Ajker Patrika

সুখের লাগিয়া এ ঘর বাঁধিনু

মামুনুর রশীদ
আপডেট : ২৭ অক্টোবর ২০২২, ১১: ২০
সুখের লাগিয়া এ ঘর বাঁধিনু

আমাদের সংস্কৃতিতে এসব অপকর্মের বিরুদ্ধে অনেক বাণী আছে। ধর্মেও অনেক নিষেধাজ্ঞা আছে। কিন্তু ধর্ম যখন রাজনীতিতে আশ্রয় নেয়, তখন লাখ টাকার বিনিময়ে ওয়াজ মাহফিলের হুজুর এসব কথা বলেন না, তাঁর আলোচনার বিষয়বস্তু শুধু পরকাল।

কয়েক দিনের ঘোর দুর্যোগের পর মেঘমুক্ত আকাশ দেখা গেল। প্রকৃতির নিয়মই তাই। কোনো অনিয়ম হলে, প্রাকৃতিক কোনো বিপর্যয় ঘটলে, সে বিনাশের পথ খুঁজে নেয়।

তারপর প্রবল ক্রোধে সব ভাঙচুর করে, ধ্বংসলীলা চালিয়ে আবার শান্ত হয়। সে এক প্রশান্তির শান্তি। মেঘমুক্ত আকাশ, তার সঙ্গে মৃদু ঠান্ডা হাওয়া। বৃষ্টিতে ভিজে শুকিয়ে যাওয়া সবুজ পাতাগুলো চিকচিক করছে। আর অন্যদিকে এই ধ্বংসলীলার ফলে স্বজন হারানো মানুষের আহাজারি। বাড়িঘর, জমির ফসল, খাদ্যের জোগান—সবকিছু হারিয়ে মানুষের নতুন করে বাঁচার এক সংগ্রাম।

মেঘমুক্ত আকাশের নিচে মানুষ আবার আবাস গড়ার চেষ্টা করে। কেউ প্রকৃতিকে অভিশাপ দেয়, কেউ আবার ভাগ্যের কাছে নিজেকে সমর্পণ করে। যদিও প্রকৃতির খেলা বলে আমরা কেউ কেউ মেনে নিই, কিন্তু আসলে তা মানুষেরই খেলা। মানুষই তৈরি করেছে এ বিপর্যয়। শত শত বছর ধরে প্রকৃতিকে নানান ধরনের নির্যাতন করে জলবায়ুকেই আমরা পাল্টে দিয়েছি। সবচেয়ে বেশি ক্ষতিগ্রস্ত করেছে যান্ত্রিক সভ্যতা এবং মানুষের আগ্রাসী লোভ। প্রথম বিশ্বযুদ্ধ, দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ, প্রতিনিয়ত যুদ্ধের প্রস্তুতি এবং টনে টনে বারুদ ভূপৃষ্ঠে, আকাশে, সমুদ্রে—সর্বত্র বিস্ফোরিত হচ্ছে। মহাশূন্যে চলছে এক অবিরাম যুদ্ধের পাঁয়তারা। তার সঙ্গে আছে মানুষের সীমাহীন বর্জ্যের উৎপাদন। এসব আমাদের প্রতিদিনের চোখে দেখা। নদীর পানি কালো হয়ে যাচ্ছে, সমুদ্র কলুষিত হচ্ছে, বায়ুমণ্ডলে তার প্রভাব পড়ছে, নতুন নতুন ব্যাধির জন্ম হচ্ছে। উন্নত বিশ্বের ব্যাপক উৎপাদন, বল্গাহীন লোভ প্রকৃতি থেকে আহরিত কাঁচামাল ধ্বংস করছে স্বাভাবিক স্থিতাবস্থা।

মানুষের সবচেয়ে স্থূল আকাঙ্ক্ষাগুলো যে আত্মঘাতী হয়ে পড়ছে, তাতে কোনো বিবেক-বুদ্ধির আশ্রয় মিলছে না। আমাদের বাল্যকালেই যে ঘন সবুজ বন ও পাহাড় দেখেছি, তাকেও গত ৫০-৬০ বছরে কেটেকুটে কোথাও কোথাও একেবারে শূন্য করে দেওয়া হয়েছে। অতি নিরীহ জলজ প্রাণী ডলফিন বাঁচার আশায় একসময় সুন্দরবনে এসে আশ্রয় নিল। সেই ডলফিন সুন্দরবনের আশ্রয় হারিয়ে ধাবিত হচ্ছে অন্যত্র। সুন্দরবনে তার যে আশ্রয় মিলেছিল সবুজে, নির্মল পানিতে, তা রাসায়নিক পদার্থের বর্জ্যে কলুষিত হয়ে গেছে। এই বন ধ্বংস করার কত ষড়যন্ত্র মানুষ প্রতিদিনই বের করছে, প্রাণিকুল মৃত্যুবরণ করছে আর বর্জ্যে কলুষিত পানিতে যে জলজ প্রাণীর বসবাস, তারাও অনিরাপদ ভেবে পালিয়ে যাওয়ার চেষ্টা করছে।

বাংলাদেশের শহরগুলোও দিগন্তহীন হয়ে পড়ছে। সুউচ্চ সারি সারি অট্টালিকা আকাশকে ঢেকে দিচ্ছে। ঢাকা শহরে এত জনপদ গড়ে উঠেছে, যার মধ্যে এতটুকু সবুজ নেই।

কবির ভাষায়, ‘ইটের পরে ইট, মাঝে মানুষ কীট’। এসব অট্টালিকার পেছনে কি শুধু মানুষের আবাস-চিন্তা? নাকি কতিপয় মানুষের সীমাহীন লোভ ও পুঁজি গড়ার উচ্চাভিলাষ? সেই উচ্চাভিলাষ ২০-৩০ বছরে সফলও হয়েছে। এই সাফল্য এনে দিয়েছে যানজট এবং নিম্নবিত্ত মানুষের জন্য আবাসহীন বস্তিজীবন।

সবচেয়ে বেশি ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে দেশের সংস্কৃতি। কোথাও কোনো জায়গা থেকে বাঁশির সুর ভেসে আসে না, দুই কলি গান ভেসে আসে না, শুধু কর্কশ শব্দ চারদিকে।

শব্দদূষণে ১ নম্বর দেশ হিসেবে চিহ্নিত হয়ে যাচ্ছে আমাদের মাতৃভূমি। গণমাধ্যমগুলোয় সব সময় প্রবাহিত হচ্ছে পণ্যের বিজ্ঞাপন। আর এই বিজ্ঞাপনই মানুষের লোভ-লালসাকে উচ্চমাত্রায় নিয়ে যাচ্ছে। পণ্য চাই, যেকোনোভাবে পণ্য চাই। প্রয়োজনের তুলনায় অনেক বেশি পণ্য চাই। এসব পণ্য উৎপাদনের জন্য দিগন্ত হারিয়ে যায়, সবুজ মিলিয়ে যায়, গ্রাম ধ্বংস হয়ে যায়, গড়ে ওঠে কলকারখানা। কী নিদারুণ ব্যবস্থা!

মানুষের সবচেয়ে নিত্যপ্রয়োজনীয় জিনিস হচ্ছে খাদ্য। সেই খাদ্য উৎপাদনে, বিপণনে মানব হত্যার এক বিষক্রিয়া আর এই বিষক্রিয়ার বিপরীতে অসুস্থ মানুষের নিরাময়ের জন্য যে ওষুধ প্রয়োজন, তাতেও অসাধু উপায় খুঁজে বের করছে মানুষ। বিনিময়ে চাই মুনাফা। এই মুনাফা বিশাল পুঁজির জন্ম দিচ্ছে। দেশে এই পুঁজিকে ভোগ করার ব্যবস্থা নেই। তাই পুঁজি বিদেশে পাচার করার জন্য প্রতিদিনের চেষ্টা এবং নিত্যনতুন কৌশল আবিষ্কার করা হচ্ছে।

পাশের দেশ মিয়ানমারে মানুষকে বাস্তুচ্যুত করার জন্য এক অবিরাম চেষ্টা সেই দেশের সেনাবাহিনীর। আর সেই দেশের দেশপ্রেমিকদের নিরন্তর প্রচেষ্টা সেনাবাহিনীকে উৎখাতের। কোনো আলাপ-আলোচনা নয়, শান্তি-প্রক্রিয়া নয়, শুধু তীব্র প্রতিযোগিতা অস্ত্রের। মানুষ সেখানে অসহায়। তাদের দিন-রাত কাটে শঙ্কায়, মৃত্যুর পাহাড় গড়ে ওঠে প্রতিদিন। আমাদের দেশটা সব সময় শান্তিপ্রিয়। মানুষ নিরীহ, নদী, পানি এবং পললমিশ্রিত উর্বর ভূমিতে ফসলের সমারোহে খুবই সুখী ছিল। কিন্তু সেখানেও এসেছে অস্ত্রের খেলা, দখলদারি। এই দখলদারি যুগ যুগ ধরে মানুষ শাসকের পদতলে পিষ্ট হয়েছে। মোগল আমলে বাংলার এই অঞ্চল থেকে আওরঙ্গজেব খাজনা নিয়ে সেই অর্থ দিয়ে একের পর এক যুদ্ধ করে মোগল সাম্রাজ্যের অবসান ঘটিয়েছেন। ব্রিটিশ এসে লুণ্ঠনের নানা প্রক্রিয়ায় দরিদ্র থেকে আরও দরিদ্রতর করে গেছে। সীমাহীন লুণ্ঠনে ছিয়াত্তরের মন্বন্তর এবং তেতাল্লিশের দুর্ভিক্ষ ঘটিয়ে নজিরবিহীন শোষণের এক উদাহরণ সৃষ্টি করে গেছে। সেই থেকে এই বাংলার মানুষ দরিদ্রই রয়ে গেছে।

ব্রিটিশ চলে গেলেও রেখে গেছে এক অন্তঃকলহ এবং নিজ দেশে শোষণের এক উদাহরণ। পাকিস্তান শোষণ করেছে। পরবর্তীকালে বহু রক্তের বিনিময়ে বাংলাদেশ স্বাধীন হওয়ার পর শোষণের নানান উপায় বের করেছে এ দেশেরই মানুষ। এই উপায়ের মধ্যে সবচেয়ে বড় উপায় হচ্ছে লুণ্ঠন। যে পরিমাণে জনগণের অর্থ লুণ্ঠিত হয়েছে এবং বিদেশে পাচার করা হয়েছে, তা দিয়ে বাংলাদেশের নদীকে নাব্য করে, নদীর পাশে বাঁধ দিয়ে চাষাবাদের সুপরিকল্পিত উৎপাদনের ব্যবস্থা করে সুজলা-সুফলা শস্য শ্যামল বাংলাদেশ গড়ে তোলা যেত। অন্যদিকে, বাংলাদেশ হয়ে দাঁড়িয়েছে এক প্রাকৃতিক দুর্যোগের লীলাভূমি। মোগল শাসক ইসলাম খাঁকে ধন্যবাদ জানাতে হয় যে তিনি বাংলার রাজধানী করেছিলেন ঢাকায়। উপকূলবর্তী কোনো শহরে রাজধানী হলে মানুষ বুঝতে পারত এই প্রলয়লীলা কত ভয়ংকর! কিন্তু এই ভয়ংকর দুর্যোগ থেকে ঢাকার অবস্থান খুবই গুরুতর। এমনিতেই মানুষের এক স্বভাব আছে, সে নিজে আক্রান্ত না হওয়া পর্যন্ত বোঝে না যে আক্রমণটা কতটা ভয়াবহ। সব সময় ভাবে, আঘাতটা তো আমার গায়ে পড়েনি।

এই যে একটা নিরাপদ তন্দ্রার মধ্যে জীবন কাটানো আর এটা ভাবা যে আমি তো ভালো আছি, আমার সন্তানেরা ভালো আছে—এই স্থূল ও স্বার্থপর চিন্তা বর্তমানে আমাদের সংস্কৃতির একটা মুখ্য বিষয় হয়ে দাঁড়িয়েছে। দলে দলে ধনবান ব্যবসায়ী, দুর্নীতিবাজ আমলা-রাজনীতিকদের সন্তানেরা বিদেশে চলে যাচ্ছে অর্থের বিনিময়ে ডিগ্রি কেনার জন্য এবং সেই সন্তানেরা আর কোনো দিন দেশে ফিরবে না। কাজেই এরা দেশটাকে সুখী-সমৃদ্ধ করতে চায় না। স্বাস্থ্যব্যবস্থা ভেঙে যাক, দুর্নীতির কারণে দেশ ধ্বংস হয়ে যাক, তাতে তাদের কিছুই যায়-আসে না। কারণ সে এবং তার পরিবার তো মহাসুখে আছে। এরা অপেক্ষা করে মহামারি, দুর্যোগ এবং যেকোনো অনিশ্চয়তার ওপর। ফলে এ দেশেই গড়ে উঠেছে কোটি কোটি সুখী পরিবার। কিন্তু এরা ভাবতে পারছে না যে বহুকাল আগে জ্ঞানদাস বলে গেছেন, ‘সুখের লাগিয়া এ ঘর বাঁধিনু, অনলে পুড়িয়া গেল’।

আমাদের সংস্কৃতিতে এসব অপকর্মের বিরুদ্ধে অনেক বাণী আছে। ধর্মেও অনেক নিষেধাজ্ঞা আছে। কিন্তু ধর্ম যখন রাজনীতিতে আশ্রয় নেয়, তখন লাখ টাকার বিনিময়ে ওয়াজ মাহফিলের হুজুর এসব কথা বলেন না, তাঁর আলোচনার বিষয়বস্তু শুধু পরকাল। ইহকালের অন্যায় তাঁর বিষয় নয়। প্রাকৃতিক বিপর্যয় বারবার মানুষকে পারিপার্শ্বিক অন্যায়, লোভ, লুণ্ঠনের কথা মনে করিয়ে দেয়। কিন্তু সেসব এই সুখী পরিবারের বুদ্ধিতে প্রবেশ করে না। ব্যস্ত থাকে প্রকৃতিকে ধ্বংস করার উন্মাদনায়। কিন্তু এসব আয়োজন অবিনাশী নয়। প্রকৃতির বিনাশ একদিন সুখী পরিবারকেও স্পর্শ করবে। সেই আগামবার্তা আমরা কি শুনতে পাই?

লেখক: মামুনুর রশীদ, নাট্যব্যক্তিত্ব 

Google News Icon

সর্বশেষ খবর পেতে Google News ফিড ফলো করুন

এলাকার খবর
খুঁজুন

পাঠকের আগ্রহ

সম্পর্কিত