তাপস মজুমদার
প্রতিকূলতার বাতাসে জেগে ওঠা এক অনন্য গল্পকার হাসান আজিজুল হক। যেমন করে তাঁর লেখা গল্প-উপন্যাসে প্রধান হয়ে উঠেছে মানুষ, তেমনি প্রকৃতি-পরিবেশ। জীবনানুভূতির রূপায়ণে হাসানের তুলনা মেলা ভার। বাস্তুচ্যুত ব্যক্তিজীবনের অভিজ্ঞতা আশ্রয় করে অজস্র ডালপালা ছড়িয়ে কথাসাহিত্যিক হাসান আজিজুল হক বাংলা সাহিত্যে এক মহৎ স্থান অধিকার করে আছেন।
হাসান আজিজুল হকের সাহিত্য সৃষ্টি নিয়ে কথা বলার মতো যোগ্যতা আমার নেই। ব্যক্তিজীবনে তাঁর সঙ্গে অনেকটি বছর কাছাকাছি কাটানোর সুযোগ হয়েছে। সেখান থেকেই একটি ঘটনার কথা আজ উল্লেখ করব, যেখান থেকে ব্যক্তি হাসানকে চেনা যায়। রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষা আন্দোলন মঞ্চের ‘শিক্ষা, রাষ্ট্র ও ধর্মনিরপেক্ষতা’ বিষয়ে ২০০৬ সালে একটি সেমিনারে হাসান আজিজুল হক এ রকম বলেছিলেন—ধর্মব্যবস্থার ওপর ভিত্তি করে কোনো দেশে শিক্ষা বা আইনব্যবস্থা প্রণয়ন করা উচিত নয়। এর এক কি দুই দিন পর ইসলামী ছাত্রশিবির ক্যাম্পাসে মিছিল-সমাবেশ করে বলল, তিনি ধর্মের বিপক্ষে কথা বলেছেন; তিনি নাস্তিক, মুরতাদ। তাঁর পরিণতি হুমায়ুন আজাদের মতো হবে!
ওই সমাবেশের ঘটনার সময়ে ফোনে বিশ্ববিদ্যালয়ের একজনের সঙ্গে আমার কথা হচ্ছিল। সে জানাল, ‘এখন আমরা বিশ্রী এক অবস্থার মধ্যে আছি। হাসান আজিজুল হকের কুশপুত্তলিকা দাহ করা হচ্ছে এবং ওরা জঘন্য ভাষায় স্যারকে গালাগাল করছে। স্যারকে বিশ্ববিদ্যালয় ক্যাম্পাসে অবাঞ্ছিত ঘোষণা করেছে।’ ঘটনার আকস্মিকতায় আমি কিছুক্ষণ বিমূঢ় হয়ে রইলাম। তারপর খুব আতঙ্কিত হয়ে স্যারকে ফোন করলাম। ওপারে ধরলেন তিনি। হাসতে হাসতে স্বভাবসুলভ স্বরে টেনে টেনে বললেন: ‘শুনেছি। সব শুনেছি। ওরা পোড়াচ্ছে আমাকে। আর বাক্যের যদি সে শক্তি থাকত, বুঝলে, তাহলে আমার দগ্ধ শরীর এতক্ষণ ছিন্নভিন্ন হয়ে ছড়িয়ে যেত দিগ্বিদিক!’
পরদিন খবরের কাগজে দেখলাম তাঁকে কেটে বঙ্গোপসাগরে ভাসিয়ে দেওয়ার হুমকি। দেশের অবস্থা তখন ভালো নয়। তত্ত্বাবধায়ক সরকার নিয়ে অনিশ্চয়তা এবং সংকট ঘনীভূত হয়ে আসছে। সেদিন শুক্রবার। অফিস নেই। রিপোর্টটা পড়ে তখনই স্যারের বাসায় ছুটলাম। সেখানে পৌঁছে দেখলাম, শত শত ফোন আসছে। আমরা ভীত। কিন্তু তিনি একে একে সব ফোন রিসিভ করছেন। সকালের নাশতা হয়নি। ফোনের তোড়ে বাড়িতে উপস্থিত দর্শনার্থী, ভক্ত আর সাংবাদিকদের সঙ্গে কথাও বলতে পারছেন না। ঢাকা, নিউইয়র্ক, রাজশাহী, লন্ডন, সিলেট, প্যারিস, খুলনা, মেলবোর্ন সব একাকার। সবারই উদ্বিগ্ন প্রতিক্রিয়া।
তিনি উচ্চ স্বরে সহজ ভঙ্গিতেই বলছেন, ‘শুনুন, কিচ্ছু ভাববেন না, নিশ্চিন্ত থাকুন। একদম।’ কারোর করুণ আর্তনাদমূলক কণ্ঠ শুনে হাসতে হাসতে বলছেন, ‘সান্ত্বনা আমি আপনাকে দেব, না আপনি আমাকে?’ কারোর আশঙ্কার জবাবে বলছেন, ‘ভাই, আমি একজন অধ্যাপক। দেশটা ডুবছে। তিন যুগ ছাত্র পড়িয়েছি। শিক্ষা নিয়ে আমি কথা বলব না? এখনো এ দেশে একটি সংবিধান চালু আছে, তাই তো! তাতে মতপ্রকাশের স্বাধীনতার কথাটা তো কেটে দেওয়া হয়নি। আর কেটে দেওয়া হলেও আমি বলতাম।’
দেখলাম হাসান কিছুমাত্র বিচলিত নন; বরং তাঁকে দেখে আমরাই নির্বাক। ওই সকালেই শামসুর রাহমানের মৃত্যুতে রাজশাহীতে সাংবাদিকদের একটি শোকসভার আয়োজন ছিল। তিনি ওই সভার প্রধান অতিথি। ভেবেছিলাম এই পরিস্থিতিতে তিনি হয়তো বাড়ি থেকে বেরোবেন না। তাঁর স্ত্রী বাধা দিলেন। আমরাও বারণ করলাম। কিন্তু কারও অনুরোধ তিনি রাখলেন না। অবশেষে আমি, কবি জুলফিকার মতিন, অধ্যাপক সুব্রত মজুমদারসহ কয়েকজন এক গাড়িতে ঠাসাঠাসি করে গেলাম। সুনসান পথে যেতে সবারই আতঙ্ক হচ্ছিল। চারদিকে তীক্ষ্ণ দৃষ্টি রাখছিলাম। প্রেসক্লাবের সেই অনুষ্ঠানে তিনি গেলেন এবং বক্তৃতা করলেন। বিস্ময়ের সঙ্গে লক্ষ করলাম, তাঁর সেই একই রোখ, একই রোষ, একই ভাষা। শ্রোতার আসনে বসে বারবার তাঁকে কুর্নিশ করছিলাম অন্তরে।
অজস্র মানুষ এই দুষ্কর্মের তীব্র নিন্দা জানিয়েছিলেন। অনেকেই তাঁকে প্রবোধ দিতে চেষ্টা করেছিলেন। স্যারের পক্ষে থানায় জিডিও করা হয়েছিল। কিন্তু অতি কাছ থেকে যে দুঃসাহসিক দুটি চোখ আমি দেখলাম, তার দৃষ্টি ঘাতকের বুলেটের চেয়ে তীক্ষ্ণ, যে কণ্ঠ আমি শুনলাম, তার তেজস্বী শক্তি ছিন্নভিন্ন করতে পারে ঘাতকের লক্ষ্য, যে বাণী ভেতরে অনুভব করলাম, তার তীক্ষ্ণ ধার নিরস্ত্র মানুষকেও অসম সাহসী ও সমর্থ করে তুলতে পারে অনায়াসে। যুগে যুগে এমন মানুষই আমাদের কাম্য।
১৯৩৯ সালে জন্ম নেওয়া এই মহৎ মানুষটির প্রথম মৃত্যুবার্ষিকীতে তাঁর উদ্দেশ্যে গভীর শ্রদ্ধা নিবেদন করছি।
লেখক: সংস্কৃতিকর্মী
প্রতিকূলতার বাতাসে জেগে ওঠা এক অনন্য গল্পকার হাসান আজিজুল হক। যেমন করে তাঁর লেখা গল্প-উপন্যাসে প্রধান হয়ে উঠেছে মানুষ, তেমনি প্রকৃতি-পরিবেশ। জীবনানুভূতির রূপায়ণে হাসানের তুলনা মেলা ভার। বাস্তুচ্যুত ব্যক্তিজীবনের অভিজ্ঞতা আশ্রয় করে অজস্র ডালপালা ছড়িয়ে কথাসাহিত্যিক হাসান আজিজুল হক বাংলা সাহিত্যে এক মহৎ স্থান অধিকার করে আছেন।
হাসান আজিজুল হকের সাহিত্য সৃষ্টি নিয়ে কথা বলার মতো যোগ্যতা আমার নেই। ব্যক্তিজীবনে তাঁর সঙ্গে অনেকটি বছর কাছাকাছি কাটানোর সুযোগ হয়েছে। সেখান থেকেই একটি ঘটনার কথা আজ উল্লেখ করব, যেখান থেকে ব্যক্তি হাসানকে চেনা যায়। রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষা আন্দোলন মঞ্চের ‘শিক্ষা, রাষ্ট্র ও ধর্মনিরপেক্ষতা’ বিষয়ে ২০০৬ সালে একটি সেমিনারে হাসান আজিজুল হক এ রকম বলেছিলেন—ধর্মব্যবস্থার ওপর ভিত্তি করে কোনো দেশে শিক্ষা বা আইনব্যবস্থা প্রণয়ন করা উচিত নয়। এর এক কি দুই দিন পর ইসলামী ছাত্রশিবির ক্যাম্পাসে মিছিল-সমাবেশ করে বলল, তিনি ধর্মের বিপক্ষে কথা বলেছেন; তিনি নাস্তিক, মুরতাদ। তাঁর পরিণতি হুমায়ুন আজাদের মতো হবে!
ওই সমাবেশের ঘটনার সময়ে ফোনে বিশ্ববিদ্যালয়ের একজনের সঙ্গে আমার কথা হচ্ছিল। সে জানাল, ‘এখন আমরা বিশ্রী এক অবস্থার মধ্যে আছি। হাসান আজিজুল হকের কুশপুত্তলিকা দাহ করা হচ্ছে এবং ওরা জঘন্য ভাষায় স্যারকে গালাগাল করছে। স্যারকে বিশ্ববিদ্যালয় ক্যাম্পাসে অবাঞ্ছিত ঘোষণা করেছে।’ ঘটনার আকস্মিকতায় আমি কিছুক্ষণ বিমূঢ় হয়ে রইলাম। তারপর খুব আতঙ্কিত হয়ে স্যারকে ফোন করলাম। ওপারে ধরলেন তিনি। হাসতে হাসতে স্বভাবসুলভ স্বরে টেনে টেনে বললেন: ‘শুনেছি। সব শুনেছি। ওরা পোড়াচ্ছে আমাকে। আর বাক্যের যদি সে শক্তি থাকত, বুঝলে, তাহলে আমার দগ্ধ শরীর এতক্ষণ ছিন্নভিন্ন হয়ে ছড়িয়ে যেত দিগ্বিদিক!’
পরদিন খবরের কাগজে দেখলাম তাঁকে কেটে বঙ্গোপসাগরে ভাসিয়ে দেওয়ার হুমকি। দেশের অবস্থা তখন ভালো নয়। তত্ত্বাবধায়ক সরকার নিয়ে অনিশ্চয়তা এবং সংকট ঘনীভূত হয়ে আসছে। সেদিন শুক্রবার। অফিস নেই। রিপোর্টটা পড়ে তখনই স্যারের বাসায় ছুটলাম। সেখানে পৌঁছে দেখলাম, শত শত ফোন আসছে। আমরা ভীত। কিন্তু তিনি একে একে সব ফোন রিসিভ করছেন। সকালের নাশতা হয়নি। ফোনের তোড়ে বাড়িতে উপস্থিত দর্শনার্থী, ভক্ত আর সাংবাদিকদের সঙ্গে কথাও বলতে পারছেন না। ঢাকা, নিউইয়র্ক, রাজশাহী, লন্ডন, সিলেট, প্যারিস, খুলনা, মেলবোর্ন সব একাকার। সবারই উদ্বিগ্ন প্রতিক্রিয়া।
তিনি উচ্চ স্বরে সহজ ভঙ্গিতেই বলছেন, ‘শুনুন, কিচ্ছু ভাববেন না, নিশ্চিন্ত থাকুন। একদম।’ কারোর করুণ আর্তনাদমূলক কণ্ঠ শুনে হাসতে হাসতে বলছেন, ‘সান্ত্বনা আমি আপনাকে দেব, না আপনি আমাকে?’ কারোর আশঙ্কার জবাবে বলছেন, ‘ভাই, আমি একজন অধ্যাপক। দেশটা ডুবছে। তিন যুগ ছাত্র পড়িয়েছি। শিক্ষা নিয়ে আমি কথা বলব না? এখনো এ দেশে একটি সংবিধান চালু আছে, তাই তো! তাতে মতপ্রকাশের স্বাধীনতার কথাটা তো কেটে দেওয়া হয়নি। আর কেটে দেওয়া হলেও আমি বলতাম।’
দেখলাম হাসান কিছুমাত্র বিচলিত নন; বরং তাঁকে দেখে আমরাই নির্বাক। ওই সকালেই শামসুর রাহমানের মৃত্যুতে রাজশাহীতে সাংবাদিকদের একটি শোকসভার আয়োজন ছিল। তিনি ওই সভার প্রধান অতিথি। ভেবেছিলাম এই পরিস্থিতিতে তিনি হয়তো বাড়ি থেকে বেরোবেন না। তাঁর স্ত্রী বাধা দিলেন। আমরাও বারণ করলাম। কিন্তু কারও অনুরোধ তিনি রাখলেন না। অবশেষে আমি, কবি জুলফিকার মতিন, অধ্যাপক সুব্রত মজুমদারসহ কয়েকজন এক গাড়িতে ঠাসাঠাসি করে গেলাম। সুনসান পথে যেতে সবারই আতঙ্ক হচ্ছিল। চারদিকে তীক্ষ্ণ দৃষ্টি রাখছিলাম। প্রেসক্লাবের সেই অনুষ্ঠানে তিনি গেলেন এবং বক্তৃতা করলেন। বিস্ময়ের সঙ্গে লক্ষ করলাম, তাঁর সেই একই রোখ, একই রোষ, একই ভাষা। শ্রোতার আসনে বসে বারবার তাঁকে কুর্নিশ করছিলাম অন্তরে।
অজস্র মানুষ এই দুষ্কর্মের তীব্র নিন্দা জানিয়েছিলেন। অনেকেই তাঁকে প্রবোধ দিতে চেষ্টা করেছিলেন। স্যারের পক্ষে থানায় জিডিও করা হয়েছিল। কিন্তু অতি কাছ থেকে যে দুঃসাহসিক দুটি চোখ আমি দেখলাম, তার দৃষ্টি ঘাতকের বুলেটের চেয়ে তীক্ষ্ণ, যে কণ্ঠ আমি শুনলাম, তার তেজস্বী শক্তি ছিন্নভিন্ন করতে পারে ঘাতকের লক্ষ্য, যে বাণী ভেতরে অনুভব করলাম, তার তীক্ষ্ণ ধার নিরস্ত্র মানুষকেও অসম সাহসী ও সমর্থ করে তুলতে পারে অনায়াসে। যুগে যুগে এমন মানুষই আমাদের কাম্য।
১৯৩৯ সালে জন্ম নেওয়া এই মহৎ মানুষটির প্রথম মৃত্যুবার্ষিকীতে তাঁর উদ্দেশ্যে গভীর শ্রদ্ধা নিবেদন করছি।
লেখক: সংস্কৃতিকর্মী
ঢাকা-চট্টগ্রাম মহাসড়কের কুমিল্লা এলাকায় যাত্রীবাহী বাসে ডাকাতি বেড়েই চলছে। এ কারণে চালক ও যাত্রীদের কাছে আতঙ্কের নাম হয়ে উঠছে এই সড়ক। ডাকাতির শিকার বেশি হচ্ছেন প্রবাসফেরত লোকজন। ডাকাতেরা অস্ত্র ঠেকিয়ে লুট করে নিচ্ছে সর্বস্ব। আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর পরিচয়েও ঘটছে ডাকাতির ঘটনা।
০২ মার্চ ২০২৫বিআরটিসির বাস দিয়ে চালু করা বিশেষায়িত বাস র্যাপিড ট্রানজিট (বিআরটি) লেনে অনুমতি না নিয়েই চলছে বেসরকারি কোম্পানির কিছু বাস। ঢুকে পড়ছে সিএনজিচালিত অটোরিকশা, ব্যাটারিচালিত অটোরিকশা। উল্টো পথে চলছে মোটরসাইকেল। অন্যদিকে বিআরটিসির মাত্র ১০টি বাস চলাচল করায় সোয়া চার হাজার কোটি টাকার এই প্রকল্প থেকে...
১৬ জানুয়ারি ২০২৫গাজীপুর মহানগরের বোর্ডবাজার এলাকার ইসলামিক ইউনিভার্সিটি অব টেকনোলজির (আইইউটি) মেকানিক্যাল ইঞ্জিনিয়ারিং বিভাগের শিক্ষার্থীরা পিকনিকে যাচ্ছিলেন শ্রীপুরের মাটির মায়া ইকো রিসোর্টে। ঢাকা-ময়মনসিংহ মহাসড়ক থেকে বাসগুলো গ্রামের সরু সড়কে ঢোকার পর বিদ্যুতের তারে জড়িয়ে যায় বিআরটিসির একটি দোতলা বাস...
২৪ নভেম্বর ২০২৪ঝড়-জলোচ্ছ্বাস থেকে রক্ষায় সন্দ্বীপের ব্লক বেড়িবাঁধসহ একাধিক প্রকল্প হাতে নিয়েছে সরকার। এ লক্ষ্যে বরাদ্দ দেওয়া হয়েছে ৫৬২ কোটি টাকা। এ জন্য টেন্ডারও হয়েছে। প্রায় এক বছর পেরিয়ে গেলেও ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠানগুলো কাজ শুরু করছে না। পানি উন্নয়ন বোর্ডের (পাউবো) তাগাদায়ও কোনো কাজ হচ্ছে না বলে জানিয়েছেন...
২০ নভেম্বর ২০২৪