Ajker Patrika

বৈশাখী পূর্ণিমা: জ্যৈষ্ঠের ঝড়

মানবর্দ্ধন পাল
বৈশাখী পূর্ণিমা: জ্যৈষ্ঠের ঝড়

কবি ও কথাসাহিত্যিক অচিন্ত্যকুমার সেনগুপ্ত বিদ্রোহী কবির বন্ধু ছিলেন। নজরুল-সম্পর্কিত তাঁর বইটির নাম ‘জ্যৈষ্ঠের ঝড়’। বড় চমৎকার ও লাগসই নাম বইটির। ঝঞ্ঝাময় জ্যৈষ্ঠ নজরুলের জন্মমাস। কাব্য এবং চরিত্র-স্বভাবে নজরুল ছিলেন ঝোড়ো জ্যৈষ্ঠের প্রতিরূপ। উত্তাপে, অশনিসংকেতে, তারুণ্যের তপ্ত নিশ্বাসে ও ভালোবাসার বারিধারায়, প্রেমের প্লাবনে নজরুল সত্যিকার অর্থেই জ্যৈষ্ঠের জাতক। বিদ্রোহী কবি নজরুল জ্যৈষ্ঠের ঝড় হলে বিশ্বকবি রবীন্দ্রনাথকে নিশ্চয়ই বৈশাখী পূর্ণিমার সঙ্গে তুলনা করা যায়। রবীন্দ্রনাথ বাঙালির জীবনে ও মনে শান্তরসের আতপ জ্যোৎস্না ছড়িয়ে স্নিগ্ধ করেছেন। তিনি তো আমাদের মনের সূক্ষ্মতম তন্ত্রীগুলো জাগ্রত করেছেন, চেতনার সুপ্তগুপ্ত অন্ধিসন্ধিগুলো আলোকিত করেছেন। নজরুল অগ্নিবীণার রুদ্ররসে বাঙালির মনোভূমি ও জীবনপটে এনেছেন দ্রোহের ঝংকার। তবে দুজনেই গ্রীষ্মের জাতক, দুজনেই বাঙালির উজ্জ্বল বাতিঘর।

কালের ধারায় কেটে গেল ১৪৩০ বঙ্গাব্দের ২৫ বৈশাখ ও ১১ জ্যৈষ্ঠ। রবীন্দ্রনাথের ১৬২তম ও নজরুলের ১২৪তম জন্মবার্ষিকী। মুক্তিযুদ্ধের পর থেকে নিয়ম অনুযায়ী সবই হচ্ছে—রাষ্ট্রীয়ভাবে শ্রদ্ধাজ্ঞাপন, রাষ্ট্র্রপতি ও প্রধানমন্ত্রীর বাণী প্রদান, সরকারিভাবে রবীন্দ্র-নজরুলের স্মৃতিধন্য স্থানে অনুষ্ঠানের আয়োজন, জেলা পর্যায়ে সরকারিভাবে দুই কবির জন্মোৎসব উদ্‌যাপন ইত্যাদি। দুই কবির নামে স্থাপিত হয়েছে সর্বোচ্চ শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান—বিশ্ববিদ্যালয়। কিন্তু মনে হয় সবই যেন প্রাণহীন, আনন্দহীন এবং আরোপিত। সেখানে হৃদয়হীন কর্তব্যের নিরাবেগ পালন থাকে কিন্তু সদানন্দময় প্রাণের স্পন্দন থাকে না।

ঔপনিবেশিক পাকিস্তান আমলে রবীন্দ্রচর্চা প্রায় নিষিদ্ধই ছিল। রবীন্দ্রনাথকে বাঙালি সংস্কৃতি থেকে বিচ্ছিন্ন করার বহুমুখী ষড়যন্ত্র চলেছিল দীর্ঘদিন। পাঠ্যসূচিতে সীমিত এবং রাষ্ট্র্রীয় প্রচারযন্ত্রে নিষিদ্ধও ছিলেন তিনি। রবীন্দ্র বিদেশি ও হিন্দু কবি। রবীন্দ্রসাহিত্য পাকিস্তানি ভাবাদর্শের পরিপন্থী। রবীন্দ্রনাথের রচনা পৌত্তলিক—ইসলামি সংস্কৃতি ও তাহজিব-তমদ্দুনের সঙ্গে সাংঘর্ষিক। এমন বহু অপবাদ ও মিথ্যাচার তখন করা হয়েছে বক্তৃতা-বিবৃতি ও লেখায়। অপরাজনীতি ও সামরিক রাষ্ট্রযন্ত্রের স্বার্থান্বেষী স্তাবকেরা পদ-পদবি ও পুরস্কারের লোভে তখন অস্বীকার করেছেন রবীন্দ্রনাথকে। তাঁরা নজরুলকেও খণ্ডিত করেছেন। খোদার ওপর খোদকারির মতো নজরুল-রচনায় তথাকথিত হিন্দুয়ানি শব্দ বাদ দিয়ে তাতে আরবি-ফারসি শব্দ যুক্ত করে ইসলামীকরণ করেছেন। মানবিক ও অসাম্প্রদায়িক চেতনার নজরুলকে মুসলমান, ইসলাম ও পাকিস্তানের কবি বানিয়ে খণ্ডিত করেছেন। কবির শ্যামাসংগীত, পদাবলি কীর্তন, মানবিক প্রেমের কবিতা-গান এবং দ্রোহ, শৃঙ্খলমুক্তির গান বাদ দিয়ে হামদ-নাত এবং ইসলামি গজল প্রচার ও চর্চার মধ্যেই সরকার সীমাবদ্ধ থেকেছে। ফলে পাকিস্তান আমলে রবীন্দ্রনাথ যেমন ছিলেন ব্রাত্য, প্রায় নিষিদ্ধ এবং অচর্চিত; তেমনই নজরুলও ছিলেন খণ্ডিত ও বৃত্তাবদ্ধ।

স্বাধীনতার পঞ্চাশ বছরে সেই অবস্থার খুব যে উন্নতি হয়েছে, তা বলা যাবে না। অথচ আমাদের মহান মুক্তিযুদ্ধে রবীন্দ্র-নজরুলের কবিতা-গান ছিল চেতনার পরম আশ্রয়, সাহসের হিমালয়; দুঃখজয়, মানসিক প্রশান্তি ও প্রেরণার বাতিঘর। শৃঙ্খলমুক্তি ও স্বাধীনতার লক্ষ্যে রবীন্দ্রনাথের সোনার বাংলা এবং নজরুলের বাংলাদেশ তখন বঙ্গবন্ধুর ‘জয় বাংলা’ ধ্বনির সঙ্গে সমুদ্র-সমর্পিত নদীর মতো একাকার হয়ে গিয়েছিল। বাংলাদেশের স্বাধীনতার সাংস্কৃতিক স্বপ্নবীজটি জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু মূলত রবীন্দ্র-নজরুলের সাহিত্য-আধার থেকেই আত্মস্থ করেছিলেন। স্বাধীনতার আকাঙ্ক্ষা, শোষণমুক্তির অভিলাষ ও গণতন্ত্রের অভীপ্সা তিনি রবীন্দ্র-নজরুলের চেতনার মূলেই আস্বাদন করেছেন। তাই বিশ্বকবি রবীন্দ্রনাথের গান আমাদের জাতীয় সংগীত আর বিদ্রোহী কবি নজরুলের গান রণসংগীত।

মুক্তিযুদ্ধের পর স্বাধীন বাংলাদেশের সাংস্কৃতিক অভিযাত্রা রবীন্দ্রনাথ ও নজরুলের সাহিত্যকে আশ্রয় করে পল্লবিত হয়েছিল। কিন্তু পঁচাত্তরের পনেরো আগস্টের কালরাতে বঙ্গবন্ধুকে হত্যার পর শুরু হয় পাকিস্তানি ধারায় বিপরীত স্রোতে যাত্রা। সামরিক ও মৌলবাদী শাসনে রবীন্দ্র-নজরুল আবার হয়ে যান ব্রাত্য ও খণ্ডিত। পাকিস্তান আমলে আমাদের স্কুলজীবনে দেখেছি, নির্দিষ্ট তারিখে আমাদের নিয়ে শিক্ষকবৃন্দ দুই কবিরই জন্মবার্ষিকী উদ্‌যাপন করতেন। কখনো জ্যৈষ্ঠের মাঝামাঝি একসঙ্গে উদ্‌যাপিত হতো রবীন্দ্র-নজরুলজয়ন্তী। পাড়া-মহল্লায় বিভিন্ন ক্লাব, পাঠাগার ও সামাজিক-সাংস্কৃতিক সংগঠনের উদ্যোগেও উদ্‌যাপিত হতো দুই কবির জন্মদিন। নানা রকম বিরোধিতা এবং ষড়যন্ত্র থাকলেও মফস্বলে তখন এই রেওয়াজটি ছিল।

স্বাধীনতার পরও রবীন্দ্র-নজরুলজয়ন্তী সারা দেশে ঘটা করে উদ্‌যাপন করা হতো। বেসরকারি উদ্যোগেরই তাতে প্রাধান্য ছিল। গ্রামেগঞ্জে বিভিন্ন ক্লাব, গ্রন্থাগার ও সামাজিক-সাংস্কৃতিক সংগঠনের মাধ্যমে উদ্‌যাপিত হতো দুই কবির জন্মবার্ষিকী। দুজনের সঙ্গে তখন যুক্ত থাকতেন আরও একজন—সুকান্ত ভট্টাচার্য। স্বাধীনতার পর রবীন্দ্র-নজরুল-সুকান্ত—এই কবিত্রয়ের জন্মবার্ষিকী একসঙ্গে একাধিকবার মফস্বল থানা সদরে আমরাও উদ্‌যাপন করেছি। উনিশ শ পঁচাত্তরের পনেরো আগস্টের পর পাকিস্তানি প্রেতাত্মারা অবৈধভাবে ক্ষমতা দখল করে চিন্তা ও চরিত্রে এ দেশকে মিনি পাকিস্তান বানিয়েছিল। সেই থেকে ক্রমে এই সাংস্কৃতিক চর্চা বিলীয়মান হতে থাকে। একুশ বছর পর মুক্তিযুদ্ধের পক্ষশক্তি ক্ষমতায় আসার পরও তৃণমূলের সংস্কৃতিতে এই ধারা বেগবান হয়নি বরং ক্ষীণ থেকে আরও ক্ষীণতর হয়েছে।

কোমলপ্রাণ শিক্ষার্থীদের শিক্ষাজীবনের শুরু থেকে বাঙালি সংস্কৃতি, অসাম্প্রদায়িক মানবিক চেতনা, সব ধর্মের প্রতি সহনশীলতা, মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাস ও আদর্শের সঙ্গে ঘনিষ্ঠ পরিচয় ঘটাতে হবে। নইলে ভবিষ্যৎ প্রজন্ম মুক্তমনা ও মানবিক হয়ে গড়ে উঠবে না। এ জন্য দেশের সব পর্যায়ের শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবস, স্বাধীনতা দিবস, বিজয় দিবস, শিশু দিবস, জাতীয় শোক দিবস শিক্ষার্থীদের অংশগ্রহণের মাধ্যমে পালন করতে হবে। একই সঙ্গে রবীন্দ্র-নজরুলজয়ন্তীসহ নববর্ষ ও অন্যান্য ঋতু-উৎসবও উদ্‌যাপন করা প্রয়োজন। মাদ্রাসাসহ দেশের অধিকাংশ শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানেই এখন নামকাওয়াস্তে জাতীয় পতাকা উত্তোলন করা হয় মাত্র, জাতীয় সংগীত গাওয়া ও শপথবাক্য পাঠ করা হয় না মোটেই। এ ব্যাপারে সরকারিভাবে নিয়মিত মনিটরিং দরকার। 
আবহমান বাঙালি সংস্কৃতির ধারায় নারীদের প্রসাধনচর্চা, সাজসজ্জা ও ব্যক্তিরুচি অনুযায়ী আধুনিক পোশাক পরার স্বাধীনতা খর্বিত হচ্ছে। এই দুঃসহ অবস্থা থেকে মুক্তি পেতে মৌলবাদের বিস্তার রোধ করতে হবে। মুক্তিযুদ্ধের চেতনার আলোকে বাঙালি সংস্কৃতির প্রসার ঘটাতে হবে। ব্যক্তি ও নারী স্বাধীনতা রক্ষার দৃঢ় পদক্ষেপ গ্রহণ এবং রবীন্দ্র-নজরুলচর্চার বিকাশ করতে হবে। তবেই আমরা মুক্তিযুদ্ধের চেতনাসমৃদ্ধ কাঙ্ক্ষিত বাংলাদেশ গড়ে তুলতে পারব।

লেখক: গবেষক ও শিক্ষাবিদ

Google News Icon

সর্বশেষ খবর পেতে Google News ফিড ফলো করুন

এলাকার খবর
খুঁজুন

পাঠকের আগ্রহ

সম্পর্কিত