Ajker Patrika

আন্ধারমানিক নদীতে খাঁচায় কোরাল মাছের চাষ

শাইখ সিরাজ
আন্ধারমানিক নদীতে খাঁচায় কোরাল মাছের চাষ

এশিয়া অঞ্চলে সি বাস (Sea bass) এবং অস্ট্রেলিয়ায় বারামুন্ডি নামে পরিচিত কোরাল মাছ আমাদের দেশে ভেটকি মাছ নামেও পরিচিত। স্বাদে-গন্ধে অতুলনীয় কোরাল মাছ ঝোল হোক কিংবা বারবিকিউ বা ভাজা, ফিশ সালাদ বা কাটলেট—এর স্বাদের জন্য রসনাবিলাসীদের কাছে রয়েছে বেশ কদর। মজাদার এই মাছ পাওয়া যায় দেশের দক্ষিণাঞ্চলের উপকূলীয় এলাকার সাগরসংলগ্ন নদ-নদীর মতো জলাশয়গুলোতে। জোয়ারের স্রোতে এসব এলাকার মাছের ঘেরগুলোতেও চলে আসে ভেটকি বা কোরাল। লোনাপানির এই মাছ এখন মিঠাপানিতেও চাষ সম্ভব হচ্ছে। এমনকি পুকুরেও বিশেষ প্রক্রিয়ায় এই মাছ চাষ করা যাবে।

সাধারণত উষ্ণমণ্ডলীয় অঞ্চল, বিশেষ করে পশ্চিম প্রশান্ত মহাসাগর ও ভারত মহাসাগরীয় অঞ্চলে দেখা মেলে কোরালের। এ ছাড়া এশিয়ার উত্তরাঞ্চল, কুইন্সল্যান্ডের দক্ষিণাঞ্চল এবং পূর্ব আফ্রিকার পশ্চিমাঞ্চলেও এদের দেখা যায়। প্রায় ৪০ বছর আগে থাইল্যান্ড, মালয়েশিয়া, সিঙ্গাপুর, ইন্দোনেশিয়া, হংকং, অস্ট্রেলিয়া ও তাইওয়ানের উপকূলীয় অঞ্চলে এবং স্বাদুপানির পুকুরে, নদীতে ও নদীর মোহনায় ভেটকির চাষাবাদ খাঁচার মাধ্যমে শুরু হয়। বাংলাদেশ মৎস্য গবেষণা ইনস্টিটিউট আন্ধারমানিক নদীতে খাঁচায় কোরাল মাছ চাষের পরীক্ষামূলক কার্যক্রম শুরু করেছে।

গত নভেম্বরে পটুয়াখালীর খেপুপাড়ায় বিএফআরআইয়ের আন্ধারমানিক নদীতে খাঁচায় মাছ চাষের প্রকল্প দেখতে গিয়েছিলাম। সে সময় শীত সবে পড়তে শুরু করেছে। নরম রোদের শেষ বিকেলে নদীতীর থেকে নৌকায় করে আমরা নদীর মাঝে তৈরি খাঁচার কাছে পৌঁছালাম। নদীতে বিকেলের রোদ চিক চিক করে সোনারং ছড়াচ্ছিল। সে এক অপরূপ দৃশ্য।

যা-ই হোক, স্রোতস্বিনী নদীতে জালের খাঁচা স্থাপন করে তার মধ্যে মাছ চাষ পৃথিবীর ইতিহাসে প্রায় ৭০০ বছরের পুরোনো এক চর্চা। ইতিহাস বলে, চীনেই প্রথম ১৩০০ শতাব্দীতে ছোট খাঁচায় বেশি ঘনত্বে মাছ চাষ শুরু হয়েছিল ইয়াংঝি নদীতে। আমাদের দেশেও বিভিন্ন নদীতে অনেক আগ থেকেই কম-বেশি খাঁচায় মাছ চাষের নজির রয়েছে। এ দেশে খাঁচায় মাছ চাষের গোড়াপত্তন ঘটে গত শতকের সত্তরের দশকে কাপ্তাই লেকে। নব্বইয়ের দশকের প্রথম দিকে বাংলাদেশ টেলিভিশনের ‘মাটি ও মানুষ’ অনুষ্ঠানে তুলে ধরেছিলাম গাজীপুরের কালীগঞ্জের বালু নদে খাঁচায় মাছ চাষের উদ্যোগ নিয়ে প্রতিবেদন। যেসব নদীতে খাঁচায় মাছ চাষ সফল, এর একটি হচ্ছে চাঁদপুরের ডাকাতিয়া।

আন্ধারমানিক নদীতে খাঁচায় কোরাল মাছ চাষ নিয়ে কথা হলো বাংলাদেশ মৎস্য গবেষণা ইনস্টিটিউটের বৈজ্ঞানিক কর্মকর্তাদের সঙ্গে। প্রধান বৈজ্ঞানিক কর্মকর্তা আমিরুল ইসলাম জানালেন, উপকূলবর্তী এলাকা সাধারণত দুর্যোগপ্রবণ। কর্মসংস্থান কম হওয়ায় এসব এলাকার মানুষ তুলনামূলক বেশি অভাবগ্রস্ত। নদীতে খাঁচায় মাছ চাষকে নতুন কর্মসংস্থানের ক্ষেত্র হিসেবে নেওয়া যেতে পারে। খাঁচায় কোরাল মাছ চাষের ক্ষেত্রে তাঁরা খুব আশাবাদী, কারণ কোরালের পোনার মৃত্যুহার খুবই কম। খাঁচায় ছাড়া পোনাগুলোর বৃদ্ধিও অনেক ভালো। কোরাল যেহেতু মাংসাশী, তাদের পছন্দ অনুযায়ী জীবন্ত খাবারও দেওয়া হচ্ছে। নদীর পানি প্রবহমান হওয়ায় খাঁচার পানির গুণাগুণও ভালো থাকে।

ঊর্ধ্বতন বৈজ্ঞানিক কর্মকর্তা অভিজিৎ বসু পুরোটাই ঘুরিয়ে দেখালেন। নদীতে বেশ বড় বড় ছয়টি খাঁচা। তিনি বললেন, একেক খাঁচায় একেক ঘনত্বে কোরাল মাছ চাষ হচ্ছে। ঘনত্বের মাত্রা হচ্ছে এক, দেড় ও দুই। যে ঘনত্বে মাছ বেশি বর্ধনশীল হবে, সেটাকে নেওয়া হবে আদর্শ হিসেবে।

ভেটকি বা কোরাল লবণাক্ততাসহিষ্ণু হওয়ায় নদী, নদীর মোহনা এবং উপকূলীয় এলাকার জলাভূমিতে সহজে চাষ করা যায়। ভেটকি মাছ সাধারণত সারা বছর ডিম দেয়। তবে এপ্রিল থেকে আগস্ট মাস এদের মূল প্রজননকাল। এ সময় এক সেন্টিমিটার আকারের অনেক পোনা ধরা পড়ে। বর্ষার শুরুতে পুরুষ ভেটকি স্ত্রী ভেটকির সঙ্গে মিলনের জন্য নদ-নদীর নিম্ন অববাহিকায় আসে। ভরা পূর্ণিমা এবং অমাবস্যার শুরুতে জোয়ারের পানি আসার সময় ৫ থেকে ১০ কেজি ওজনের প্রতিটি স্ত্রী ভেটকি ২১ লাখ থেকে ৭১ লাখ পর্যন্ত ডিম পাড়ে। সে সময় বাগেরহাট এলাকার চাষিরা পোনা সংগ্রহ করে ভেটকির চাষ করেন। তবে বাংলাদেশ মৎস্য গবেষণা ইনস্টিটিউট ভেটকি মাছের কৃত্রিম প্রজননের মাধ্যমে পোনা উৎপাদনের কাজ করছে। এ নিয়েও তারা বেশ আশাবাদী।

কোরাল মাছ বেশ পুষ্টিসমৃদ্ধ। কোরাল মাছে উন্নতমানের আমিষ ওমেগা-৩ ও ওমেগা-৬ ফ্যাটি অ্যাসিড থাকে। এটা আমাদের শরীরের রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা বাড়ায়, হৃদ্‌রোগের ঝুঁকি কমায় এবং রক্তের চাপ নিয়ন্ত্রণে রাখতে সাহায্য করে। কোরাল বা ভেটকিতে ভিটামিন এ, বি ও ডি, খনিজ পদার্থ ক্যালসিয়াম, জিংক, লৌহ, পটাশিয়াম, ম্যাগনেসিয়াম এবং সিলেনিয়াম যথেষ্ট পরিমাণে থাকে। এগুলো শরীর গঠন ও বৃদ্ধির কাজে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখে।

দীর্ঘদিন ধরে কক্সবাজার, চট্টগ্রাম, সাতক্ষীরা, খুলনা, বাগেরহাটসহ দেশের উপকূলীয় অঞ্চলে ঘেরের মধ্যে চিংড়ির সঙ্গে কোরাল মাছেরও কিছুটা চাষ হয়ে আসছে। কোরাল মাছ লবণাক্ত, আধা লবণাক্ত, এমনকি স্বাদুপানিতেও চাষ করা যায়। এই মাছের রোগবালাই কম বলে সাম্প্রতিককালে অনেকেই চিংড়ির চাষ বাদ দিয়ে কোরাল চাষে নেমেছেন। বিএফআরআই কৃত্রিম প্রজননের মাধ্যমে কোরাল মাছের পোনা উৎপাদন সম্ভব করেছে। কোরাল বা ভেটকির প্রজননক্ষমতা বেশি, বছরে ৬০ থেকে ৭০ লাখ ডিম দেয়। এতে কোরালের চাষের ক্ষেত্র হচ্ছে সম্প্রসারিত।

বাংলাদেশ মৎস্য গবেষণা ইনস্টিটিউটের মহাপরিচালক ইয়াহিয়া মাহমুদের সঙ্গে কথা হয় দেশে কোরাল মাছ চাষের সম্ভাবনা নিয়ে। তিনি বলেন, উপকূলবর্তী নদীগুলোতে খাঁচায় কোরাল মাছের চাষ ব্লু-ইকোনমির একটি গুরুত্বপূর্ণ অংশ হিসেবে সম্প্রসারিত হতে পারে; বিশেষ করে বাইরের দেশে এই মাছের জনপ্রিয়তা আছে। কোরাল বা ভেটকি যেমন রপ্তানি করা যেতে পারে, তেমনি এই মাছের উৎপাদন বৃদ্ধি দেশের মাছের মোট উৎপাদনকে বাড়াবে, পুষ্টির চাহিদা পূরণে বিশেষ গুরুত্ব রাখতে পারে।

কোরাল মাছ সুস্বাদ আর কাঁটা কম থাকায় দেশে-বিদেশে এর চাহিদা প্রচুর। মাছে কাঁটা থাকায় তরুণদের কাছে মুরগি ও গরু-ছাগলের মাংসই বেশি প্রিয়। সে ক্ষেত্রে কাঁটা কম থাকায় তরুণদের কাছে এই মাছের বিশেষ চাহিদা তৈরি হয়েছে। বছর তিনেক আগেও ঢাকার তিন শ ফুট এলাকায় অনেক খাবার দোকানে কোরাল মাছের বারবিকিউ পাওয়া যেত। এই মাছ খেতে সেখানে তরুণদের ভিড় দেখেছি। তাই কোরাল উৎপাদন ও রপ্তানির যথেষ্ট সুযোগ রয়েছে। আমাদের স্বাস্থ্যকর ভবিষ্যৎ রচনায় টেকসই সুনীল অর্থনীতি ও শক্তিশালী কর্মসংস্থানের ব্যবস্থা দিতে পারে এই কোরাল মাছের চাষ সম্প্রসারণ। ব্লু-ইকোনমির একটি গুরুত্বপূর্ণ অংশ হিসেবে কোরাল মাছের চাষ জনপ্রিয় হয়ে উঠবে। 

লেখক: পরিচালক ও বার্তাপ্রধান, চ্যানেল আই

Google News Icon

সর্বশেষ খবর পেতে Google News ফিড ফলো করুন

এলাকার খবর
খুঁজুন

পাঠকের আগ্রহ

সম্পর্কিত