চিররঞ্জন সরকার
নেতা-কর্মীদের ভার বহন করতে না পারায় এর আগে ভেঙে পড়েছিল আওয়ামী লীগের মঞ্চ। আর এবার ভেঙে পড়ল বিএনপির মঞ্চ। ২২ জুলাই রাজধানীর সোহরাওয়ার্দী উদ্যানে বিএনপির তিন ছাত্র-যুব সংগঠন ছাত্রদল, যুবদল ও স্বেচ্ছাসেবক দল আয়োজিত ‘দেশ বাঁচাতে তারুণ্যের সমাবেশ’-এর মঞ্চ নেতা-কর্মীদের ভারে ভেঙে পড়েছে। প্রচারসর্বস্ব নেতার ভারে মঞ্চ ভেঙে পড়াটা খুব স্বাভাবিক হলেও তাৎপর্যপূর্ণ। এ প্রসঙ্গে মনে পড়ছে একটি উপন্যাসের কথা।
১৯৯৫ সালের ফেব্রুয়ারির বইমেলায় লেখক হুমায়ুন আজাদের একটি উপন্যাস প্রকাশিত হয়েছিল। উপন্যাসের নাম ‘সবকিছু ভেঙে পড়ে’। এই উপন্যাসের প্রধান চরিত্র মাহবুব পেশায় একজন প্রকৌশলী, যিনি সেতু নির্মাণ করেন। কাঠামো-নির্মাণ পেশার অভিজ্ঞতার সঙ্গে ব্যক্তিগত জীবনের পারস্পরিক মিল খুঁজে পান মাহবুব। ফলে জাগতিক বস্তুগত, অবস্তুগত এবং মনস্তাত্ত্বিক বিষয়াদি তাঁর কাছে সমার্থক হয়ে দেখা দেয়। তাঁর দৃষ্টিতে নারী-পুরুষের সম্পর্ক একটি কাঠামো, যার কাজ ভার বহন করা। কিন্তু এই সম্পর্ক লোভ-মোহ-কাম বা প্রবৃত্তির দ্বারা পরিচালিত হতে হতে কাঠামোটি ভার বহন করতে না পেরে একসময় ভেঙে পড়ে। তখন জীবনের সবকিছুই ভেঙে পড়ে।
এই উপন্যাসের নামটি খুবই তাৎপর্যপূর্ণ; বিশেষ করে আমাদের দেশের সমাজ বাস্তবতায়। সম্পর্ক তো বটেই, আমাদের দেশে নির্ভর করার মতো, আশাবাদী হওয়ার মতো অনেক কিছুই ভেঙে পড়ে, ভেঙে পড়ছে। নীতি-নৈতিকতা-মূল্যবোধের পাশাপাশি আমাদের দেশে সুস্থ রাজনৈতিক চর্চাও ক্রমে ভেঙে পড়ছে। বুলিসর্বস্ব দেখানদার নেতার ভারে মঞ্চ ভেঙে পড়া সামগ্রিক অবক্ষয়েরই একটি ক্ষুদ্র বহিঃপ্রকাশ।
এ বছরের জানুয়ারিতে আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক ওবায়দুল কাদের ছাত্রলীগের অনুষ্ঠানে বক্তৃতা করার সময় মঞ্চ ভেঙে পড়েছিল। মঞ্চ কতটা শক্ত করে তৈরি হয়েছিল, সেই প্রশ্নের পাশাপাশি প্রশ্ন উঠেছিল, মঞ্চে এত নেতা ওঠার প্রয়োজনীয়তা নিয়ে। ক্ষুব্ধ ওবায়দুল কাদেরকে বলতে শোনা যায়, এত লোকের মঞ্চে ওঠা কী দরকার! নেতার ভার বেচারা মঞ্চ নিতে পারেনি। এটা নিয়ে ওবায়দুল কাদেরকে কম ট্রলের শিকার হতে হয়নি।
বিএনপি আয়োজিত তরুণ সমাবেশে আবার মঞ্চ ভেঙে পড়ার ঘটনা ঘটেছে। এবারও নেতার ভার বহনে মঞ্চ অক্ষম হওয়ায় তা ভেঙেছে। এত বড় একটা ঘটনা ঘটার পরও বিএনপির নেতারা এবার ক্ষমতাসীনদের ওপর দায় চাপাননি। এটা বিস্ময়কর। অতীতের ধারাবাহিকতা মেনে আশা করা হয়েছিল যে দলটির মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর বলবেন, এই মঞ্চ ভেঙে পড়া ক্ষমতাসীনদের ষড়যন্ত্রেরই বহিঃপ্রকাশ। বিএনপি যাতে আন্দোলন জোরদার করতে না পারে, সে জন্য সরকারি বাহিনী দিয়ে মঞ্চে বেশি নেতা উঠিয়ে দেওয়া হয়েছে। এটা ফ্যাসিবাদী সরকারেরই একটা কূটচাল। কিন্তু তিনি তা বলেননি। কোনো নেতাই মঞ্চ ভেঙে পড়ার দায় ক্ষমতাসীনদের ওপর চাপাননি। বাংলাদেশের রাজনীতিতে এটা একটা বিরল ঘটনা।
যা-ই হোক, যা ঘটেনি, তা নিয়ে আক্ষেপ না করে বরং সন্তোষ প্রকাশ করা দরকার। সমস্যা হলো, আমাদের দেশে নেতাদের মধ্যে কোনো বোধোদয় কখনো ঘটে না। রাজনীতিতে কর্মীদের অংশগ্রহণ কমছে। ত্যাগী নেতা যেমন সৃষ্টি হচ্ছে না, ত্যাগী কর্মীও সৃষ্টি হচ্ছে না। এখন বরং যেনতেন প্রকারে সবাই নেতা হতে চায়। সবাই মঞ্চে উঠতে চায়। সবাই সামনে থাকতে চায়। সবাই বক্তৃতা দিতে চায়। সবাই নিজের চেহারা দেখাতে চায়, ছবি ও ভিডিও তুলতে চায়। তাই তো এখন রাজনৈতিক দলের মিছিলগুলোর চেহারা ‘আগা মোটা গোড়া চিকন!’ মঞ্চ পেলে সবাই সেখানে উঠে পড়তে চায়। কেউ কাউকে নেতা মানে না। নিজেকে সবাই বড় নেতা মনে করে। আর কোনো উৎসব-অনুষ্ঠান-সমাবেশ হলে তো কথাই নেই। যেখানে ছবি তুলে সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে দেওয়ার সুযোগ আছে বা যেখানে দেশের অসংখ্য টেলিভিশন চ্যানেলের কোনোটিতে একটুখানি মুখ দেখানোর সামান্য সম্ভাবনা আছে, সেখানে সবার মধ্যে একটা প্রতিযোগিতা লেগে যায়। যদি আরও বড় নেতারা একটু দেখেন এবং এমপি পদে না দিলেও কমপক্ষে পৌরসভার কমিশনার পদে যদি মনোনয়নটা জোটে। নিদেনপক্ষে কমিটির কোনো পদে এসে এলাকায় বখরা আদায়ের সুযোগটা পাওয়া যায়!
সে হিসেবে দেখলে দেশে নেতার কোনো অভাব থাকার কথা নয়! কিন্তু বাস্তবে আমরা কী দেখি? কোথাও একটা অগ্নিকাণ্ডের ঘটনা ঘটলেও তা নেভানোর জন্য প্রধানমন্ত্রীর নির্দেশের জন্য অপেক্ষা করতে হয়। লন্ডন থেকে ভার্চুয়াল নির্দেশনা না এলে বিএনপির ওয়ার্ড কমিটিও গঠিত হয় না। তাহলে মঞ্চ দখলকারী এত সব নেতা কারা? কেন তাদের মঞ্চে উঠে ভার বাড়াতে হয়? মঞ্চ ভেঙে পড়ার কলঙ্ক নিয়ে সমাবেশ করতে হয়?
আসলে আমাদের দেশে প্রকৃত নেতা ও নেতৃত্ব না থাকলেও, সুস্থ ধারার রাজনীতি ও গণতন্ত্রের চর্চা না থাকলেও রাজনৈতিক দল, জোট ও নেতার কোনো অভাব নেই। ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগের সঙ্গে আছে ১৪-দলীয় জোট। এই জোটের দু-তিনটি ছাড়া বাকিগুলো নামসর্বস্ব। যাদের সারা দেশে এক হাজার সমর্থক খুঁজে পাওয়া যাবে কি না, সন্দেহ! ওদিকে সরকারবিরোধী অবস্থানে থাকা দলগুলোর অবস্থা আরও শোচনীয়। চলমান সরকারবিরোধী আন্দোলনে বিএনপির সঙ্গে ঐক্যবদ্ধ হয়েছে সমমনা ৩২টি রাজনৈতিক দল। গঠিত হয়েছে আলাদা তিনটি রাজনৈতিক জোট। নির্বাচনকালীন তত্ত্বাবধায়ক সরকারের দাবিতে এসব দলকে নিয়ে বিএনপি নানা কর্মসূচি পালন করছে। এসব অনুষ্ঠানে নামহীন-গোত্রহীন অসংখ্য নেতা কিলবিল করে। সভা-সমাবেশে ও মঞ্চে এখন কর্মীর চেয়ে নেতার সংখ্যা বেশি। অধিক নেতার ভার বহন করতে না পেরে মঞ্চ ভেঙে পড়ছে। তবু দেশ উদ্ধার হচ্ছে না, মানুষের দুর্দশা কমছে না; অর্থাৎ দলগুলোতে গন্ডা-গন্ডা নেতা পয়দা হলেও তাদের কেউ জননেতা হতে পারছে না। এটা আমাদের জন্য চরম দুর্ভাগ্যের।
হ্যাঁ, দল পরিচালনা কিংবা দেশ পরিচালনার জন্য যোগ্য নেতার প্রয়োজন হয়। শুধু দল বা দেশ কেন, যেকোনো উদ্যোগ বা কর্মে, যেকোনো প্রতিষ্ঠান পরিচালনা করতে গেলেই নেতার দরকার হয়। নেতা ছাড়া কোনো কাজ সুষ্ঠুভাবে করা যায় না। কাঙ্ক্ষিত সাফল্য আসে না। যোগ্য নেতৃত্ব ছাড়া কোনো কাজ করা মানে হচ্ছে: ছাগল দিয়ে ধান পাড়ানো। এতে কাজের কাজ কিছু হয় না। আমাদের দেশে অন্য অনেক ক্ষেত্রে নেতার অভাব না থাকলেও রাজনীতিতে যোগ্য নেতার অভাব লক্ষ করা যায়।
আজকের নেতারা নীতির চর্চা করেন না। তাই তো জাতি আজ নৈতিকতাহীন ও মেধাশূন্য হয়ে পড়ছে। তাঁরা তাঁদের লাভের আশায় দেশের বারোটা বাজাতে একটুও চিন্তা করেন না। চাঁদাবাজ, টেন্ডারবাজ, খুনি, ছিনতাইকারী, মাদক ব্যবসায়ীরা যখন সমাজের নেতৃত্বে আসেন, তখন তাঁরা মানুষের জন্য কী করবেন? ধান্দাবাজদের নেতৃত্বে সমাজ কখনোই এগিয়ে যাবে না।
অনেকে জাল-জালিয়াতির মাধ্যমে ব্যাংকের টাকা মেরে, ভূমি দখল করে, চুক্তিবদ্ধ খুন অথবা গুম করিয়ে নিজেকে প্রতিষ্ঠিত করেন। অনেকে মাদক ও সোনার চোরাচালানি করেন। অনেকে আবার চাঁদাবাজির মাধ্যমে জোঁকের মতো রক্ত শোষণ করেন। দেশের স্বার্থে, জনকল্যাণে, মানবতার স্বার্থে সমাজে শান্তিশৃঙ্খলা ও আইনের শাসন বজায় রাখার জন্য কোনটি উচিত আর কোনটি অনুচিত, এ সিদ্ধান্ত নেওয়ার দায়িত্ব নেতাদের হলেও তাঁরা সে কাজটি করেন না।
এ কথা ঠিক যে আমাদের দেশে অনেক নেতা আছেন। কিন্তু যোগ্য নেতা কি আছেন? যাঁরা লড়তে জানেন, জনকল্যাণে নিজের জীবনকে উৎসর্গ করতে প্রস্তুত, যাঁরা সঠিক সময়ে, সঠিক সিদ্ধান্ত নিতে পারেন, যাঁরা ঘুষ-দুর্নীতি-লোভ-মোহের ঊর্ধ্বে উঠে সব মানুষকে উদ্বুদ্ধ করতে পারেন। তেমন নেতা কি সত্যিই আমাদের সমাজে আছে? তৈরি হচ্ছে? আমাদের পরিবারে, প্রতিষ্ঠানে, সমাজে, রাজনৈতিক দলে তেমন নেতৃত্ব বিকাশের পথ কি আছে?
বিখ্যাত নাট্যকার ব্রেটল্ট ব্রেশটের ‘গ্যালিলিওর জীবনী’ নাটকে গ্যালিলিওর এক শিক্ষার্থী আন্দ্রিয়া বলেছেন, ‘দুর্ভাগা সেই দেশ, যাদের কোনো নেতা নেই।’ উত্তরে গ্যালিলিও বলেন, ‘না, দুর্ভাগা সেই দেশ, যারা কেবল নেতারই প্রয়োজন অনুভব করে।’
হ্যাঁ, আমরা সত্যিই দুর্ভাগা যে আমাদের দেশে যোগ্য নেতার অভাব রয়েছে। আমরা আরও বেশি দুর্ভাগা যে আমরা কেবল নেতারই প্রয়োজন অনুভব করি!
লেখক: গবেষক ও কলামিস্ট
নেতা-কর্মীদের ভার বহন করতে না পারায় এর আগে ভেঙে পড়েছিল আওয়ামী লীগের মঞ্চ। আর এবার ভেঙে পড়ল বিএনপির মঞ্চ। ২২ জুলাই রাজধানীর সোহরাওয়ার্দী উদ্যানে বিএনপির তিন ছাত্র-যুব সংগঠন ছাত্রদল, যুবদল ও স্বেচ্ছাসেবক দল আয়োজিত ‘দেশ বাঁচাতে তারুণ্যের সমাবেশ’-এর মঞ্চ নেতা-কর্মীদের ভারে ভেঙে পড়েছে। প্রচারসর্বস্ব নেতার ভারে মঞ্চ ভেঙে পড়াটা খুব স্বাভাবিক হলেও তাৎপর্যপূর্ণ। এ প্রসঙ্গে মনে পড়ছে একটি উপন্যাসের কথা।
১৯৯৫ সালের ফেব্রুয়ারির বইমেলায় লেখক হুমায়ুন আজাদের একটি উপন্যাস প্রকাশিত হয়েছিল। উপন্যাসের নাম ‘সবকিছু ভেঙে পড়ে’। এই উপন্যাসের প্রধান চরিত্র মাহবুব পেশায় একজন প্রকৌশলী, যিনি সেতু নির্মাণ করেন। কাঠামো-নির্মাণ পেশার অভিজ্ঞতার সঙ্গে ব্যক্তিগত জীবনের পারস্পরিক মিল খুঁজে পান মাহবুব। ফলে জাগতিক বস্তুগত, অবস্তুগত এবং মনস্তাত্ত্বিক বিষয়াদি তাঁর কাছে সমার্থক হয়ে দেখা দেয়। তাঁর দৃষ্টিতে নারী-পুরুষের সম্পর্ক একটি কাঠামো, যার কাজ ভার বহন করা। কিন্তু এই সম্পর্ক লোভ-মোহ-কাম বা প্রবৃত্তির দ্বারা পরিচালিত হতে হতে কাঠামোটি ভার বহন করতে না পেরে একসময় ভেঙে পড়ে। তখন জীবনের সবকিছুই ভেঙে পড়ে।
এই উপন্যাসের নামটি খুবই তাৎপর্যপূর্ণ; বিশেষ করে আমাদের দেশের সমাজ বাস্তবতায়। সম্পর্ক তো বটেই, আমাদের দেশে নির্ভর করার মতো, আশাবাদী হওয়ার মতো অনেক কিছুই ভেঙে পড়ে, ভেঙে পড়ছে। নীতি-নৈতিকতা-মূল্যবোধের পাশাপাশি আমাদের দেশে সুস্থ রাজনৈতিক চর্চাও ক্রমে ভেঙে পড়ছে। বুলিসর্বস্ব দেখানদার নেতার ভারে মঞ্চ ভেঙে পড়া সামগ্রিক অবক্ষয়েরই একটি ক্ষুদ্র বহিঃপ্রকাশ।
এ বছরের জানুয়ারিতে আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক ওবায়দুল কাদের ছাত্রলীগের অনুষ্ঠানে বক্তৃতা করার সময় মঞ্চ ভেঙে পড়েছিল। মঞ্চ কতটা শক্ত করে তৈরি হয়েছিল, সেই প্রশ্নের পাশাপাশি প্রশ্ন উঠেছিল, মঞ্চে এত নেতা ওঠার প্রয়োজনীয়তা নিয়ে। ক্ষুব্ধ ওবায়দুল কাদেরকে বলতে শোনা যায়, এত লোকের মঞ্চে ওঠা কী দরকার! নেতার ভার বেচারা মঞ্চ নিতে পারেনি। এটা নিয়ে ওবায়দুল কাদেরকে কম ট্রলের শিকার হতে হয়নি।
বিএনপি আয়োজিত তরুণ সমাবেশে আবার মঞ্চ ভেঙে পড়ার ঘটনা ঘটেছে। এবারও নেতার ভার বহনে মঞ্চ অক্ষম হওয়ায় তা ভেঙেছে। এত বড় একটা ঘটনা ঘটার পরও বিএনপির নেতারা এবার ক্ষমতাসীনদের ওপর দায় চাপাননি। এটা বিস্ময়কর। অতীতের ধারাবাহিকতা মেনে আশা করা হয়েছিল যে দলটির মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর বলবেন, এই মঞ্চ ভেঙে পড়া ক্ষমতাসীনদের ষড়যন্ত্রেরই বহিঃপ্রকাশ। বিএনপি যাতে আন্দোলন জোরদার করতে না পারে, সে জন্য সরকারি বাহিনী দিয়ে মঞ্চে বেশি নেতা উঠিয়ে দেওয়া হয়েছে। এটা ফ্যাসিবাদী সরকারেরই একটা কূটচাল। কিন্তু তিনি তা বলেননি। কোনো নেতাই মঞ্চ ভেঙে পড়ার দায় ক্ষমতাসীনদের ওপর চাপাননি। বাংলাদেশের রাজনীতিতে এটা একটা বিরল ঘটনা।
যা-ই হোক, যা ঘটেনি, তা নিয়ে আক্ষেপ না করে বরং সন্তোষ প্রকাশ করা দরকার। সমস্যা হলো, আমাদের দেশে নেতাদের মধ্যে কোনো বোধোদয় কখনো ঘটে না। রাজনীতিতে কর্মীদের অংশগ্রহণ কমছে। ত্যাগী নেতা যেমন সৃষ্টি হচ্ছে না, ত্যাগী কর্মীও সৃষ্টি হচ্ছে না। এখন বরং যেনতেন প্রকারে সবাই নেতা হতে চায়। সবাই মঞ্চে উঠতে চায়। সবাই সামনে থাকতে চায়। সবাই বক্তৃতা দিতে চায়। সবাই নিজের চেহারা দেখাতে চায়, ছবি ও ভিডিও তুলতে চায়। তাই তো এখন রাজনৈতিক দলের মিছিলগুলোর চেহারা ‘আগা মোটা গোড়া চিকন!’ মঞ্চ পেলে সবাই সেখানে উঠে পড়তে চায়। কেউ কাউকে নেতা মানে না। নিজেকে সবাই বড় নেতা মনে করে। আর কোনো উৎসব-অনুষ্ঠান-সমাবেশ হলে তো কথাই নেই। যেখানে ছবি তুলে সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে দেওয়ার সুযোগ আছে বা যেখানে দেশের অসংখ্য টেলিভিশন চ্যানেলের কোনোটিতে একটুখানি মুখ দেখানোর সামান্য সম্ভাবনা আছে, সেখানে সবার মধ্যে একটা প্রতিযোগিতা লেগে যায়। যদি আরও বড় নেতারা একটু দেখেন এবং এমপি পদে না দিলেও কমপক্ষে পৌরসভার কমিশনার পদে যদি মনোনয়নটা জোটে। নিদেনপক্ষে কমিটির কোনো পদে এসে এলাকায় বখরা আদায়ের সুযোগটা পাওয়া যায়!
সে হিসেবে দেখলে দেশে নেতার কোনো অভাব থাকার কথা নয়! কিন্তু বাস্তবে আমরা কী দেখি? কোথাও একটা অগ্নিকাণ্ডের ঘটনা ঘটলেও তা নেভানোর জন্য প্রধানমন্ত্রীর নির্দেশের জন্য অপেক্ষা করতে হয়। লন্ডন থেকে ভার্চুয়াল নির্দেশনা না এলে বিএনপির ওয়ার্ড কমিটিও গঠিত হয় না। তাহলে মঞ্চ দখলকারী এত সব নেতা কারা? কেন তাদের মঞ্চে উঠে ভার বাড়াতে হয়? মঞ্চ ভেঙে পড়ার কলঙ্ক নিয়ে সমাবেশ করতে হয়?
আসলে আমাদের দেশে প্রকৃত নেতা ও নেতৃত্ব না থাকলেও, সুস্থ ধারার রাজনীতি ও গণতন্ত্রের চর্চা না থাকলেও রাজনৈতিক দল, জোট ও নেতার কোনো অভাব নেই। ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগের সঙ্গে আছে ১৪-দলীয় জোট। এই জোটের দু-তিনটি ছাড়া বাকিগুলো নামসর্বস্ব। যাদের সারা দেশে এক হাজার সমর্থক খুঁজে পাওয়া যাবে কি না, সন্দেহ! ওদিকে সরকারবিরোধী অবস্থানে থাকা দলগুলোর অবস্থা আরও শোচনীয়। চলমান সরকারবিরোধী আন্দোলনে বিএনপির সঙ্গে ঐক্যবদ্ধ হয়েছে সমমনা ৩২টি রাজনৈতিক দল। গঠিত হয়েছে আলাদা তিনটি রাজনৈতিক জোট। নির্বাচনকালীন তত্ত্বাবধায়ক সরকারের দাবিতে এসব দলকে নিয়ে বিএনপি নানা কর্মসূচি পালন করছে। এসব অনুষ্ঠানে নামহীন-গোত্রহীন অসংখ্য নেতা কিলবিল করে। সভা-সমাবেশে ও মঞ্চে এখন কর্মীর চেয়ে নেতার সংখ্যা বেশি। অধিক নেতার ভার বহন করতে না পেরে মঞ্চ ভেঙে পড়ছে। তবু দেশ উদ্ধার হচ্ছে না, মানুষের দুর্দশা কমছে না; অর্থাৎ দলগুলোতে গন্ডা-গন্ডা নেতা পয়দা হলেও তাদের কেউ জননেতা হতে পারছে না। এটা আমাদের জন্য চরম দুর্ভাগ্যের।
হ্যাঁ, দল পরিচালনা কিংবা দেশ পরিচালনার জন্য যোগ্য নেতার প্রয়োজন হয়। শুধু দল বা দেশ কেন, যেকোনো উদ্যোগ বা কর্মে, যেকোনো প্রতিষ্ঠান পরিচালনা করতে গেলেই নেতার দরকার হয়। নেতা ছাড়া কোনো কাজ সুষ্ঠুভাবে করা যায় না। কাঙ্ক্ষিত সাফল্য আসে না। যোগ্য নেতৃত্ব ছাড়া কোনো কাজ করা মানে হচ্ছে: ছাগল দিয়ে ধান পাড়ানো। এতে কাজের কাজ কিছু হয় না। আমাদের দেশে অন্য অনেক ক্ষেত্রে নেতার অভাব না থাকলেও রাজনীতিতে যোগ্য নেতার অভাব লক্ষ করা যায়।
আজকের নেতারা নীতির চর্চা করেন না। তাই তো জাতি আজ নৈতিকতাহীন ও মেধাশূন্য হয়ে পড়ছে। তাঁরা তাঁদের লাভের আশায় দেশের বারোটা বাজাতে একটুও চিন্তা করেন না। চাঁদাবাজ, টেন্ডারবাজ, খুনি, ছিনতাইকারী, মাদক ব্যবসায়ীরা যখন সমাজের নেতৃত্বে আসেন, তখন তাঁরা মানুষের জন্য কী করবেন? ধান্দাবাজদের নেতৃত্বে সমাজ কখনোই এগিয়ে যাবে না।
অনেকে জাল-জালিয়াতির মাধ্যমে ব্যাংকের টাকা মেরে, ভূমি দখল করে, চুক্তিবদ্ধ খুন অথবা গুম করিয়ে নিজেকে প্রতিষ্ঠিত করেন। অনেকে মাদক ও সোনার চোরাচালানি করেন। অনেকে আবার চাঁদাবাজির মাধ্যমে জোঁকের মতো রক্ত শোষণ করেন। দেশের স্বার্থে, জনকল্যাণে, মানবতার স্বার্থে সমাজে শান্তিশৃঙ্খলা ও আইনের শাসন বজায় রাখার জন্য কোনটি উচিত আর কোনটি অনুচিত, এ সিদ্ধান্ত নেওয়ার দায়িত্ব নেতাদের হলেও তাঁরা সে কাজটি করেন না।
এ কথা ঠিক যে আমাদের দেশে অনেক নেতা আছেন। কিন্তু যোগ্য নেতা কি আছেন? যাঁরা লড়তে জানেন, জনকল্যাণে নিজের জীবনকে উৎসর্গ করতে প্রস্তুত, যাঁরা সঠিক সময়ে, সঠিক সিদ্ধান্ত নিতে পারেন, যাঁরা ঘুষ-দুর্নীতি-লোভ-মোহের ঊর্ধ্বে উঠে সব মানুষকে উদ্বুদ্ধ করতে পারেন। তেমন নেতা কি সত্যিই আমাদের সমাজে আছে? তৈরি হচ্ছে? আমাদের পরিবারে, প্রতিষ্ঠানে, সমাজে, রাজনৈতিক দলে তেমন নেতৃত্ব বিকাশের পথ কি আছে?
বিখ্যাত নাট্যকার ব্রেটল্ট ব্রেশটের ‘গ্যালিলিওর জীবনী’ নাটকে গ্যালিলিওর এক শিক্ষার্থী আন্দ্রিয়া বলেছেন, ‘দুর্ভাগা সেই দেশ, যাদের কোনো নেতা নেই।’ উত্তরে গ্যালিলিও বলেন, ‘না, দুর্ভাগা সেই দেশ, যারা কেবল নেতারই প্রয়োজন অনুভব করে।’
হ্যাঁ, আমরা সত্যিই দুর্ভাগা যে আমাদের দেশে যোগ্য নেতার অভাব রয়েছে। আমরা আরও বেশি দুর্ভাগা যে আমরা কেবল নেতারই প্রয়োজন অনুভব করি!
লেখক: গবেষক ও কলামিস্ট
ঢাকা-চট্টগ্রাম মহাসড়কের কুমিল্লা এলাকায় যাত্রীবাহী বাসে ডাকাতি বেড়েই চলছে। এ কারণে চালক ও যাত্রীদের কাছে আতঙ্কের নাম হয়ে উঠছে এই সড়ক। ডাকাতির শিকার বেশি হচ্ছেন প্রবাসফেরত লোকজন। ডাকাতেরা অস্ত্র ঠেকিয়ে লুট করে নিচ্ছে সর্বস্ব। আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর পরিচয়েও ঘটছে ডাকাতির ঘটনা।
০২ মার্চ ২০২৫বিআরটিসির বাস দিয়ে চালু করা বিশেষায়িত বাস র্যাপিড ট্রানজিট (বিআরটি) লেনে অনুমতি না নিয়েই চলছে বেসরকারি কোম্পানির কিছু বাস। ঢুকে পড়ছে সিএনজিচালিত অটোরিকশা, ব্যাটারিচালিত অটোরিকশা। উল্টো পথে চলছে মোটরসাইকেল। অন্যদিকে বিআরটিসির মাত্র ১০টি বাস চলাচল করায় সোয়া চার হাজার কোটি টাকার এই প্রকল্প থেকে...
১৬ জানুয়ারি ২০২৫গাজীপুর মহানগরের বোর্ডবাজার এলাকার ইসলামিক ইউনিভার্সিটি অব টেকনোলজির (আইইউটি) মেকানিক্যাল ইঞ্জিনিয়ারিং বিভাগের শিক্ষার্থীরা পিকনিকে যাচ্ছিলেন শ্রীপুরের মাটির মায়া ইকো রিসোর্টে। ঢাকা-ময়মনসিংহ মহাসড়ক থেকে বাসগুলো গ্রামের সরু সড়কে ঢোকার পর বিদ্যুতের তারে জড়িয়ে যায় বিআরটিসির একটি দোতলা বাস...
২৪ নভেম্বর ২০২৪ঝড়-জলোচ্ছ্বাস থেকে রক্ষায় সন্দ্বীপের ব্লক বেড়িবাঁধসহ একাধিক প্রকল্প হাতে নিয়েছে সরকার। এ লক্ষ্যে বরাদ্দ দেওয়া হয়েছে ৫৬২ কোটি টাকা। এ জন্য টেন্ডারও হয়েছে। প্রায় এক বছর পেরিয়ে গেলেও ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠানগুলো কাজ শুরু করছে না। পানি উন্নয়ন বোর্ডের (পাউবো) তাগাদায়ও কোনো কাজ হচ্ছে না বলে জানিয়েছেন...
২০ নভেম্বর ২০২৪