Ajker Patrika

কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা পুঁজির শোষণকে একচেটিয়া করে তুলবে

আবু তাহের খান
কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা পুঁজির শোষণকে একচেটিয়া করে তুলবে

করোনা-উত্তর অর্থনৈতিক মন্দা, ইউক্রেন যুদ্ধ, মার্কিন-চীন উত্তেজনা ইত্যাদির মতোই গুরুত্বপূর্ণ বৈশ্বিক আলোচনার কেন্দ্রে এখন কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা বা আর্টিফিশিয়াল ইন্টেলিজেন্স (এআই)। এর প্রায়োগিক ফলাফল, উপকারিতা, ক্ষতিকর অনুষঙ্গ, দীর্ঘমেয়াদি প্রতিক্রিয়া ইত্যাদি নিয়ে পক্ষ-বিপক্ষের আলোচনাও এখন যথেষ্টই মুখর। পরিবর্তনবাদীদের মতে, প্রযুক্তির উদ্ভাবন ও ফলাফলকে পরিপূর্ণ মাত্রায় ব্যবহার করতে না পারলে এ ক্ষেত্রে বৈশ্বিক প্রতিযোগিতায় পিছিয়ে পড়াটা প্রায় অনিবার্য।

অন্যদিকে নিজেদের যাঁরা মানবিক যুক্তিবাদী বলে দাবি করেন, তাঁদের মত হচ্ছে, এআইকে একটি সুনির্দিষ্ট নীতিমালা ও নিয়ন্ত্রণকাঠামোর আওতায় ব্যবহার করতে না পারলে পরিণামে তা পুরো মানবজাতির বুদ্ধিবৃত্তিক বিকাশ ও সৃজনশীলতাকেই হুমকির মুখে ঠেলে দিতে পারে। এর চেয়েও বড় কথা, এটি বৈশ্বিক অর্থনৈতিক কাঠামোতে পুঁজির একচেটিয়াত্বকে আরও প্রবল করে তোলার মাধ্যমে শ্রেণিবৈষম্যকে প্রকট করে তুলতে পারে, যার সবচেয়ে বড় অমানবিক শিকারে পরিণত হতে পারে বিশ্বের অনুন্নত দেশগুলো।

উপরিউক্ত এ ত্রিমাত্রিক পরিস্থিতিতে কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা ব্যবহারের ক্ষেত্রে মানবজাতির দৃষ্টিভঙ্গি ও ব্যবহারকাঠামো কী হবে, সে বিষয়টি নিয়ে যেকোনো ধরনের আবেগ ও আসক্তির ঊর্ধ্বে উঠে সম্পূর্ণ নির্মোহ দৃষ্টিকোণ থেকে চিন্তাভাবনা করা উচিত বলে মনে করি। উল্লেখ্য, ইতালি এবং আরও বেশ কিছু দেশ ইতিমধ্যে এআইর ব্যবহার নিষিদ্ধ করেছে।

অপরদিকে বিরাটসংখ্যক সহজবাদী মানুষ ও নিরবচ্ছিন্ন মুনাফা সন্ধানী উদ্যোক্তা ইতিমধ্যে একে প্রযুক্তির বৈপ্লবিক রূপান্তর বলে আখ্যায়িত করেছেন। আর রাজনৈতিক অর্থনীতির বিশ্লেষকেরা ইতিমধ্যে দেখিয়েছেন যে বিশ্বের কেন্দ্রে থেকে এআই প্রযুক্তির উৎপাদন ও বণ্টনকে যাঁরা নিয়ন্ত্রণ করছেন, এর মাধ্যমে তাঁরা বস্তুত তাঁদের নিজস্ব চিন্তাভাবনা, প্রয়োজন ও ব্যবসায়িক স্বার্থকেই সমুন্নত রাখার চেষ্টা করছেন এবং ভবিষ্যতেও হয়তো তাঁরা সেটাই করবেন।

কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা নিয়ে অন্য একটি আলোচনা এরূপ যে এর সম্প্রসারিত ব্যবহারের ফলে বহু মানুষ বেকার হয়ে পড়বে, যা খুবই অগভীর ও অসম্পূর্ণ আলোচনা। আসলে এআইর বর্ধিত ব্যবহারজনিত বেকারত্বের বিষয়টি তেমন বড় কোনো সমস্যা নয়, যেমন বড় বলে আপাতদৃষ্টিতে এটিকে মনে করা হচ্ছে। এর ব্যাপকভিত্তিক প্রয়োগের ফলে সীমিতসংখ্যক মানুষের বেকার হয়ে পড়ার আশঙ্কা হয়তো আছে। তবে এর ব্যবহার-প্রক্রিয়ায় নতুন করে বহু লোকের কর্মসংস্থানেরও সুযোগ রয়েছে।

ফলে এ নিয়ে যতটা উদ্বেগ প্রকাশ করা হচ্ছে, বাস্তব পরিস্থিতি মোটেও ততটা ভীতিকর নয়। যেকোনো নতুন প্রযুক্তি ব্যবহারের প্রাথমিক পর্যায়ে সব যুগেই এমনটি হয়ে এসেছে। বাংলাদেশের লগি-বৈঠাচালিত নৌকার জায়গায় যখন শ্যালো ইঞ্জিনচালিত নৌকার চলাচল শুরু হয়, তখন নিরীহ অসহায় মাঝিরা জীবিকা হারানোর ভয়ে রীতিমতো তটস্থ ছিলেন। কিন্তু ঘটনা-পরবর্তী অতি অল্প সময়ের মধ্যেই তাঁরা বিকল্প জীবিকা খুঁজে নিতে সক্ষম হন এবং নতুন সে পেশা যেকোনো বিবেচনা থেকেই পূর্ববর্তী পেশার চেয়ে অধিকতর উন্নত, উপভোগ্য ও মর্যাদাকর বলে প্রমাণিত হয়।

কিন্তু তারপরও কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা নিয়ে এটি এখন খুবই উদ্বেগজনক আলোচনা যে তা মানুষের চিন্তা ও সৃজনশীলতা বিকাশের পথকে রুদ্ধ করে দিতে পারে এবং ফলে মানবসমাজে বুদ্ধিবৃত্তিক বন্ধ্যত্ব দেখা দেওয়ার আশঙ্কা রয়েছে। আর মানুষের মেধা, প্রতিভা ও মৌলিক চিন্তাভাবনা বিকাশের পথ রুদ্ধ হয়ে গেলে সৃজনশীলতার দুর্ভিক্ষ একটি জাতিগোষ্ঠীকে কীভাবে ও কতটা পঙ্গু করে দিতে পারে, তার জাজ্বল্যমান উদাহরণ এই বাংলাদেশেই রয়েছে।

কোনো প্রকার আদর্শিক ও দার্শনিক লক্ষ্য ছাড়াই বিচ্ছিন্ন চিন্তাভাবনার ভিত্তিতে পরিচালিত একটি চরম মানহীন গিনিপিগ শিক্ষাব্যবস্থার শিকারে পরিণত হওয়া এ দেশের শিক্ষার্থীদের মধ্য থেকে কেরানি বা ব্যবস্থাপক, হিসাবরক্ষক বা খাজাঞ্চি, বণিক অথবা উদ্যোক্তা, মন্ত্রী অথবা আমলা ইত্যাদি অনেক কিছুই তৈরি হচ্ছে। কিন্তু সে তুলনায় বিশ্বমানের বিজ্ঞানী, উদ্ভাবক বা আবিষ্কারক, দার্শনিক, সাহিত্যিক, দেশপ্রেমিক নেতা কিংবা দলনিরপেক্ষ দক্ষ দপ্তরকর্মী ইত্যাদি গড়ে ওঠার হার খুবই নগণ্য। ফলে দিনে দিনে এ দেশ একটি বৃহত্তর ভোক্তা সমাজে তথা অন্য দেশে উদ্ভাবিত পণ্যের একচ্ছত্র বাজারে পরিণত হচ্ছে।

আর এ অবস্থারই অনিবার্য ফল হিসেবে করোনা থেকে বাঁচার জন্য আমরা অন্যের উদ্ভাবিত টিকার অপেক্ষায় থাকি, দুরারোগ্য ব্যাধি থেকে নিরাময় পাওয়ার উদ্দেশ্যে অন্যের আবিষ্কৃত ওষুধ খুঁজি, শিল্পে ব্যবহারের জন্য অন্য দেশ থেকে যন্ত্রপাতি আমদানি করি, তথ্যপ্রযুক্তিভিত্তিক চতুর্থ শিল্পবিপ্লবের নাম করে মুখে ফেনা তুলি আর দিনরাত ফেসবুকের মতো সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমগুলোতে নেশায় বুঁদ হয়ে থেকে এ মাধ্যমের সমুদয় ও একচেটিয়া মুনাফা আটলান্টিক পাড়ের পশ্চিমি উদ্ভাবকদের হাতে তুলে দিই।

মোটকথা, আমরা আয় বাড়িয়ে ভোক্তা হতে চাই, আন্তর্জাতিক পণ্যের বাজার হয়ে নিজেদের বৈশ্বিক বলে প্রমাণ করতে চাই, এমনকি এরূপ অবাধ বাজারব্যবস্থার সুবাদে নিজ দেশের সম্পদ অন্য দেশে পাচার করে দিতেও অকুণ্ঠিত থাকি। কিন্তু কোনো অবস্থাতেই নিজেদের মেধা ও প্রতিভার বিকাশ ঘটানোর ব্যাপারে আগ্রহ দেখাই না বা সেই মর্যাদাবোধের জায়গাটিও জাতি হিসেবে আমরা গড়ে তুলতে পারিনি। বস্তুত সাম্রাজ্যবাদী উপনিবেশ থেকে এখন আমরা নয়া পুঁজিবাদী ঔপনিবেশিকতার যুগে প্রবেশ করেছি এবং সামনের দিনগুলোতে তা ক্রমান্বয়ে আরও জোরদার হবে বলেই ধারণা করা হচ্ছে। ওই যে আমাদের রাজনৈতিক বিষয়ের সিদ্ধান্ত বিদেশিরা গ্রহণ করছেন, সেটিও ওই মৌলিক চিন্তা বিকশিত না হওয়াজনিত দৈন্যতাপূর্ণ মানসিকতারই ফল।

অতএব বলতেই হয় যে কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা নিয়ে মূল সমস্যাটি কাজ হারানোজনিত নয়; বরং বাংলাদেশের জন্য মূল সমস্যা হচ্ছে এআইকে ঘিরে বিশ্বব্যাপী এর চেয়েও উন্নততর কাজের যে বিপুল সুযোগ তৈরি হতে যাচ্ছে, সেই সুযোগ ব্যবহারের জন্য নিজেদের প্রস্তুত করতে না পারা। আর তা না পারার জন্য যে কারণগুলো সর্বাধিক দায়ী তার মধ্যে একেবারে প্রথমেই রয়েছে চরম মানহীন একটি শিক্ষাব্যবস্থা, যার আওতায় শিক্ষার প্রচলিত ধাঁচের মান এবং ব্যতিক্রমী সৃজনশীলতা কোনোটির বিকাশই সম্ভব নয়। মেধা ও সৃজনশীলতার বিকাশ অবশ্য আন্তর্জাতিক পুঁজির মালিকানাকাঠামোর ধরনের কারণেও বিঘ্নিত হচ্ছে।

ওই যে এআই এখন সারা পৃথিবীর সব মানুষের করতলগত, তা সত্ত্বেও এর বাস্তব ব্যবহারের ক্ষমতা ও ব্যবহারজনিত ফলাফল এর কোনোটিই কি বিশ্বের অনগ্রসর দেশগুলোর সংখ্যাগরিষ্ঠ বিত্তহীন ও স্বল্পবিত্তের সাধারণ মানুষের আয়ত্তের মধ্যে ও স্বার্থের অনুকূলে রয়েছে বা নিকট ভবিষ্যতে তা থাকবে? মোটেও না।

বিষয়টিকে খানিকটা ব্যাখ্যা করা যাক। কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা রোবটসহ অন্য যে ধরনের প্রযুক্তির ওপর নির্ভরশীল, তা আহরণের জন্য প্রয়োজনীয় অর্থ ব্যয়ের সামর্থ্য এসব সাধারণ মানুষের প্রায় নেই বললেই চলে। ফলে নব উদ্ভাবিত এই প্রযুক্তি অবধারিতভাবেই নিয়ন্ত্রিত হবে বিত্তবান শ্রেণি দ্বারা; অর্থাৎ পুঁজি বা পুঁজিপতিরাই এর আহরণ ও ব্যবহারকে নিয়ন্ত্রণ করবেন।

দ্বিতীয়ত, তর্কের খাতিরে যদি ধরেও নেওয়া যায় যে অর্থনীতি শাস্ত্রের নানা তাত্ত্বিক হিসাবনিকাশের ফাঁকফোকর গলিয়ে এআই প্রযুক্তির অধিগ্রহণ ক্ষমতা স্বল্পবিত্তের সাধারণ মানুষের হাতেও থাকবে, তাহলেও প্রশ্ন থেকে যায়, কৃত্রিম বুদ্ধি সৃষ্টির জন্য তথ্য ও উপাত্তকে যাঁরা যন্ত্রে সন্নিবেশিত করবেন (প্রোগ্রামিং), তারা কি শ্রেণিনিরপেক্ষ? কখনোই না। ফলে সেখানে, অর্থাৎ প্রযুক্তি-প্রক্রিয়ায় তাঁরা যেসব তথ্য-উপাত্ত ব্যবহার করবেন, সেই সব খুব স্বাভাবিকভাবেই পুঁজির স্বার্থকেই রক্ষা করে চলবে। উদাহরণস্বরূপ, বিশ্বের অন্যতম বৃহৎ রোবট উৎপাদনকারী মার্কিন প্রতিষ্ঠান চ্যাটজিপিটিকে যখন জিজ্ঞেস করা হলো ইউক্রেন যুদ্ধের মূল দায় কার এবং এ ক্ষেত্রে ইইউ কতটুকু দায়ী, সে জবাব দিল ‘সাধারণ আন্তর্জাতিক ঐকমত্য অনুযায়ী’ রাশিয়াই এর জন্য দায়ী।

কিন্তু এ বক্তব্য কি ঠিক যে এটিই সাধারণ ঐকমত্য? তাহলে যে ইউক্রেন যুদ্ধ প্রশ্নে জাতিসংঘ সাধারণ পরিষদের ভোটাভুটিতে সিরিয়া-উত্তর কোরিয়াসহ ৪ দেশ রাশিয়ার পক্ষে ভোট দিল এবং চীন-ভারতসহ ৩৫ দেশ ভোটদান থেকে বিরত থাকল, সেটি কী? মোট ৩৯ দেশ কর্তৃক প্রস্তাব সমর্থন না করা সত্ত্বেও সেটি ঐকমত্য হয় কেমন করে? আর তার চেয়েও বড় কথা, চ্যাটজিপিটি যদি মার্কিন না হয়ে ইরানি প্রতিষ্ঠান হতো, তাহলে এর জবাবটি কি সম্পূর্ণ বিপরীত হতো না? অতএব এআইর জ্ঞান কখনোই শ্রেণিনিরপেক্ষ ও বস্তুনিষ্ঠ হয়ে উঠতে পারবে না; বরং বরাবরই তা কাজ করবে নির্মাতা প্রতিষ্ঠানের রাজনৈতিক মুখপাত্র হিসেবে।

লেখক: সাবেক পরিচালক, বিসিক, শিল্প মন্ত্রণালয়

Google News Icon

সর্বশেষ খবর পেতে Google News ফিড ফলো করুন

এলাকার খবর
খুঁজুন

পাঠকের আগ্রহ

সম্পর্কিত