Ajker Patrika

ডলারের বেলাগাম মূল্যবৃদ্ধি: কারসাজিই দায়ী

ড. মইনুল ইসলাম, অবসরপ্রাপ্ত প্রফেসর, অর্থনীতি বিভাগ, চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়
ডলারের বেলাগাম মূল্যবৃদ্ধি: কারসাজিই দায়ী

ফাটকাবাজারি ব্যাংকার, সাবেক ব্যাংকার ও ব্যবসায়ীদেরও গ্রেপ্তার করা অপরিহার্য হয়ে পড়েছে মনে করি। কার্ব মার্কেট থেকে কারা দেদার ডলার কিনছে, তার ওপর গোয়েন্দা নজরদারিও বাড়াতে হবে। কারণ, এই পদ্ধতিতেও দেশ থেকে পুঁজিপাচার করা হচ্ছে বলে খবর পাওয়া যাচ্ছে।

বাংলাদেশে ডলারের দাম ২০২২ সালের জুলাই ও আগস্ট মাসে লাফিয়ে লাফিয়ে বেড়ে চলেছিল। গত ১৬ আগস্ট কার্ব মার্কেটে ডলারের দাম পাগলা ঘোড়ার মতো লাফিয়ে লাফিয়ে ১২০ টাকায় উঠে গিয়েছিল, কিন্তু তারপর কয়েকটি ব্যাংক এবং মানি এক্সচেঞ্জ প্রতিষ্ঠানের বিরুদ্ধে বাংলাদেশ ব্যাংক ও সরকারের কঠোর অভিযানের কারণে ২২ আগস্ট তা আবার ১০৮ টাকায় নেমে এসেছিল। ৪ সেপ্টেম্বর ডলারের দাম আবার ১১৭ টাকায় উঠে গেছে। ইতিমধ্যেই ব্র্যাক ব্যাংক, সিটি ব্যাংক, প্রাইম ব্যাংক, সাউথইস্ট ব্যাংক, ডাচ্-বাংলা ব্যাংক ও স্ট্যান্ডার্ড চার্টার্ড ব্যাংকের ট্রেজারি বিভাগের দায়িত্বপ্রাপ্ত অফিসারের বিরুদ্ধে বিভাগীয় ব্যবস্থা নেওয়ার জন্য বাংলাদেশ ব্যাংক নির্দেশ জারি করেছে। (অবশ্য, এসব ব্যাংকের সর্বোচ্চ কর্তৃপক্ষের অগোচরে ট্রেজারি বিভাগ কিছুই করতে পারে না বলে ওয়াকিবহাল মহলের দৃঢ় অভিমত। সুতরাং কয়েকটি ব্যাংকের সর্বোচ্চ পদের কর্মকর্তাকেও শাস্তির আওতায় নিয়ে আসা জরুরি)।

পরে আরও সাতটি ব্যাংকের কাছে ব্যাখ্যা চাওয়া হয়েছে। কয়েকটি মানি এক্সচেঞ্জ প্রতিষ্ঠানও সিলগালা করে দেওয়া হয়েছে। উল্লিখিত ব্যাংকগুলো এই কয় মাসে ডলার বাজারে কৃত্রিম জোগান সংকট সৃষ্টি করে ৪০০ শতাংশ পর্যন্ত অবৈধ মুনাফা তুলে নিয়েছে বলে ওয়াকিবহাল মহলের অভিমত। ২০২২ সালের মার্চ মাসেও কার্ব মার্কেটে ডলার কিনতে হলে ডলারপ্রতি লাগত ৯০-৯১ টাকা। এর পরের সাড়ে চার মাসে কার্ব মার্কেটে ডলারের দাম পাগলা ঘোড়ার মতো লাফিয়ে লাফিয়ে বেড়ে ১২০ টাকায় পৌঁছে যাওয়ায় বাংলাদেশের অর্থনীতি সম্পর্কে দেশ-বিদেশে নানা রকম গুজব ডানা মেলতে শুরু করে।

এসব গুজবের মূল সুর হলো, বাংলাদেশের অর্থনীতিও শ্রীলঙ্কার মতো ধসে পড়ার পথে এগিয়ে যাচ্ছে এবং আগামী এক-দুই বছরের মধ্যে বাংলাদেশের বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ দ্রুত হ্রাস পেয়ে বিপজ্জনক অবস্থানে চলে যাবে। ডলার বাজারে অবস্থার এত দ্রুত অবনতির পেছনে কয়েকটি মহলের পরিকল্পিত কারসাজি এবং মুনাফাবাজি ক্রিয়াশীল বলে ওয়াকিবহাল মহল আগাগোড়াই সন্দেহ প্রকাশ করে যাচ্ছে। কয়েকটি বাণিজ্যিক ব্যাংকের ঊর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষ সরাসরি কার্ব মার্কেটের ফাটকাবাজি ব্যবসার মাধ্যমে এই কয়েক মাসে কয়েক হাজার কোটি টাকা মুনাফা তুলে নিয়েছে। আর বাংলাদেশে বর্তমানে ২৩৫টি মানি এক্সচেঞ্জ প্রতিষ্ঠানকে সরকার লাইসেন্স দিলেও প্রকৃতপক্ষে প্রায় ছয় শ প্রতিষ্ঠান কার্ব মার্কেটে অবৈধভাবে ডলার কেনাবেচায় অপারেট করছে। এই মানি এক্সচেঞ্জগুলোর অধিকাংশই দাঁও মারার এই স্বর্ণ সুযোগের অপব্যবহার করে বৈদেশিক মুদ্রাবাজারে কৃত্রিম জোগান-সংকট সৃষ্টি করে, ডলারের দামকে ম্যানিপুলেট করে কয়েক হাজার কোটি টাকা বাগিয়ে নিয়েছে। তাদের এই অবৈধ মুনাফাবাজি দেশের অর্থনীতির বারোটা বাজিয়ে দিচ্ছে জেনেও এই ব্যাংক ও মানি এক্সচেঞ্জগুলো নির্বিকারভাবে ফাটকাবাজি ব্যবসা চালিয়ে গেছে। (কিছু মানি এক্সচেঞ্জার হুন্ডির দেশীয় এজেন্ট হিসেবে ভূমিকা পালন করছে বলে অভিযোগ রয়েছে। এ ব্যাপারে গোয়েন্দা তৎপরতা বাড়ানো অপরিহার্য হয়ে পড়েছে)।

অবশ্য, বাংলাদেশ ব্যাংক এবং সরকার বিলম্বে হলেও পরিস্থিতির অবনতির ধারা উপলব্ধি করে এই পরিকল্পিত কারসাজি ধরতে পারায় অনেকগুলো আমদানি নিয়ন্ত্রণ ও হুন্ডিবিরোধী পদক্ষেপ নেওয়ার মাধ্যমে আন্তর্জাতিক বাণিজ্যে বেলাগাম আমদানির লাগাম টেনে ধরেছে এবং কার্ব মার্কেটে এই বাণিজ্যিক ব্যাংক ও মানি এক্সচেঞ্জ প্রতিষ্ঠানগুলোর মুনাফাবাজির বিরুদ্ধে শাস্তিমূলক ব্যবস্থা নিতে শুরু করেছে। ফল একদিকে গত দুই মাসে এলসি খোলার হার উল্লেখযোগ্যভাবে হ্রাস পেয়েছে। অন্যদিকে ফরমাল চ্যানেলে রেমিট্যান্স জুলাই ও আগস্ট মাসে অনেকখানি বেড়েছে। এই কঠোর পদক্ষেপগুলো অব্যাহত রাখা গেলে দুই-তিন মাসের মধ্যে অর্থনীতি ঘুরে দাঁড়াবে বলে আমার দৃঢ় বিশ্বাস। কিন্তু গত বছরের এলসির ব্যয় পরিশোধ আগস্ট মাসে উল্লেখযোগ্যভাবে বেড়ে যাওয়ায় বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভের পতন সেপ্টেম্বরেও অব্যাহত রয়েছে। ফলে ৫ সেপ্টেম্বর রিজার্ভ ৩৮ বিলিয়ন ডলারে নেমে এসেছে। ৭ সেপ্টেম্বর এশিয়ান ক্লিয়ারিং ইউনিয়নের (আকু) পাওনা পরিশোধের পর রিজার্ভ ৩৬ বিলিয়ন ডলারে নেমে যাবে বলে আশঙ্কা দেখা দিয়েছে।

চলমান ডলার-সংকট এত দ্রুত বাড়ার পেছনে প্রধান কারণ হলো, দেশের আর্থিক খাতের শৃঙ্খলা বিধানে বাংলাদেশ ব্যাংকের ক্রমবর্ধমান দুর্বলতা, অদক্ষতা ও অযোগ্যতা। দেশের ৬৫টি ব্যাংক, প্রায় সমসংখ্যক নন-ব্যাংক ফাইন্যান্সিয়াল ইনস্টিটিউশন এবং ২৩৫টি মানি এক্সচেঞ্জ প্রতিষ্ঠানের ওপর কড়া নজরদারি বজায় রাখা দিন দিন বাংলাদেশ ব্যাংকের জন্য দুঃসাধ্য হয়ে পড়ছে। ফলে এই বিপুলসংখ্যক প্রতিষ্ঠানের ওপর বাংলাদেশ ব্যাংকের সার্বক্ষণিক মনিটরিংয়ের ব্যবস্থা প্রায় বিপর্যস্ত হয়ে গেছে বলে মত প্রকাশ করেছেন বাংলাদেশ ব্যাংকের সাবেক গভর্নর ড. সালেহউদ্দিন আহমেদ। (একই সঙ্গে বাংলাদেশ ব্যাংকের ওপর অর্থমন্ত্রীর সার্বক্ষণিক খবরদারিও এই দুর্বলতা বাড়িয়ে দিচ্ছে)! ডলার বাজারে বিভিন্ন ব্যাংক ও মানি এক্সচেঞ্জ প্রতিষ্ঠানের পাশাপাশি দেশের বেশ কয়েকজন প্রভাবশালী ব্যবসায়ী ও বিভিন্ন ব্যাংকের ঊর্ধ্বতন পদে অধিষ্ঠিত এবং/অথবা অতীতে কর্মরত বিশিষ্ট ব্যাংকার বর্তমান ফাটকাবাজিতে সরাসরি জড়িত হয়ে পড়েছেন বলে অভিযোগ ওঠার পরও বাংলাদেশ ব্যাংক এসব চিহ্নিত ফাটকাবাজারির বিরুদ্ধে এখনো কোনো ব্যবস্থা নিতে পারেনি। এটা কি ইচ্ছাকৃত গাফিলতি, নাকি ক্ষমতার দুর্বলতা—তা সহজে বোঝা যাবে না। কিন্তু এই ফাটকাবাজারি যে পুরো অর্থনীতিকে একটা গভীর গিরিখাদের কিনারায় নিয়ে গেছে, তা কি সরকার এখনো সঠিকভাবে উপলব্ধি করতে পারছে না?

দেশের আমদানি এলসি খোলার হার জুলাই ও আগস্ট মাসে গত বছরের ওই দুই মাসের তুলনায় কিছুটা কমেছে, যেটা আশাব্যঞ্জক। আমদানি নিয়ন্ত্রণের পদক্ষেপগুলো আরও বিস্তৃত ও কঠোর করা গেলে এবং একই সঙ্গে ওভার ইনভয়েসিং হচ্ছে কি না, তার মনিটরিং শক্তিশালী করা গেলে ২০২২-২৩ অর্থবছরের মোট আমদানি ব্যয়কে ৮৫ বিলিয়ন ডলারে হয়তো সীমিত করা যাবে। ফরমাল চ্যানেলের রেমিট্যান্স প্রবাহও এই অর্থবছরে ২৪ বিলিয়ন ডলার অতিক্রম করবে বলে আশা করা যায়। এর মানে রপ্তানি আয়কে যদি এ বছর ৬০ বিলিয়ন ডলারে উন্নীত করা যায়, তাহলে অর্থবছরের শেষের দিকে অর্থনীতির টালমাটাল অবস্থা অনেকখানি কমে যাবে। কিন্তু ডলারের বাজারের ফাটকাবাজারির বিরুদ্ধে যদি সরকার এবং বাংলাদেশ ব্যাংক আরও কঠোর না হয় তাহলে কার্ব মার্কেটের ডলারের দাম ১৩০ টাকায় উঠে গেলেও আমি অবাক হব না। কয়েক শ মানি এক্সচেঞ্জের লাইসেন্স বাতিল করা এবং ওই প্রতিষ্ঠানগুলোর মালিকদের গ্রেপ্তার করে ফৌজদারি মামলার আসামি করা এখন সময়ের দাবি হয়ে পড়েছে।

ফাটকাবাজারি ব্যাংকার, সাবেক ব্যাংকার ও ব্যবসায়ীদেরও গ্রেপ্তার করা অপরিহার্য হয়ে পড়েছে মনে করি।

কার্ব মার্কেট থেকে কারা দেদার ডলার কিনছে, তার ওপর গোয়েন্দা নজরদারিও বাড়াতে হবে। কারণ, এই পদ্ধতিতেও দেশ থেকে পুঁজি পাচার করা হচ্ছে বলে খবর পাওয়া যাচ্ছে।

আরেকটি ব্যাপারেও নতুন চিন্তাভাবনার প্রয়োজন রয়েছে। এখন রপ্তানিকারকদের তাঁদের রপ্তানি আয়ের একটা অংশ বিদেশে রেখে দেওয়ার অনুমতি দেওয়া হয়। একই সঙ্গে রপ্তানি আয় দেশে নিয়ে আসার জন্য অনেক দিন সময় দেওয়া হয়। এই দুটো সুবিধার ব্যাপক অপব্যবহারের মাধ্যমে দেশ থেকে বিদেশে দেদার পুঁজি পাচার করা হচ্ছে। এই সুবিধাগুলোর মনিটরিংয়ের ব্যবস্থাও খুবই দুর্বল। এ ক্ষেত্রে ব্যাপক দুর্নীতি হচ্ছে বলে অভিযোগ রয়েছে। এমনকি যাঁরা দীর্ঘদিন ধরে এই সুবিধার অপব্যবহার করে পুঁজি পাচারের মাধ্যমে বিদেশে ঘরবাড়ি-ব্যবসাপাতি কিনেছেন বলে প্রমাণিত, তাঁদের কাউকেই এ পর্যন্ত শাস্তির আওতায় আনার প্রক্রিয়া শুরু করেনি বাংলাদেশ ব্যাংক।

এটা শুধুই বাংলাদেশ ব্যাংকের অদক্ষতা কিংবা দুর্বলতার কারণে হচ্ছে বললে ভুল হবে; স্বয়ং অর্থমন্ত্রী রহস্যজনক অনীহার মাধ্যমে এ ব্যাপারে আশকারা দিচ্ছেন কি না, সে প্রশ্নও উঠছে। এ ক্ষেত্রে ব্যাপক দুর্নীতি হচ্ছে বলেও অভিযোগ রয়েছে। আমার প্রস্তাব হলো, রপ্তানি আয় নিজের কাছে রেখে দেওয়ার পরিমাণকে (অনুপাতকে) আগামী কিছুদিনের জন্য কঠোরভাবে সীমিত করা হোক। একই সঙ্গে কত দিনের মধ্যে রপ্তানি আয় বাংলাদেশ ব্যাংকে বাধ্যতামূলকভাবে জমা দিতেই হবে, সেই সময়সীমাকেও কঠোরভাবে নামিয়ে আনা হোক। টরন্টোর বেগমপাড়ায় খোঁজখবর নিয়ে জানা যাচ্ছে যে ওখানকার অধিকাংশ বাড়িঘর দুর্নীতিবাজ আমলা-প্রকৌশলীদের চেয়েও বেশি পোশাক রপ্তানিকারকেরাই কিনেছেন।

অতএব, রপ্তানির আন্ডার ইনভয়েসিং এবং রপ্তানি আয় দেশে ফেরত না আনার সমস্যাটা সাধারণ ধারণার চেয়ে অনেক বেশি ব্যাপক ও বহুল প্রচলিত। সে জন্যই বলছি, এই দুটো ব্যাপারে সরকারের কঠোর হওয়া এখন সময়ের দাবি হয়ে পড়েছে। ব্যাংকের ঋণ নিয়ে হুন্ডি প্রক্রিয়ায় ওই অর্থ বিদেশে পাচার করার ব্যাপারেও একশ্রেণির রপ্তানিকারক কামেলিয়ত হাসিল করেছে। মনে রাখতে হবে, রপ্তানিকারক সবাই দেশপ্রেমিক না-ও হতে পারেন!

Google News Icon

সর্বশেষ খবর পেতে Google News ফিড ফলো করুন

এলাকার খবর
খুঁজুন

পাঠকের আগ্রহ

সম্পর্কিত