভাবে সমস্যার সমাধান করবেন, জানতে চাইলে তিনি বলেন, শিক্ষকদের গাছের সঙ্গে বেঁধে বিছুটি মারলেই সব সোজা হয়ে যাবে। বোধকরি দেশের এহেন বিত্তবানেরা নিজেদের আয়নায় দেখেন না। তাই তাঁরা নিজেদের সততা, মূল্যবোধকে পেছনে রেখে অন্য সবকিছুর, অন্য সব সমস্যার সমাধান দিয়ে থাকেন। পরিবেশ পরিস্থিতি বিবেচনা করার কোনো প্রয়োজন আছে বলেও বোধকরি কেউ মনে করে না। যদিও আমাদের শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান, শিক্ষাব্যবস্থা, শিক্ষকদের অবস্থা, রাজনীতি, অভিভাবকদের চাহিদা, সামাজিক পরিবেশ ইত্যাদি বিষয় ভাবনার মধ্যে না থাকলে সারা দেশে কেন শিক্ষক নিগ্রহ চলমান, তা বোঝা সম্ভব নয়। কিন্তু বিত্তবানেরা যেমন এসব বিষয় ভাবতে চায় না, ঠিক তেমনি সংশ্লিষ্টরা এবং সর্বোপরি সমাজও এসব বিষয় ভাবতে চায় বলে মনে হয় না। ফলে ঘটনাগুলো আর শিক্ষক নিগ্রহের মধ্যে সীমাবদ্ধ না থেকে হত্যা পর্যন্ত চলে গেছে।

দেশের সাধারণ জনগণ খুব ভালো করে জানে সন্তানদের শিক্ষাদানের কাজে নিবেদিত শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের বর্তমান অবস্থা। গ্রামের এক একটি প্রাথমিক বিদ্যালয়ে শিক্ষক-সংকট তো আছেই, তার সঙ্গে অনেক বিদ্যালয়ে প্রধান শিক্ষকও নেই। প্রাক-প্রাথমিক শিক্ষা তো চলে একটা টিন দিয়ে ঘেরা স্থানে, অস্বাস্থ্যকর পরিবেশে এবং একটা ক্লাসরুমে। সেই ক্লাসরুমে আবার নলকূপ বসানো আছে, যা শিক্ষক-শিক্ষার্থীরা শিক্ষা কার্যক্রম চলাকালেও ব্যবহার করে। যদিও সাধারণ বিবেচনায় প্রাক-প্রাথমিক শিক্ষা কার্যক্রম সবচেয়ে আকর্ষণীয় হওয়ার কথা, কিন্তু এখানে তার লেশমাত্র নেই। গ্রামের মানুষ তাদের সন্তানদের জন্য নিজেদের উদ্যোগে যে শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান গড়ে তুলেছিল, সরকার ভোটের রাজনীতি করতে গিয়ে এসব শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানকেই রাতারাতি সরকারি হিসেবে ঘোষণা করে দিয়েছে। এ ক্ষেত্রে সরকারের সামর্থ্য নিয়ে কথা বলতে চাই না, তবে মানসিকতার অভাব বলে মনে করি। জোড়াতালির এ শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে একসময় সভাপতির দায়িত্ব পালন করতেন এলাকার একজন কলেজশিক্ষক। ভদ্রলোক এলাকার মানুষকে নিয়ে আন্তরিকতার সঙ্গে চেষ্টা করছিলেন সমস্যা থেকে শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানকে বের করে আনতে। কিন্তু হঠাৎ করে একদিন দেখা গেল তাঁকে সরিয়ে সরকারি দলের ছাত্রসংগঠনের এক নেতা সভাপতির দায়িত্ব নিয়ে শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে হাজির। বিষয়টি নতুন প্রজন্মের দায়িত্ব গ্রহণ বিবেচনায় সাধুবাদযোগ্য হলেও মনে রাখা প্রয়োজন, আমাদের ছাত্রসংগঠনগুলো শিক্ষা নিয়ে কোনো কার্যক্রম বর্তমানে পরিচালনা করে থাকে বলে কোনো নমুনা সাধারণ মানুষ দেখেও না, জানেও না। তাহলে সিদ্ধান্তে পৌঁছানোই যায়, শুধু রাজনৈতিকীকরণের লক্ষ্যেই এমন পরিবর্তন। এহেন শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে জনপ্রতিনিধির আগমন ঘটলে সভাপতির নির্দেশক্রমে মেয়ে শিক্ষার্থীদের দাঁড় করিয়ে দেওয়া হয় অতিথিকে অভ্যর্থনা জানানোর জন্য। যেকোনো জাতীয় ও রাজনৈতিক অনুষ্ঠানে জনসরবরাহের দায়িত্বও পালন করতে হয় এসব বিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীদের।

দেশের মেধাবী সন্তানেরা কেউই আজ শিক্ষকতা পেশায় আসতে চান না। দুই-একজন শুধু বিশ্ববিদ্যালয়ে শিক্ষকতা করার স্বপ্ন দেখে থাকেন। কিন্তু দিনে দিনে শিক্ষক নিয়োগ প্রক্রিয়াও বাণিজ্যে রূপ নিয়েছে। ফলে দেখা যায়, একে তো মেধাবী সন্তানেরা শিক্ষকতায় আগ্রহী নয়, তার ওপর আবার পৈতৃক সম্পদ বিক্রি করে শিক্ষকের পদ সংগ্রহ করতে হয়। মেধার ন্যূনতম মূল্যায়ন কোনোখানে নেই। এ ধারা এখন আর প্রাথমিক পর্যায়ে সীমাবদ্ধ না থেকে বিশ্ববিদ্যালয় পর্যন্ত পৌঁছে গেছে। অন্যদের কথা না হয় নাই-বা বললাম, দেশের প্রতিটি শিক্ষক পরিবার জানে স্পিড মানি না হলে এ শিক্ষাব্যবস্থার একটা গাঁটও পার হওয়া সম্ভব নয়। দেশ ও সমাজ যদি এমন নীতি-আদর্শ মেনে চলে, তাহলে শিক্ষকদের কাছে অন্য কিছু চাওয়া অন্যায় হচ্ছে কি না, ভেবে দেখা দরকার। সমাজ-স্বীকৃত প্রক্রিয়ায় নিয়োগপ্রাপ্ত একজন শিক্ষক কেন শ্রেণিকক্ষে নিজেকে নিবেদিত রাখবেন, তা অনুসন্ধানের দায়িত্ব সমাজকেই নিতে হবে। চলমান সমাজে শুধু নীতিকথা বলে শিক্ষককে অনুপ্রাণিত করা যাবে না। তার জন্য পরিবেশ সৃষ্টি করতে হবে। শিক্ষকদের সমস্যার সমাধান করতে হবে। শিক্ষকদের অন্য গ্রহের মানুষ ভাবার কোনো কারণ নেই। গাছের সঙ্গে বেঁধে বিছুটি মারলে সব সমস্যার সমাধান হয়ে যাবে না। মারার এ দলে আরও অনেকে আছে, যাদের প্রথমে বিছুটি মারা প্রয়োজন। তবেই হয়তো সমাজ পথ পাবে।

এম আর খায়রুল উমামবর্তমানে সারা দেশে যে একের পর এক শিক্ষক নিগ্রহের ঘটনা ঘটে চলেছে, তার দায় সমাজ অস্বীকার করতে পারবে না। প্রতিটি ক্ষেত্রেই হয়তো সমাজের কিছু মানুষ প্রতিবাদ করে, তবে সেই প্রতিবাদের মধ্যে প্রাণ থাকে কি না, জানি না। সর্বত্রই কিছু পরিচিত মুখ পাশাপাশি মানববন্ধনের নামে দাঁড়িয়ে থাকে। তারা নিজেদের মধ্যে ঐক্য দেখাতেও ব্যর্থ হয় সমাজের কাছে। ফলে ঐক্যের অভাবে প্রতিবাদ খুব একটা সুফল বয়ে আনতে পারে না কোনো ক্ষেত্রেই। আর যারা ঘটনাগুলো ঘটায়, তারা এই অনৈক্যের সুযোগ নিয়ে নিজেদের শক্তিমান হিসেবে প্রতিষ্ঠিত করে সমাজে নিজ নিজ অবস্থান তৈরি করে। রাজনীতি সর্বক্ষেত্রেই এসব ছোট-বড় শক্তিমানদের ব্যবহার করে নিজেদের প্রতিপত্তি সৃষ্টি করে থাকে। যে কারণে রাজনীতির প্রয়োজন পর্যন্ত এরা সাধারণভাবে আইনের ঊর্ধ্বে থাকে। যত দিন সুযোগ পায়, তত দিন একটার পর একটা ঘটনা ঘটিয়ে নিজেদের গুরুত্ব তৈরি করেই চলে। প্রতিনিয়ত সারা দেশে এরা কতশত নিগ্রহ করে চলে, তার সব খবর প্রকাশই হয় না। আর কিছু খবর প্রকাশ পেলেও তাদের কিছুই হয় না। তাই একের পর এক শিক্ষক নিগ্রহের ঘটনা ঘটেই চলেছে। কিন্তু সে কারণে এই শক্তিমানদের কেউ বিছুটি মারার কথা চিন্তাও করে না।

শিক্ষকদের সামাজিক সম্মান আজ শূন্যের কোঠায়। সর্বত্র সবাই শিক্ষকদের সমালোচনায় মুখর। সবাই সহজ সমাধানে বিশ্বাসী, ‘কেষ্টা বেটাই চোর’। শিক্ষকেরা দায়মুক্ত—এমন দাবি অবশ্য করা যাবে না। শিক্ষকেরা শ্রেণিকক্ষকে গুরুত্বহীন করে ফেলতে নিজেরাই সহায়ক ভূমিকা রাখায় শিক্ষার্থী ও অভিভাবকেরা ধীরে ধীরে সবাই তাঁদের প্রতি বিরূপ হয়ে পড়েছেন।

ফলে শিক্ষকদের সামাজিক সম্মান ক্ষুণ্ন হয়েছে। এককালের যেকোনো অনুষ্ঠানের মধ্যমণি থাকতেন যে শিক্ষকেরা, সে চিত্র আজ আর কোনোখানে খুঁজে পাওয়া যায় না। শিক্ষকেরা অন্য পেশাজীবীদের মতো রাজনৈতিক মতাদর্শে বিভক্ত হয়ে পড়ার কারণে শিক্ষক সমাজের ঐক্য বিনষ্ট হয়েছে। সম্মিলিতভাবে প্রতিবাদ করার সামর্থ্য হারিয়েছেন তাঁরা। ফলে নিগ্রহ দিনে দিনে বাড়লে অবাক হওয়ার কিছু থাকবে না। বর্তমান পরিবেশ-পরিস্থিতির মধ্যে দাঁড়িয়ে শিক্ষক সমাজ বিষয়টি ভেবে দেখতে পারেন।

শিক্ষক সমাজ আজ দেশের দ্বিতীয় শ্রেণির নাগরিক। সাধারণ জনগণ দেখে শিক্ষকদের পৃথক বেতন স্কেল দেওয়ার ঘোষণা হয় গাধার সামনে মুলা ঝোলানোর মতো। তাঁদের জন্য পদোন্নতি, বোনাস, মেডিকেল, বাসাভাড়া হিসাবে যা দেওয়া হয়ে থাকে, তা দ্বিতীয় শ্রেণির নয়, দশম শ্রেণির নাগরিকের সমতুল্য। তারপরও শিক্ষক সমাজ দেশ ও জাতির কল্যাণ বিবেচনায় শিক্ষার্থীদের শ্রেণিকক্ষে পাঠদান নিশ্চিত করতে উদ্যোগী হতে পারেন। সব বাধা অতিক্রম করে অন্তত আগামী ১০ বছর সৎ ও সত্যের পথে আন্তরিক প্রচেষ্টায় নিবেদিত হলে শিক্ষার্থী ও অভিভাবকেরাই শিক্ষক সমাজের ঢাল হিসেবে দাঁড়িয়ে যাবেন। মুক্তির জন্য সাধারণ জনগণের এ বিশ্বাসের প্রতি সম্মান জানিয়ে শিক্ষক সমাজ একবার অন্তত চেষ্টা করে দেখতে পারেন।

লেখক: প্রাবন্ধিক, সাবেক সভাপতি, ইনস্টিটিউশন অব ডিপ্লোমা ইঞ্জিনিয়ার্স, বাংলাদেশ 

Google News Icon

সর্বশেষ খবর পেতে Google News ফিড ফলো করুন

এলাকার খবর
খুঁজুন

পাঠকের আগ্রহ

সম্পর্কিত