জাহীদ রেজা নূর
৭ নভেম্বরের আবেদন এখন ফিকে হয়ে এসেছে। যাঁরা একে ‘জাতীয় বিপ্লব ও সংহতি দিবস’ বলতেন কিংবা বলতেন ‘সিপাহি-জনতার বিপ্লব’, তাঁদের পরবর্তী কার্যাবলিতে বোঝা গেছে, আসলে কে যে কী চাইছিলেন, সে বিষয়টি কারও কাছেই স্পষ্ট ছিল না। নানাভাবে এ সময়টিকে ব্যাখ্যা করা হয়ে থাকে। তবে এ কথা ঠিক, ৭ নভেম্বরে সব দিক থেকে সবচেয়ে লাভবান হয়েছিলেন জিয়াউর রহমান। ধীরে ধীরে তিনি ক্ষমতা কুক্ষিগত করেছেন। ১৯৭৫ সালের ৭ নভেম্বর ‘সিপাহি-জনতা ভাই ভাই, অফিসারের রক্ত চাই’ স্লোগানে যখন সেনানিবাস ও রাজপথ মুখরিত হয়ে উঠছিল, তখন সেনাবাহিনীতে সহিংসতা ছড়িয়ে পড়ছিল। অফিসাররা আতঙ্কিত হয়েছেন, সিপাহিরা উন্মাদের মতো অফিসারদের খুঁজে বেড়াচ্ছিলেন খুন করার জন্য।
তবে এ কথা নিশ্চিত করে বলা যায়, ৭ নভেম্বরের পর ইতিহাসের বাঁকবদল হয়েছে। ১৫ আগস্টের ট্র্যাজিক ঘটনাবলি বিমূঢ় করে রেখেছিল দেশকে। কেউই বুঝতে পারছিল না, কী হতে কী হয়ে গেল। প্রতিরোধ আন্দোলন যে গড়ে উঠল না, তার বেশির ভাগ দায় আওয়ামী লীগেরই। তাদেরই দলের সদস্যরা মোশতাকের মন্ত্রিসভায় যোগ দেওয়ায় বোঝা যাচ্ছিল না, এই পটপরিবর্তনের ঘটনাটি দলগতভাবে আওয়ামী লীগ কীভাবে দেখছে। মন্ত্রী-সংসদ সদস্যদের অনেকেই মোশতাকের সঙ্গে হাত মিলিয়েছিলেন। শুধু ক্রমে ক্রমে প্রকাশিত হচ্ছিল, রুশ-ভারত বলয় থেকে বেরিয়ে দেশ যাত্রা শুরু করেছে মার্কিন বলয়ের দিকে। কে এম সফিউল্লাহকে সরিয়ে জিয়াউর রহমানকে সেনাপ্রধান করা হয়েছে।
এ রকম একটা সময়ে খালেদ মোশাররফের নেতৃত্বে ঘটে অভ্যুত্থান। এই অভ্যুত্থান ছিল রক্তপাতহীন। জিয়াউর রহমানকে সরিয়ে খালেদ মোশাররফকে সেনাপ্রধান করা হয়। এ সময়েই ঘটে আরও একটি ভয়ংকর ঘটনা। জেলখানায় হত্যা করা হয় জাতীয় চার নেতা সৈয়দ নজরুল ইসলাম, তাজউদ্দীন আহমদ, এম মনসুর আলী এবং এ এইচ এম কামারুজ্জামানকে। দেশের নেতৃত্ব আবার মুক্তিযুদ্ধ-সংলগ্ন ত্যাগী নেতাদের হাতে চলে যাক, এটা মোশতাক গং চাননি, তাই এই হত্যাকাণ্ড।
তার কয়েক দিন পরেই পাশার দান উল্টে যায়। সেনাবাহিনীর মধ্যেই জাসদের সৃষ্ট ‘বিপ্লবী সৈনিক সংস্থা’ এ সময় সক্রিয় হয়ে ওঠে। এরাই ছিল সিপাহিদের উত্তেজিত করে তোলার প্রধান শক্তি। কর্নেল তাহের এ ক্ষেত্রে পালন করেন গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা। সিরাজুল আলম খান তখন খুবই শক্তিশালী নেতা। জাসদ ভেবেছিল, জিয়াউর রহমানের কাঁধে ভর করে তারা ক্ষমতায় আসবে। কিন্তু জিয়াউর রহমান চলেছেন নিজের পথে।
৭ নভেম্বরের ঘটনায় খালেদ মোশাররফ, কে এন হুদা, এ টি এম হায়দার নিহত হন। নিহত হন আরও অনেক অফিসার। সে সময় যে স্লোগানগুলো ছিল মুখ্য, তা হলো—‘সিপাহি বিপ্লব জিন্দাবাদ’, ‘জিয়াউর রহমান জিন্দাবাদ’, ‘বাংলাদেশ জিন্দাবাদ’।
জিয়াউর রহমান ক্ষমতা ভালোবাসতেন। ১৯৭১ সালের ২৭ মার্চ তিনি যখন কালুরঘাট বেতার কেন্দ্র থেকে স্বাধীনতার ঘোষণা পাঠ করেছিলেন, তখন প্রথম পাঠে তিনি নিজেকে রাষ্ট্রপতি হিসেবে ঘোষণা করেছিলেন। এই ঘোষণা যে দেশি-বিদেশি কারও কাছেই গ্রহণযোগ্য হবে না এবং এ রকম ঘোষণা দেওয়ার যোগ্য লোক তিনি নন, সে কথা বোঝানোর পর তিনি পরবর্তীকালে ‘গ্রেট ন্যাশনাল লিডার শেখ মুজিবুর রহমান’-এর নামে ঘোষণাটি দেন। ১৯৭৫ সালের ৭ নভেম্বরে ক্ষমতার পটপরিবর্তনের পরও তিনি সদ্যনিযুক্ত রাষ্ট্রপতির সঙ্গে কথা না বলেই বেতারে ভাষণ দিতে চলে গিয়েছিলেন এবং সেখানে তিনি বলেছেন, ‘প্রধান সামরিক আইন প্রশাসক’ হিসেবে দায়িত্ব নিয়েছেন। অথচ তখন তিনি ছিলেন উপপ্রধান সামরিক আইন প্রশাসক।
এরপর জিয়াউর রহমান কীভাবে জাসদের শত্রু হলেন, নানাভাবে তাদের শায়েস্তা করলেন, কীভাবে নিজের জন্য ক্ষমতার পথ নির্মাণ করে উচ্চাভিলাষী লক্ষ্য পূরণ করলেন, সে ইতিহাসও সবার জানা। আমরা সেই আলোচনায় যাব না। আমরা দেখব, ইতিহাসের এই বাঁকবদলে দেশটা কোথায় এসে পৌঁছাল।
দুই
১৯৭২ থেকে ১৯৭৫ সাল পর্যন্ত দেশে অনেক ধরনের ঘটনা ঘটেছিল। দেশের রাজনৈতিক টানাপোড়েনে অস্থিরতা বেড়েছিল। জাসদ তুলে এনেছিল সংঘাতের রাজনীতি, কুয়োর ভেতরে ঢুকেছিল যে পরাজিত শক্তি, তারাও একটু একটু করে মুখ দেখাতে শুরু করেছিল, আওয়ামী লীগের নেতা-কর্মীদের ভেতরে ক্ষমতার লোভ, দম্ভ ইত্যাদির দেখা পাওয়া যাচ্ছিল, দেশে বন্যা, খাদ্যাভাব, দুর্ভিক্ষ ইত্যাদি প্রাকৃতিক বিপর্যয়ের কারণে দেশের মানুষ রাজনীতির প্রতি হতাশা ব্যক্ত করছিল। এ রকম একটি সময়ে বাকশাল করে একদলীয় শাসনব্যবস্থা কায়েম করা বঙ্গবন্ধুর জন্য ঠিক হয়েছিল কি না, সে প্রশ্ন উঠতেই পারে। কিন্তু এই সবকিছুর পরও একজন রাষ্ট্রপতিকে হত্যা করার অধিকার কাউকে দেওয়া যায় না। বঙ্গবন্ধুর হত্যাকাণ্ড আমাদের দেশে যে কালিমা ছড়িয়েছে, তা থেকে মুক্ত হওয়া সহজ নয়, এমনকি সেই হত্যাকাণ্ডের বিচার হওয়ার পরও।
জিয়াউর রহমান জানতেন, তাঁর দলে আওয়ামী লীগের সত্যিকারের সমর্থকেরা যোগ দেবেন না। ন্যাপ-কমিউনিস্ট পার্টিও নয় (যদিও কমিউনিস্ট পার্টি বঙ্গবন্ধুর বাকশাল সমর্থনের পর জিয়াউর রহমানের খালকাটা কর্মসূচিকেও সমর্থন করেছিল)। তাহলে কাদের নিয়ে তিনি দল গড়বেন? তিনি হাত বাড়ালেন মুসলিম লীগ, জামায়াতে ইসলামী, চীনপন্থী ন্যাপ, স্বাধীনতাবিরোধী নেতাদের দিকে। ফলে রাজনীতির মাঠে গুরুত্ব বাড়ল তাঁদেরই, যাঁরা বাংলাদেশের আদর্শে বিশ্বাসী নন। তাঁদের মাধ্যমেই তিনি নিজের ক্ষমতাকে শক্তিশালী করে তুললেন। ৭ নভেম্বরের একটি তাৎপর্যময় বাঁকবদল এটি।
অতি সূক্ষ্মভাবে দেশের সংস্কৃতিতে জিয়াউর রহমান লাগালেন আরবীয়-পাকিস্তানি সুর, যা সময়মতো সবার চোখে পড়ল না। সেই সঙ্গে পশ্চিমা সংস্কৃতির অবাধ প্রবেশের পথ খুলে বুঝিয়ে দিলেন, নিজস্ব সংস্কৃতির দরকার নেই। অন্যের কাছ থেকে ধার করা সংস্কৃতিই হয়ে উঠবে আমাদের সংস্কৃতি। সাংস্কৃতিক আগ্রাসনের বিষয়টি অনেক বড় হয়ে আমাদের যে ক্ষতি করেছে, তা সহজে পূরণ হওয়ার নয়। ৭ নভেম্বরের অভ্যুত্থান মোড় নিয়েছিল এ রকম একটি দিকেও।
তিন
পাকিস্তান কায়েম করার পরপরই যখন দেখা গেল, এই সদ্য জন্মলাভকারী দেশটি পূর্ব পাকিস্তানকে বানিয়ে তুলেছে শোষণভূমি, তখনই রাজনৈতিক-সামাজিক-সাংস্কৃতিক নেতৃত্বের কল্যাণে বাঙালি জাতীয়তাবাদ জেগে উঠেছিল। এই জাতীয়তাবাদের তোড়ে তুচ্ছাতিতুচ্ছ প্রশ্নগুলো দূরে সরে গেল। দেশের সব মানুষ একাত্ম হয়েছিল ‘তুমি কে আমি কে বাঙালি বাঙালি’ স্লোগানের পটভূমিতে। যদিও এত দিন পর মনে হয়, দেশের সবাইকে ‘বাঙালি’ বলাটা ঠিক হয়নি। দেশের ক্ষুদ্র নৃ-গোষ্ঠীরাও শরিক ছিল এই আন্দোলনে, কিন্তু স্লোগানে তাদের কথা নেই।
যা-ই হোক, উন্নত ও প্রগতির ভাবনারই জয় হয়েছিল সে সময়। অসাম্প্রদায়িক, গণতান্ত্রিক মূল্যবোধসমৃদ্ধ চেতনা নিয়ে এগিয়েছিল সমগ্র জাতি। সেই জাতির মূল চালিকাশক্তি ছিলেন বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান।
খুবই গুরুত্বপূর্ণ ব্যাপার, সে সময় ধর্মের রাজনৈতিক ব্যবহার তথা ধর্মব্যবসা করার চেষ্টা করা হলে দেশের সব মানুষ তার বিরুদ্ধে দাঁড়িয়ে যাওয়ার সাহস রাখতেন বুকে। শোষণের বিরুদ্ধে সোচ্চার হতে পারতেন নেতার ডাকে।
সে অবস্থানটাই আমরা কী করে হারিয়ে ফেললাম, সেটাই প্রশ্ন। সাংস্কৃতিক পরিবর্তনের অনুঘটক কয়েকটি ঘটনার কথা এখানে উল্লেখ করা দরকার।দেশ স্বাধীন হওয়ার পর অভিবাসী হওয়া মানুষের সংখ্যা বেড়েছে। অনেকেই পশ্চিমা দেশে গেলেও কর্ম উপলক্ষে অদক্ষ শ্রমিকদের সিংহভাগ গেছেন মধ্যপ্রাচ্যের নানা দেশে। তাঁরা বৈদেশিক মুদ্রার সঙ্গে সঙ্গে এ দেশে আমদানি করেছেন আরবের পোশাকি সংস্কৃতি। খুব আস্তে আস্তে এই সংস্কৃতি ছড়িয়ে পড়েছে। ধর্মের বাহ্যিক ব্যবহার বেড়েছে, যদিও দেশে ঘুষ-দুর্নীতি একেবারেই কমেনি; বরং ক্ষমতায় গেলে কে কার চেয়ে বেশি ‘খেতে’ পারবে, তার প্রতিযোগিতা দেখা যায়। জিয়াউর রহমান এবং হুসেইন মুহম্মদ এরশাদ যেভাবে সরকারে, প্রশাসনে মুক্তিযুদ্ধবিরোধীদের ঢুকিয়েছেন, তাতে রাষ্ট্রীয় পৃষ্ঠপোষকতায় তারা সংঘবদ্ধ শক্তিশালী শ্রেণি হিসেবে দৃশ্যমান হয়েছে।
জিয়াউর রহমানের বলা ‘টাকা কোনো সমস্যা নয়’ আর ‘রাজনীতিবিদদের জন্য আমি রাজনীতি জটিল করে তুলব’ কথাগুলো আক্ষরিক অর্থেই ফলবান হয়েছে। দেশের সংসদে টাকাওয়ালা লোকেরাই মূল ভূমিকায় অবতীর্ণ হয়েছেন। সেই সঙ্গে মুক্তিযুদ্ধের পক্ষের শক্তির মধ্যেও দেখা গেছে দুর্নীতি-স্বজনপ্রীতির লক্ষণ, তাদের বলা কথা এবং করা কাজের মধ্যে ফাঁক রয়ে গেছে। ফলে সামগ্রিকভাবে রাজনীতির প্রতি একধরনের অনীহা এসেছে সাধারণ মানুষের মনে। ‘মুক্তিযুদ্ধের চেতনা’ কথাটাও এখন জোরালো কোনো অঙ্গীকার ব্যক্ত করে না।
নব্বইয়ের দশক থেকে এক মেরুর বিশ্বে মুক্তবাজার অর্থনীতির পাশাপাশি সংঘাতময় বিশ্বরাজনীতি জনমনের অনেক হিসাব-নিকাশ পাল্টে দিয়েছে। সভ্যতার আলোকবর্তিকা বলে পরিচিত দেশগুলোর আচরণেও যে নিষ্ঠুরতা, খামখেয়ালিপনা দেখা যাচ্ছে, তাতে সারা বিশ্বের মানুষের মধ্যেই প্রতিহিংসাপরায়ণতার জন্ম হচ্ছে। দেশে ধর্মভিত্তিক রাজনীতি ও সংস্কৃতির বাড়বাড়ন্ত অবস্থায় প্রগতিশীল সংস্কৃতিচর্চায় বিপর্যয় নেমে এসেছে।
এর সবই যে ৭ নভেম্বরের ফসল, তা নয়। আমরা বলার চেষ্টা করলাম, দেশ স্বাধীন হয়েছিল যে অঙ্গীকার নিয়ে, তা থেকে আমরা সরে যেতে শুরু করেছি মুক্তিযুদ্ধের পর থেকেই। সেই স্রোত বেগবান হয়েছে বঙ্গবন্ধু হত্যার পর এবং ৭ নভেম্বরের বাঁকবদলের পর বাংলাদেশ থেকে বাংলাদেশটাই ধীরে ধীরে গায়েব হয়ে যেতে শুরু করেছে।
পাদটীকা: সোচ্চার রাজনীতিবিদ এম এ জলিল ছিলেন জাসদের সভাপতি। বৈজ্ঞানিক সমাজতন্ত্র কায়েমের লক্ষ্যই ছিল তাঁর রাজনীতি। জেলখানা ঘুরে এসে তিনি খুলে বসলেন ইসলামি দোকান। হয়ে গেলেন ‘জাতীয় মুক্তি আন্দোলন’ দলের নেতা। ৭ নভেম্বরের কুশীলবদের বেশির ভাগই আওয়ামী লীগ বা বিএনপিতে খুঁজে পেয়েছেন পরবর্তী আশ্রয়। তাই এত দিন পর ১৯৭৫ সালের ৭ নভেম্বরের দিকে তাকালে স্পষ্ট কিছু দেখা কঠিন হয়ে পড়ে।
লেখক: জাহীদ রেজা নূর, উপসম্পাদক, আজকের পত্রিকা
৭ নভেম্বরের আবেদন এখন ফিকে হয়ে এসেছে। যাঁরা একে ‘জাতীয় বিপ্লব ও সংহতি দিবস’ বলতেন কিংবা বলতেন ‘সিপাহি-জনতার বিপ্লব’, তাঁদের পরবর্তী কার্যাবলিতে বোঝা গেছে, আসলে কে যে কী চাইছিলেন, সে বিষয়টি কারও কাছেই স্পষ্ট ছিল না। নানাভাবে এ সময়টিকে ব্যাখ্যা করা হয়ে থাকে। তবে এ কথা ঠিক, ৭ নভেম্বরে সব দিক থেকে সবচেয়ে লাভবান হয়েছিলেন জিয়াউর রহমান। ধীরে ধীরে তিনি ক্ষমতা কুক্ষিগত করেছেন। ১৯৭৫ সালের ৭ নভেম্বর ‘সিপাহি-জনতা ভাই ভাই, অফিসারের রক্ত চাই’ স্লোগানে যখন সেনানিবাস ও রাজপথ মুখরিত হয়ে উঠছিল, তখন সেনাবাহিনীতে সহিংসতা ছড়িয়ে পড়ছিল। অফিসাররা আতঙ্কিত হয়েছেন, সিপাহিরা উন্মাদের মতো অফিসারদের খুঁজে বেড়াচ্ছিলেন খুন করার জন্য।
তবে এ কথা নিশ্চিত করে বলা যায়, ৭ নভেম্বরের পর ইতিহাসের বাঁকবদল হয়েছে। ১৫ আগস্টের ট্র্যাজিক ঘটনাবলি বিমূঢ় করে রেখেছিল দেশকে। কেউই বুঝতে পারছিল না, কী হতে কী হয়ে গেল। প্রতিরোধ আন্দোলন যে গড়ে উঠল না, তার বেশির ভাগ দায় আওয়ামী লীগেরই। তাদেরই দলের সদস্যরা মোশতাকের মন্ত্রিসভায় যোগ দেওয়ায় বোঝা যাচ্ছিল না, এই পটপরিবর্তনের ঘটনাটি দলগতভাবে আওয়ামী লীগ কীভাবে দেখছে। মন্ত্রী-সংসদ সদস্যদের অনেকেই মোশতাকের সঙ্গে হাত মিলিয়েছিলেন। শুধু ক্রমে ক্রমে প্রকাশিত হচ্ছিল, রুশ-ভারত বলয় থেকে বেরিয়ে দেশ যাত্রা শুরু করেছে মার্কিন বলয়ের দিকে। কে এম সফিউল্লাহকে সরিয়ে জিয়াউর রহমানকে সেনাপ্রধান করা হয়েছে।
এ রকম একটা সময়ে খালেদ মোশাররফের নেতৃত্বে ঘটে অভ্যুত্থান। এই অভ্যুত্থান ছিল রক্তপাতহীন। জিয়াউর রহমানকে সরিয়ে খালেদ মোশাররফকে সেনাপ্রধান করা হয়। এ সময়েই ঘটে আরও একটি ভয়ংকর ঘটনা। জেলখানায় হত্যা করা হয় জাতীয় চার নেতা সৈয়দ নজরুল ইসলাম, তাজউদ্দীন আহমদ, এম মনসুর আলী এবং এ এইচ এম কামারুজ্জামানকে। দেশের নেতৃত্ব আবার মুক্তিযুদ্ধ-সংলগ্ন ত্যাগী নেতাদের হাতে চলে যাক, এটা মোশতাক গং চাননি, তাই এই হত্যাকাণ্ড।
তার কয়েক দিন পরেই পাশার দান উল্টে যায়। সেনাবাহিনীর মধ্যেই জাসদের সৃষ্ট ‘বিপ্লবী সৈনিক সংস্থা’ এ সময় সক্রিয় হয়ে ওঠে। এরাই ছিল সিপাহিদের উত্তেজিত করে তোলার প্রধান শক্তি। কর্নেল তাহের এ ক্ষেত্রে পালন করেন গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা। সিরাজুল আলম খান তখন খুবই শক্তিশালী নেতা। জাসদ ভেবেছিল, জিয়াউর রহমানের কাঁধে ভর করে তারা ক্ষমতায় আসবে। কিন্তু জিয়াউর রহমান চলেছেন নিজের পথে।
৭ নভেম্বরের ঘটনায় খালেদ মোশাররফ, কে এন হুদা, এ টি এম হায়দার নিহত হন। নিহত হন আরও অনেক অফিসার। সে সময় যে স্লোগানগুলো ছিল মুখ্য, তা হলো—‘সিপাহি বিপ্লব জিন্দাবাদ’, ‘জিয়াউর রহমান জিন্দাবাদ’, ‘বাংলাদেশ জিন্দাবাদ’।
জিয়াউর রহমান ক্ষমতা ভালোবাসতেন। ১৯৭১ সালের ২৭ মার্চ তিনি যখন কালুরঘাট বেতার কেন্দ্র থেকে স্বাধীনতার ঘোষণা পাঠ করেছিলেন, তখন প্রথম পাঠে তিনি নিজেকে রাষ্ট্রপতি হিসেবে ঘোষণা করেছিলেন। এই ঘোষণা যে দেশি-বিদেশি কারও কাছেই গ্রহণযোগ্য হবে না এবং এ রকম ঘোষণা দেওয়ার যোগ্য লোক তিনি নন, সে কথা বোঝানোর পর তিনি পরবর্তীকালে ‘গ্রেট ন্যাশনাল লিডার শেখ মুজিবুর রহমান’-এর নামে ঘোষণাটি দেন। ১৯৭৫ সালের ৭ নভেম্বরে ক্ষমতার পটপরিবর্তনের পরও তিনি সদ্যনিযুক্ত রাষ্ট্রপতির সঙ্গে কথা না বলেই বেতারে ভাষণ দিতে চলে গিয়েছিলেন এবং সেখানে তিনি বলেছেন, ‘প্রধান সামরিক আইন প্রশাসক’ হিসেবে দায়িত্ব নিয়েছেন। অথচ তখন তিনি ছিলেন উপপ্রধান সামরিক আইন প্রশাসক।
এরপর জিয়াউর রহমান কীভাবে জাসদের শত্রু হলেন, নানাভাবে তাদের শায়েস্তা করলেন, কীভাবে নিজের জন্য ক্ষমতার পথ নির্মাণ করে উচ্চাভিলাষী লক্ষ্য পূরণ করলেন, সে ইতিহাসও সবার জানা। আমরা সেই আলোচনায় যাব না। আমরা দেখব, ইতিহাসের এই বাঁকবদলে দেশটা কোথায় এসে পৌঁছাল।
দুই
১৯৭২ থেকে ১৯৭৫ সাল পর্যন্ত দেশে অনেক ধরনের ঘটনা ঘটেছিল। দেশের রাজনৈতিক টানাপোড়েনে অস্থিরতা বেড়েছিল। জাসদ তুলে এনেছিল সংঘাতের রাজনীতি, কুয়োর ভেতরে ঢুকেছিল যে পরাজিত শক্তি, তারাও একটু একটু করে মুখ দেখাতে শুরু করেছিল, আওয়ামী লীগের নেতা-কর্মীদের ভেতরে ক্ষমতার লোভ, দম্ভ ইত্যাদির দেখা পাওয়া যাচ্ছিল, দেশে বন্যা, খাদ্যাভাব, দুর্ভিক্ষ ইত্যাদি প্রাকৃতিক বিপর্যয়ের কারণে দেশের মানুষ রাজনীতির প্রতি হতাশা ব্যক্ত করছিল। এ রকম একটি সময়ে বাকশাল করে একদলীয় শাসনব্যবস্থা কায়েম করা বঙ্গবন্ধুর জন্য ঠিক হয়েছিল কি না, সে প্রশ্ন উঠতেই পারে। কিন্তু এই সবকিছুর পরও একজন রাষ্ট্রপতিকে হত্যা করার অধিকার কাউকে দেওয়া যায় না। বঙ্গবন্ধুর হত্যাকাণ্ড আমাদের দেশে যে কালিমা ছড়িয়েছে, তা থেকে মুক্ত হওয়া সহজ নয়, এমনকি সেই হত্যাকাণ্ডের বিচার হওয়ার পরও।
জিয়াউর রহমান জানতেন, তাঁর দলে আওয়ামী লীগের সত্যিকারের সমর্থকেরা যোগ দেবেন না। ন্যাপ-কমিউনিস্ট পার্টিও নয় (যদিও কমিউনিস্ট পার্টি বঙ্গবন্ধুর বাকশাল সমর্থনের পর জিয়াউর রহমানের খালকাটা কর্মসূচিকেও সমর্থন করেছিল)। তাহলে কাদের নিয়ে তিনি দল গড়বেন? তিনি হাত বাড়ালেন মুসলিম লীগ, জামায়াতে ইসলামী, চীনপন্থী ন্যাপ, স্বাধীনতাবিরোধী নেতাদের দিকে। ফলে রাজনীতির মাঠে গুরুত্ব বাড়ল তাঁদেরই, যাঁরা বাংলাদেশের আদর্শে বিশ্বাসী নন। তাঁদের মাধ্যমেই তিনি নিজের ক্ষমতাকে শক্তিশালী করে তুললেন। ৭ নভেম্বরের একটি তাৎপর্যময় বাঁকবদল এটি।
অতি সূক্ষ্মভাবে দেশের সংস্কৃতিতে জিয়াউর রহমান লাগালেন আরবীয়-পাকিস্তানি সুর, যা সময়মতো সবার চোখে পড়ল না। সেই সঙ্গে পশ্চিমা সংস্কৃতির অবাধ প্রবেশের পথ খুলে বুঝিয়ে দিলেন, নিজস্ব সংস্কৃতির দরকার নেই। অন্যের কাছ থেকে ধার করা সংস্কৃতিই হয়ে উঠবে আমাদের সংস্কৃতি। সাংস্কৃতিক আগ্রাসনের বিষয়টি অনেক বড় হয়ে আমাদের যে ক্ষতি করেছে, তা সহজে পূরণ হওয়ার নয়। ৭ নভেম্বরের অভ্যুত্থান মোড় নিয়েছিল এ রকম একটি দিকেও।
তিন
পাকিস্তান কায়েম করার পরপরই যখন দেখা গেল, এই সদ্য জন্মলাভকারী দেশটি পূর্ব পাকিস্তানকে বানিয়ে তুলেছে শোষণভূমি, তখনই রাজনৈতিক-সামাজিক-সাংস্কৃতিক নেতৃত্বের কল্যাণে বাঙালি জাতীয়তাবাদ জেগে উঠেছিল। এই জাতীয়তাবাদের তোড়ে তুচ্ছাতিতুচ্ছ প্রশ্নগুলো দূরে সরে গেল। দেশের সব মানুষ একাত্ম হয়েছিল ‘তুমি কে আমি কে বাঙালি বাঙালি’ স্লোগানের পটভূমিতে। যদিও এত দিন পর মনে হয়, দেশের সবাইকে ‘বাঙালি’ বলাটা ঠিক হয়নি। দেশের ক্ষুদ্র নৃ-গোষ্ঠীরাও শরিক ছিল এই আন্দোলনে, কিন্তু স্লোগানে তাদের কথা নেই।
যা-ই হোক, উন্নত ও প্রগতির ভাবনারই জয় হয়েছিল সে সময়। অসাম্প্রদায়িক, গণতান্ত্রিক মূল্যবোধসমৃদ্ধ চেতনা নিয়ে এগিয়েছিল সমগ্র জাতি। সেই জাতির মূল চালিকাশক্তি ছিলেন বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান।
খুবই গুরুত্বপূর্ণ ব্যাপার, সে সময় ধর্মের রাজনৈতিক ব্যবহার তথা ধর্মব্যবসা করার চেষ্টা করা হলে দেশের সব মানুষ তার বিরুদ্ধে দাঁড়িয়ে যাওয়ার সাহস রাখতেন বুকে। শোষণের বিরুদ্ধে সোচ্চার হতে পারতেন নেতার ডাকে।
সে অবস্থানটাই আমরা কী করে হারিয়ে ফেললাম, সেটাই প্রশ্ন। সাংস্কৃতিক পরিবর্তনের অনুঘটক কয়েকটি ঘটনার কথা এখানে উল্লেখ করা দরকার।দেশ স্বাধীন হওয়ার পর অভিবাসী হওয়া মানুষের সংখ্যা বেড়েছে। অনেকেই পশ্চিমা দেশে গেলেও কর্ম উপলক্ষে অদক্ষ শ্রমিকদের সিংহভাগ গেছেন মধ্যপ্রাচ্যের নানা দেশে। তাঁরা বৈদেশিক মুদ্রার সঙ্গে সঙ্গে এ দেশে আমদানি করেছেন আরবের পোশাকি সংস্কৃতি। খুব আস্তে আস্তে এই সংস্কৃতি ছড়িয়ে পড়েছে। ধর্মের বাহ্যিক ব্যবহার বেড়েছে, যদিও দেশে ঘুষ-দুর্নীতি একেবারেই কমেনি; বরং ক্ষমতায় গেলে কে কার চেয়ে বেশি ‘খেতে’ পারবে, তার প্রতিযোগিতা দেখা যায়। জিয়াউর রহমান এবং হুসেইন মুহম্মদ এরশাদ যেভাবে সরকারে, প্রশাসনে মুক্তিযুদ্ধবিরোধীদের ঢুকিয়েছেন, তাতে রাষ্ট্রীয় পৃষ্ঠপোষকতায় তারা সংঘবদ্ধ শক্তিশালী শ্রেণি হিসেবে দৃশ্যমান হয়েছে।
জিয়াউর রহমানের বলা ‘টাকা কোনো সমস্যা নয়’ আর ‘রাজনীতিবিদদের জন্য আমি রাজনীতি জটিল করে তুলব’ কথাগুলো আক্ষরিক অর্থেই ফলবান হয়েছে। দেশের সংসদে টাকাওয়ালা লোকেরাই মূল ভূমিকায় অবতীর্ণ হয়েছেন। সেই সঙ্গে মুক্তিযুদ্ধের পক্ষের শক্তির মধ্যেও দেখা গেছে দুর্নীতি-স্বজনপ্রীতির লক্ষণ, তাদের বলা কথা এবং করা কাজের মধ্যে ফাঁক রয়ে গেছে। ফলে সামগ্রিকভাবে রাজনীতির প্রতি একধরনের অনীহা এসেছে সাধারণ মানুষের মনে। ‘মুক্তিযুদ্ধের চেতনা’ কথাটাও এখন জোরালো কোনো অঙ্গীকার ব্যক্ত করে না।
নব্বইয়ের দশক থেকে এক মেরুর বিশ্বে মুক্তবাজার অর্থনীতির পাশাপাশি সংঘাতময় বিশ্বরাজনীতি জনমনের অনেক হিসাব-নিকাশ পাল্টে দিয়েছে। সভ্যতার আলোকবর্তিকা বলে পরিচিত দেশগুলোর আচরণেও যে নিষ্ঠুরতা, খামখেয়ালিপনা দেখা যাচ্ছে, তাতে সারা বিশ্বের মানুষের মধ্যেই প্রতিহিংসাপরায়ণতার জন্ম হচ্ছে। দেশে ধর্মভিত্তিক রাজনীতি ও সংস্কৃতির বাড়বাড়ন্ত অবস্থায় প্রগতিশীল সংস্কৃতিচর্চায় বিপর্যয় নেমে এসেছে।
এর সবই যে ৭ নভেম্বরের ফসল, তা নয়। আমরা বলার চেষ্টা করলাম, দেশ স্বাধীন হয়েছিল যে অঙ্গীকার নিয়ে, তা থেকে আমরা সরে যেতে শুরু করেছি মুক্তিযুদ্ধের পর থেকেই। সেই স্রোত বেগবান হয়েছে বঙ্গবন্ধু হত্যার পর এবং ৭ নভেম্বরের বাঁকবদলের পর বাংলাদেশ থেকে বাংলাদেশটাই ধীরে ধীরে গায়েব হয়ে যেতে শুরু করেছে।
পাদটীকা: সোচ্চার রাজনীতিবিদ এম এ জলিল ছিলেন জাসদের সভাপতি। বৈজ্ঞানিক সমাজতন্ত্র কায়েমের লক্ষ্যই ছিল তাঁর রাজনীতি। জেলখানা ঘুরে এসে তিনি খুলে বসলেন ইসলামি দোকান। হয়ে গেলেন ‘জাতীয় মুক্তি আন্দোলন’ দলের নেতা। ৭ নভেম্বরের কুশীলবদের বেশির ভাগই আওয়ামী লীগ বা বিএনপিতে খুঁজে পেয়েছেন পরবর্তী আশ্রয়। তাই এত দিন পর ১৯৭৫ সালের ৭ নভেম্বরের দিকে তাকালে স্পষ্ট কিছু দেখা কঠিন হয়ে পড়ে।
লেখক: জাহীদ রেজা নূর, উপসম্পাদক, আজকের পত্রিকা
ঢাকা-চট্টগ্রাম মহাসড়কের কুমিল্লা এলাকায় যাত্রীবাহী বাসে ডাকাতি বেড়েই চলছে। এ কারণে চালক ও যাত্রীদের কাছে আতঙ্কের নাম হয়ে উঠছে এই সড়ক। ডাকাতির শিকার বেশি হচ্ছেন প্রবাসফেরত লোকজন। ডাকাতেরা অস্ত্র ঠেকিয়ে লুট করে নিচ্ছে সর্বস্ব। আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর পরিচয়েও ঘটছে ডাকাতির ঘটনা।
০২ মার্চ ২০২৫বিআরটিসির বাস দিয়ে চালু করা বিশেষায়িত বাস র্যাপিড ট্রানজিট (বিআরটি) লেনে অনুমতি না নিয়েই চলছে বেসরকারি কোম্পানির কিছু বাস। ঢুকে পড়ছে সিএনজিচালিত অটোরিকশা, ব্যাটারিচালিত অটোরিকশা। উল্টো পথে চলছে মোটরসাইকেল। অন্যদিকে বিআরটিসির মাত্র ১০টি বাস চলাচল করায় সোয়া চার হাজার কোটি টাকার এই প্রকল্প থেকে...
১৬ জানুয়ারি ২০২৫গাজীপুর মহানগরের বোর্ডবাজার এলাকার ইসলামিক ইউনিভার্সিটি অব টেকনোলজির (আইইউটি) মেকানিক্যাল ইঞ্জিনিয়ারিং বিভাগের শিক্ষার্থীরা পিকনিকে যাচ্ছিলেন শ্রীপুরের মাটির মায়া ইকো রিসোর্টে। ঢাকা-ময়মনসিংহ মহাসড়ক থেকে বাসগুলো গ্রামের সরু সড়কে ঢোকার পর বিদ্যুতের তারে জড়িয়ে যায় বিআরটিসির একটি দোতলা বাস...
২৪ নভেম্বর ২০২৪ঝড়-জলোচ্ছ্বাস থেকে রক্ষায় সন্দ্বীপের ব্লক বেড়িবাঁধসহ একাধিক প্রকল্প হাতে নিয়েছে সরকার। এ লক্ষ্যে বরাদ্দ দেওয়া হয়েছে ৫৬২ কোটি টাকা। এ জন্য টেন্ডারও হয়েছে। প্রায় এক বছর পেরিয়ে গেলেও ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠানগুলো কাজ শুরু করছে না। পানি উন্নয়ন বোর্ডের (পাউবো) তাগাদায়ও কোনো কাজ হচ্ছে না বলে জানিয়েছেন...
২০ নভেম্বর ২০২৪