ড. মইনুল ইসলাম
বর্তমান বাস্তবতায় দেশের উন্নয়নের পথে সবচেয়ে বড় বাধা হিসেবে দাঁড়িয়ে আছে দুর্নীতি ও পুঁজি লুণ্ঠন। জিডিপি প্রবৃদ্ধির হার ২০১৯-২০ অর্থবছরে ৮ দশমিক ১৩ শতাংশে পৌঁছে গিয়েছিল, কিন্তু করোনাভাইরাস মহামারি ও রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধের তাণ্ডবে এরপর দুই বছর প্রবৃদ্ধির হার কমে গিয়েছিল।
অবশ্য ২০২২-২৩ অর্থবছরে প্রবৃদ্ধির হার আবার ৬ শতাংশে উন্নীত হয়েছে। দুর্নীতির লাগাম টেনে ধরতে পারলে এক-দুই বছরেই এই হার আবার ৮ শতাংশ অতিক্রম করবে ইনশা আল্লাহ। এর মানে, বাংলাদেশ তিন দশক ধরে একটি ‘উচ্চ প্রবৃদ্ধির দেশে’ পরিণত হয়েছে। কিন্তু দুর্নীতি এখনো দেশের উন্নয়নের পথে ‘এক নম্বর বাধা’ হিসেবে দাঁড়িয়ে আছে।
এই পর্যায়ে স্মরণ করছি, ২০০৭-০৮ সালের সামরিক বাহিনী-সমর্থিত তত্ত্বাবধায়ক সরকারের সময় লে. জেনারেল হাসান মশহুদ চৌধুরীর নেতৃত্বাধীন দুর্নীতি দমন কমিশন যে প্রবল গতিশীলতা অর্জন করেছিল, সে জন্য স্বাধীন বাংলাদেশের ইতিহাসে প্রথমবারের মতো দুর্নীতিবাজ, পুঁজি-লুটেরা রাজনীতিক ও ব্যবসায়ীদের মধ্যে ত্রাহি ত্রাহি রব উঠেছিল। দুদকের পাশাপাশি মেজর জেনারেল মতিনের নেতৃত্বাধীন দুর্নীতিবিরোধী শক্তিশালী কমিটিও রাজনীতিবিদ ও রাঘববোয়াল ব্যবসায়ীদের মধ্যে প্রবল ত্রাসের সঞ্চার করেছিল।
ডিজিএফআই এর তদন্ত পরিচালনা করার কারণে রাঘববোয়ালেরা ভয়ে তটস্থ থাকত। দুই বছরে এই দুই ধরনের দুর্নীতিবাজদের যে প্রবল ঝাঁকি দেওয়া সম্ভব হয়েছিল, সেটা দুদকের পরবর্তী চেয়ারম্যান ড. গোলাম রহমান প্রকাশ্যে স্বীকার করেছিলেন। স্বাধীনতার পর ওই সময়টায় দেশে প্রথমবারের মতো কোনো সরকারকে দুর্নীতি দমনে সত্যিকার নিষ্ঠাবান মনে হয়েছিল আমার কাছে। আমার বেশ কয়েকটি লেখায় নির্দ্বিধায় তা স্বীকার করেছি।
দুঃখজনক হলো, ২০০৯ সালে আওয়ামী লীগ সরকার গঠনের পর অত্যন্ত পরিকল্পিতভাবে দুদককে অকার্যকর করার যাবতীয় প্রয়াস জোরদার করা হয়েছে। প্রথমেই চরম অসহযোগিতার মাধ্যমে লে. জেনারেল হাসান মশহুদ চৌধুরীকে দুদকের চেয়ারম্যান পদে ইস্তফা দিতে বাধ্য করা হয়েছিল। ২০০৭-০৮ সালের তত্ত্বাবধায়ক সরকার কর্তৃক জারি করা দুর্নীতি দমন কমিশন অধ্যাদেশটি যথাসময়ে সংসদে অনুসমর্থনের জন্য উত্থাপন না করে তাকে তামাদি হওয়ার ব্যবস্থা করা হয়। এরপর বহুদিন অতিবাহিত করে দুর্নীতি দমন কমিশনের জন্য যে বিলটি সংসদে উত্থাপন করে আইন হিসেবে পাস করা হয়, সেটা যে ওই আগের অধ্যাদেশের তুলনায় অতিদুর্বল একটি আইন, সেটা বুঝতে কারও বাকি রইল না। বোঝা গেল, মহাজোটের শাসনামলে দুদককে ড. গোলাম রহমানের ভাষায় ‘নখ-দন্তহীন ব্যাঘ্রে’র ভূমিকায় ফিরিয়ে নেওয়া হয়। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্রজীবন থেকেই ড. গোলাম রহমানের সঙ্গে আমার পরিচয়, অর্থনীতি বিভাগে তিনি আমার শিক্ষক ছিলেন। স্বল্পবাক ও সজ্জন ব্যক্তি হিসেবে তাঁর ব্যাপক পরিচিতি রয়েছে।
সিভিল সার্ভিসে চাকরিজীবনের একেবারে শেষ পর্যায়ে তিনি ১৯৯৬-২০০১ মেয়াদে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার প্রিন্সিপাল সেক্রেটারির দায়িত্বও পালন করেছেন। এমন একজন বিশ্বস্ত ব্যক্তি দুদকের চেয়ারম্যান পদে নিয়োগ পাওয়া সত্ত্বেও তাঁর পুরো মেয়াদেই দুদককে ‘সার্কাসের পোষা বাঘ’ করেই রাখা হয়; বরং সরকারি প্রশাসনের উচ্চতর পদের আমলাদের বিরুদ্ধে দুদকের তদন্ত শুরুর আগে ঊর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষের অনুমতি নেওয়ার প্রয়োজন হবে বলে বিধানও পাস করা হয়েছে শাসক জোটের পৃষ্ঠপোষকতাপ্রাপ্ত আমলাদের প্রবল লবির কারণে। বিভিন্ন সভা-সেমিনারে ড. গোলাম রহমানের সঙ্গে দেখা-সাক্ষাৎ হলে দুদকের ক্ষমতাহীনতা এবং অকার্যকারিতা সম্পর্কে আমি অনুযোগ করেছি বেশ কয়েকবার। স্বল্পবাক এই ব্যক্তি নিজের ব্যর্থতায় বেদনাহত হলেও জনসমক্ষে কারও বিরুদ্ধে ক্ষোভ প্রকাশ করেননি, বেশির ভাগ সময় নীরবতা পালনই শ্রেয় মনে করেছেন তিনি।
অবশ্য কয়েকটি বিরল মুহূর্তে দুদকের ব্যর্থতার জন্য যে সরকারের ‘ইচ্ছাশক্তির অভাব’কে প্রধানত দায়ী করে বিভিন্ন বক্তব্য তিনি মিডিয়ার সামনে প্রকাশ করেছেন, তাতে তাঁর সততার পরিচয় পাওয়া গেছে। তবু বলব, একজন সৎ ও মেধাবী সিএসপি অফিসার হিসেবে তাঁর সারা জীবনের অর্জিত সুনাম অনেকখানি ম্লান হয়ে গেছে দুদকে তাঁর চেয়ারম্যান পদকে তিনি যথাযথভাবে ব্যবহার করতে না পারায়।
এরপর চেয়ারম্যান হিসেবে দায়িত্ব পালন করা বদিউজ্জামানও ব্যর্থ হয়েছেন দুদককে কার্যকর করতে। তাঁরও অভিযোগ: বিদ্যমান আইনের কারণে দুদক নখ-দন্তহীন ব্যাঘ্রই থেকে যাবে। (ওই সময়ের দুদক কমিশনার এবং বর্তমান রাষ্ট্রপতি মো. সাহাবুদ্দিন অবশ্য সাধ্যমতো চেষ্টা করেছিলেন দুদকের কাজে গতি আনতে)। আমি মনে করি, বর্তমান আইনের পরিবর্তে ২০০৭-০৮ সালের দুদক অধ্যাদেশকে সংসদে বিল আনার মাধ্যমে নতুন দুদক আইনে পরিণত করা গেলে আবার দুদক শক্তিশালী ভূমিকা পালন করতে সমর্থ হবে, শুধু দুদকের চেয়ারম্যান কিংবা কমিশনার পরিবর্তন যথেষ্ট হবে না। দুদকের জনবল নিয়োগের ও আর্থিক স্বাধীনতাও অপরিহার্য মনে করি। ইকবাল মাহমুদের মতো অবসরপ্রাপ্ত দক্ষ আমলাকে দুদকের চেয়ারম্যান নিয়োগ করা সত্ত্বেও দুর্বল আইনের কারণে তা অকার্যকর রয়ে যাওয়ায় প্রমাণিত হয়েছে যে আইনকে শক্তিশালী না করলে দুদক ‘নখ-দন্তহীন ব্যাঘ্র’ই থেকে যাবে। মুনীর চৌধুরীর মতো সৎ ও সাহসী কর্মকর্তাকে দুদক থেকে অন্যত্র সরিয়ে দেওয়ায় মনে হচ্ছে, সরকারও দুদককে শক্তিশালী করতে চায় না!
অনুযোগটি বলার মূল কারণ, দুর্নীতির বিরুদ্ধে সত্যিকার নিষ্ঠার সঙ্গে প্রতিরোধের সূচনা না করলে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা আওয়ামী লীগের হারানো জনপ্রিয়তা পুনরুদ্ধার করতে পারবেন না। বর্তমানে সরকার যেভাবে জনগণের সমর্থন হারিয়ে ফেলেছে, তার পেছনে প্রধান কারণ দুর্নীতি। ২০১৩ সালে কয়েকটি সিটি করপোরেশনের নির্বাচনে ক্ষমতাসীন জোটের প্রার্থীরা ধরাশায়ী হওয়ায় খোদ মহাজোটেরই ২০১৪ সালের পরবর্তী সংসদ নির্বাচনে গোহারা হেরে যাওয়ার পরিস্থিতি সৃষ্টি হয়েছিল। কিন্তু তত্ত্বাবধায়ক সরকারের বিলুপ্তির ইস্যুকে কেন্দ্র করে যে চাণক্য-কৌশলের খেলা শুরু করা হয়েছিল, তাতে খালেদা জিয়া ও তারেক রহমান শেখ হাসিনা এবং তাঁর পরামর্শকদের কাছে ধরাশায়ী হওয়ায়ই ২০১৪ সালের ৫ জানুয়ারির নির্বাচন বয়কটের বোকামি করেছিল বিএনপির নেতৃত্বাধীন জোট। ওই একতরফা নির্বাচনে আবারও পুনর্নির্বাচিত হওয়ার সৌভাগ্য অর্জন করেছিল মহাজোট। দ্বিতীয়বারের এই সুযোগটাকে কাজে লাগিয়ে শেখ হাসিনার সরকারের জন্য ক্ষমতাসীনদের হারানো জনপ্রিয়তা ফিরিয়ে আনাই ছিল যৌক্তিক। কিন্তু ভুল থেকে শিক্ষা নেওয়া হলো না; বরং ২০১৮ সালের নির্বাচনে আগের রাতে পুলিশ ও প্রশাসনের প্রত্যক্ষ অংশগ্রহণে ব্যালট বাক্স ভরে ফেলার জালিয়াতির মাধ্যমে সংসদ নির্বাচনব্যবস্থাকে প্রশ্নবিদ্ধ করা হয়েছে।
গণতন্ত্রের জন্য সংগ্রামই এই জাতিকে মুক্তিযুদ্ধের পথে ঠেলে দিয়েছিল, এটা কারও ভুলে যাওয়া ঠিক নয়। গণতন্ত্রের পথে রাষ্ট্রক্ষমতা পরিবর্তনের ব্যবস্থা বিঘ্নিত করার পরিণতিতেই ১৯৭৫ সালের আগস্টের নারকীয় হত্যাযজ্ঞের কুশীলবরা জাতির পিতাকে হত্যা করার ষড়যন্ত্র হয়তো সফল করতে সমর্থ হয়েছিল, সেটাও অস্বীকার করা উচিত নয়। দুঃখজনকভাবে ২০২৪ সালের জানুয়ারির সংসদ নির্বাচনও অবাধ ও সুষ্ঠু হওয়ার সম্ভাবনা দেখা যাচ্ছে না। জনগণের রাজনৈতিক দল আওয়ামী লীগকে ক্ষমতায় যাওয়ার জন্য জালিয়াতির নির্বাচন চালিয়ে যেতে হবে, এর চেয়ে অবমাননাকর আর কিছুই হতে পারে না। বর্তমান ক্ষমতাসীন সরকারের অনেক সুকৃতি জনগণের সুবিবেচনা পাবে, যদি দুর্নীতির বিরুদ্ধে শেখ হাসিনা সত্যিকারের কঠোর অভিযান পরিচালনা করেন। এর ফলে জনগণের মধ্যে ক্ষমতাসীনদের বিরোধিতার (এন্টি-ইনকাম্বেন্সি) যে মনোভাব গেড়ে বসেছে, তা ক্রমেই কমে আসবে বলে আমার দৃঢ়বিশ্বাস। এ-পথেই ২০২৪ সালে অনুষ্ঠেয় সংসদ নির্বাচনে বিজয় অর্জনের লক্ষ্যে প্রয়াস চালাতে হবে ১৪-দলীয় জোটকে, ‘ইলেকশন ইঞ্জিনিয়ারিং’য়ের পথে নয়।
দুদকের বর্তমান টিমকে সব ধরনের সাহায্য-সহায়তা দিয়ে কার্যকরভাবে দুর্নীতি দমনের অভিযানে সফল করে তুলতে পারলে অবাধ ও সুষ্ঠু নির্বাচনে এখনো আওয়ামী লীগ তথা ১৪-দলীয় জোটের বিজয় অসম্ভব নয়। সাম্প্রতিক সময়ে দেশের অর্থনীতি অত্যন্ত বিপর্যস্ত অবস্থায় যাওয়ার আলামতগুলো জোরালোভাবে ফুটে উঠছে। বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভের পতন কোনোমতেই থামানো যাচ্ছে না। ডলার-সংকট ক্রমেই অসহনীয় পর্যায়ে চলে যাচ্ছে। কার্ব মার্কেটে ডলারের দাম ১২০ টাকা অতিক্রম করেছে। ব্যাংকের খেলাপি ঋণ সমস্যাকে লুকিয়ে ফেলার অপপ্রয়াস মুখ থুবড়ে পড়েছে, খেলাপি ঋণ বিপজ্জনকভাবে বাড়ছেই। ফরমাল চ্যানেলে প্রবাসীদের রেমিট্যান্স প্রবাহে বিপজ্জনক ধস নেমেছে। এর পেছনে ক্রিয়াশীল হুন্ডি ব্যবসা আর হুন্ডি ডলারের প্রধান চাহিদা আসছে দুর্নীতিবাজ আমলা, ব্যবসায়ী ও রাজনীতিবিদদের কাছ থেকে। অতএব, দুর্নীতির বিরুদ্ধে ‘জিরো টলারেন্স’ নীতিকে বাত্ কা বাত্ বানিয়ে রাখলে এই সংকট থেকে নিষ্কৃতি মিলবে না।
ড. মইনুল ইসলাম, ইউজিসি অধ্যাপক, অর্থনীতি বিভাগ, চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়
বর্তমান বাস্তবতায় দেশের উন্নয়নের পথে সবচেয়ে বড় বাধা হিসেবে দাঁড়িয়ে আছে দুর্নীতি ও পুঁজি লুণ্ঠন। জিডিপি প্রবৃদ্ধির হার ২০১৯-২০ অর্থবছরে ৮ দশমিক ১৩ শতাংশে পৌঁছে গিয়েছিল, কিন্তু করোনাভাইরাস মহামারি ও রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধের তাণ্ডবে এরপর দুই বছর প্রবৃদ্ধির হার কমে গিয়েছিল।
অবশ্য ২০২২-২৩ অর্থবছরে প্রবৃদ্ধির হার আবার ৬ শতাংশে উন্নীত হয়েছে। দুর্নীতির লাগাম টেনে ধরতে পারলে এক-দুই বছরেই এই হার আবার ৮ শতাংশ অতিক্রম করবে ইনশা আল্লাহ। এর মানে, বাংলাদেশ তিন দশক ধরে একটি ‘উচ্চ প্রবৃদ্ধির দেশে’ পরিণত হয়েছে। কিন্তু দুর্নীতি এখনো দেশের উন্নয়নের পথে ‘এক নম্বর বাধা’ হিসেবে দাঁড়িয়ে আছে।
এই পর্যায়ে স্মরণ করছি, ২০০৭-০৮ সালের সামরিক বাহিনী-সমর্থিত তত্ত্বাবধায়ক সরকারের সময় লে. জেনারেল হাসান মশহুদ চৌধুরীর নেতৃত্বাধীন দুর্নীতি দমন কমিশন যে প্রবল গতিশীলতা অর্জন করেছিল, সে জন্য স্বাধীন বাংলাদেশের ইতিহাসে প্রথমবারের মতো দুর্নীতিবাজ, পুঁজি-লুটেরা রাজনীতিক ও ব্যবসায়ীদের মধ্যে ত্রাহি ত্রাহি রব উঠেছিল। দুদকের পাশাপাশি মেজর জেনারেল মতিনের নেতৃত্বাধীন দুর্নীতিবিরোধী শক্তিশালী কমিটিও রাজনীতিবিদ ও রাঘববোয়াল ব্যবসায়ীদের মধ্যে প্রবল ত্রাসের সঞ্চার করেছিল।
ডিজিএফআই এর তদন্ত পরিচালনা করার কারণে রাঘববোয়ালেরা ভয়ে তটস্থ থাকত। দুই বছরে এই দুই ধরনের দুর্নীতিবাজদের যে প্রবল ঝাঁকি দেওয়া সম্ভব হয়েছিল, সেটা দুদকের পরবর্তী চেয়ারম্যান ড. গোলাম রহমান প্রকাশ্যে স্বীকার করেছিলেন। স্বাধীনতার পর ওই সময়টায় দেশে প্রথমবারের মতো কোনো সরকারকে দুর্নীতি দমনে সত্যিকার নিষ্ঠাবান মনে হয়েছিল আমার কাছে। আমার বেশ কয়েকটি লেখায় নির্দ্বিধায় তা স্বীকার করেছি।
দুঃখজনক হলো, ২০০৯ সালে আওয়ামী লীগ সরকার গঠনের পর অত্যন্ত পরিকল্পিতভাবে দুদককে অকার্যকর করার যাবতীয় প্রয়াস জোরদার করা হয়েছে। প্রথমেই চরম অসহযোগিতার মাধ্যমে লে. জেনারেল হাসান মশহুদ চৌধুরীকে দুদকের চেয়ারম্যান পদে ইস্তফা দিতে বাধ্য করা হয়েছিল। ২০০৭-০৮ সালের তত্ত্বাবধায়ক সরকার কর্তৃক জারি করা দুর্নীতি দমন কমিশন অধ্যাদেশটি যথাসময়ে সংসদে অনুসমর্থনের জন্য উত্থাপন না করে তাকে তামাদি হওয়ার ব্যবস্থা করা হয়। এরপর বহুদিন অতিবাহিত করে দুর্নীতি দমন কমিশনের জন্য যে বিলটি সংসদে উত্থাপন করে আইন হিসেবে পাস করা হয়, সেটা যে ওই আগের অধ্যাদেশের তুলনায় অতিদুর্বল একটি আইন, সেটা বুঝতে কারও বাকি রইল না। বোঝা গেল, মহাজোটের শাসনামলে দুদককে ড. গোলাম রহমানের ভাষায় ‘নখ-দন্তহীন ব্যাঘ্রে’র ভূমিকায় ফিরিয়ে নেওয়া হয়। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্রজীবন থেকেই ড. গোলাম রহমানের সঙ্গে আমার পরিচয়, অর্থনীতি বিভাগে তিনি আমার শিক্ষক ছিলেন। স্বল্পবাক ও সজ্জন ব্যক্তি হিসেবে তাঁর ব্যাপক পরিচিতি রয়েছে।
সিভিল সার্ভিসে চাকরিজীবনের একেবারে শেষ পর্যায়ে তিনি ১৯৯৬-২০০১ মেয়াদে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার প্রিন্সিপাল সেক্রেটারির দায়িত্বও পালন করেছেন। এমন একজন বিশ্বস্ত ব্যক্তি দুদকের চেয়ারম্যান পদে নিয়োগ পাওয়া সত্ত্বেও তাঁর পুরো মেয়াদেই দুদককে ‘সার্কাসের পোষা বাঘ’ করেই রাখা হয়; বরং সরকারি প্রশাসনের উচ্চতর পদের আমলাদের বিরুদ্ধে দুদকের তদন্ত শুরুর আগে ঊর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষের অনুমতি নেওয়ার প্রয়োজন হবে বলে বিধানও পাস করা হয়েছে শাসক জোটের পৃষ্ঠপোষকতাপ্রাপ্ত আমলাদের প্রবল লবির কারণে। বিভিন্ন সভা-সেমিনারে ড. গোলাম রহমানের সঙ্গে দেখা-সাক্ষাৎ হলে দুদকের ক্ষমতাহীনতা এবং অকার্যকারিতা সম্পর্কে আমি অনুযোগ করেছি বেশ কয়েকবার। স্বল্পবাক এই ব্যক্তি নিজের ব্যর্থতায় বেদনাহত হলেও জনসমক্ষে কারও বিরুদ্ধে ক্ষোভ প্রকাশ করেননি, বেশির ভাগ সময় নীরবতা পালনই শ্রেয় মনে করেছেন তিনি।
অবশ্য কয়েকটি বিরল মুহূর্তে দুদকের ব্যর্থতার জন্য যে সরকারের ‘ইচ্ছাশক্তির অভাব’কে প্রধানত দায়ী করে বিভিন্ন বক্তব্য তিনি মিডিয়ার সামনে প্রকাশ করেছেন, তাতে তাঁর সততার পরিচয় পাওয়া গেছে। তবু বলব, একজন সৎ ও মেধাবী সিএসপি অফিসার হিসেবে তাঁর সারা জীবনের অর্জিত সুনাম অনেকখানি ম্লান হয়ে গেছে দুদকে তাঁর চেয়ারম্যান পদকে তিনি যথাযথভাবে ব্যবহার করতে না পারায়।
এরপর চেয়ারম্যান হিসেবে দায়িত্ব পালন করা বদিউজ্জামানও ব্যর্থ হয়েছেন দুদককে কার্যকর করতে। তাঁরও অভিযোগ: বিদ্যমান আইনের কারণে দুদক নখ-দন্তহীন ব্যাঘ্রই থেকে যাবে। (ওই সময়ের দুদক কমিশনার এবং বর্তমান রাষ্ট্রপতি মো. সাহাবুদ্দিন অবশ্য সাধ্যমতো চেষ্টা করেছিলেন দুদকের কাজে গতি আনতে)। আমি মনে করি, বর্তমান আইনের পরিবর্তে ২০০৭-০৮ সালের দুদক অধ্যাদেশকে সংসদে বিল আনার মাধ্যমে নতুন দুদক আইনে পরিণত করা গেলে আবার দুদক শক্তিশালী ভূমিকা পালন করতে সমর্থ হবে, শুধু দুদকের চেয়ারম্যান কিংবা কমিশনার পরিবর্তন যথেষ্ট হবে না। দুদকের জনবল নিয়োগের ও আর্থিক স্বাধীনতাও অপরিহার্য মনে করি। ইকবাল মাহমুদের মতো অবসরপ্রাপ্ত দক্ষ আমলাকে দুদকের চেয়ারম্যান নিয়োগ করা সত্ত্বেও দুর্বল আইনের কারণে তা অকার্যকর রয়ে যাওয়ায় প্রমাণিত হয়েছে যে আইনকে শক্তিশালী না করলে দুদক ‘নখ-দন্তহীন ব্যাঘ্র’ই থেকে যাবে। মুনীর চৌধুরীর মতো সৎ ও সাহসী কর্মকর্তাকে দুদক থেকে অন্যত্র সরিয়ে দেওয়ায় মনে হচ্ছে, সরকারও দুদককে শক্তিশালী করতে চায় না!
অনুযোগটি বলার মূল কারণ, দুর্নীতির বিরুদ্ধে সত্যিকার নিষ্ঠার সঙ্গে প্রতিরোধের সূচনা না করলে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা আওয়ামী লীগের হারানো জনপ্রিয়তা পুনরুদ্ধার করতে পারবেন না। বর্তমানে সরকার যেভাবে জনগণের সমর্থন হারিয়ে ফেলেছে, তার পেছনে প্রধান কারণ দুর্নীতি। ২০১৩ সালে কয়েকটি সিটি করপোরেশনের নির্বাচনে ক্ষমতাসীন জোটের প্রার্থীরা ধরাশায়ী হওয়ায় খোদ মহাজোটেরই ২০১৪ সালের পরবর্তী সংসদ নির্বাচনে গোহারা হেরে যাওয়ার পরিস্থিতি সৃষ্টি হয়েছিল। কিন্তু তত্ত্বাবধায়ক সরকারের বিলুপ্তির ইস্যুকে কেন্দ্র করে যে চাণক্য-কৌশলের খেলা শুরু করা হয়েছিল, তাতে খালেদা জিয়া ও তারেক রহমান শেখ হাসিনা এবং তাঁর পরামর্শকদের কাছে ধরাশায়ী হওয়ায়ই ২০১৪ সালের ৫ জানুয়ারির নির্বাচন বয়কটের বোকামি করেছিল বিএনপির নেতৃত্বাধীন জোট। ওই একতরফা নির্বাচনে আবারও পুনর্নির্বাচিত হওয়ার সৌভাগ্য অর্জন করেছিল মহাজোট। দ্বিতীয়বারের এই সুযোগটাকে কাজে লাগিয়ে শেখ হাসিনার সরকারের জন্য ক্ষমতাসীনদের হারানো জনপ্রিয়তা ফিরিয়ে আনাই ছিল যৌক্তিক। কিন্তু ভুল থেকে শিক্ষা নেওয়া হলো না; বরং ২০১৮ সালের নির্বাচনে আগের রাতে পুলিশ ও প্রশাসনের প্রত্যক্ষ অংশগ্রহণে ব্যালট বাক্স ভরে ফেলার জালিয়াতির মাধ্যমে সংসদ নির্বাচনব্যবস্থাকে প্রশ্নবিদ্ধ করা হয়েছে।
গণতন্ত্রের জন্য সংগ্রামই এই জাতিকে মুক্তিযুদ্ধের পথে ঠেলে দিয়েছিল, এটা কারও ভুলে যাওয়া ঠিক নয়। গণতন্ত্রের পথে রাষ্ট্রক্ষমতা পরিবর্তনের ব্যবস্থা বিঘ্নিত করার পরিণতিতেই ১৯৭৫ সালের আগস্টের নারকীয় হত্যাযজ্ঞের কুশীলবরা জাতির পিতাকে হত্যা করার ষড়যন্ত্র হয়তো সফল করতে সমর্থ হয়েছিল, সেটাও অস্বীকার করা উচিত নয়। দুঃখজনকভাবে ২০২৪ সালের জানুয়ারির সংসদ নির্বাচনও অবাধ ও সুষ্ঠু হওয়ার সম্ভাবনা দেখা যাচ্ছে না। জনগণের রাজনৈতিক দল আওয়ামী লীগকে ক্ষমতায় যাওয়ার জন্য জালিয়াতির নির্বাচন চালিয়ে যেতে হবে, এর চেয়ে অবমাননাকর আর কিছুই হতে পারে না। বর্তমান ক্ষমতাসীন সরকারের অনেক সুকৃতি জনগণের সুবিবেচনা পাবে, যদি দুর্নীতির বিরুদ্ধে শেখ হাসিনা সত্যিকারের কঠোর অভিযান পরিচালনা করেন। এর ফলে জনগণের মধ্যে ক্ষমতাসীনদের বিরোধিতার (এন্টি-ইনকাম্বেন্সি) যে মনোভাব গেড়ে বসেছে, তা ক্রমেই কমে আসবে বলে আমার দৃঢ়বিশ্বাস। এ-পথেই ২০২৪ সালে অনুষ্ঠেয় সংসদ নির্বাচনে বিজয় অর্জনের লক্ষ্যে প্রয়াস চালাতে হবে ১৪-দলীয় জোটকে, ‘ইলেকশন ইঞ্জিনিয়ারিং’য়ের পথে নয়।
দুদকের বর্তমান টিমকে সব ধরনের সাহায্য-সহায়তা দিয়ে কার্যকরভাবে দুর্নীতি দমনের অভিযানে সফল করে তুলতে পারলে অবাধ ও সুষ্ঠু নির্বাচনে এখনো আওয়ামী লীগ তথা ১৪-দলীয় জোটের বিজয় অসম্ভব নয়। সাম্প্রতিক সময়ে দেশের অর্থনীতি অত্যন্ত বিপর্যস্ত অবস্থায় যাওয়ার আলামতগুলো জোরালোভাবে ফুটে উঠছে। বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভের পতন কোনোমতেই থামানো যাচ্ছে না। ডলার-সংকট ক্রমেই অসহনীয় পর্যায়ে চলে যাচ্ছে। কার্ব মার্কেটে ডলারের দাম ১২০ টাকা অতিক্রম করেছে। ব্যাংকের খেলাপি ঋণ সমস্যাকে লুকিয়ে ফেলার অপপ্রয়াস মুখ থুবড়ে পড়েছে, খেলাপি ঋণ বিপজ্জনকভাবে বাড়ছেই। ফরমাল চ্যানেলে প্রবাসীদের রেমিট্যান্স প্রবাহে বিপজ্জনক ধস নেমেছে। এর পেছনে ক্রিয়াশীল হুন্ডি ব্যবসা আর হুন্ডি ডলারের প্রধান চাহিদা আসছে দুর্নীতিবাজ আমলা, ব্যবসায়ী ও রাজনীতিবিদদের কাছ থেকে। অতএব, দুর্নীতির বিরুদ্ধে ‘জিরো টলারেন্স’ নীতিকে বাত্ কা বাত্ বানিয়ে রাখলে এই সংকট থেকে নিষ্কৃতি মিলবে না।
ড. মইনুল ইসলাম, ইউজিসি অধ্যাপক, অর্থনীতি বিভাগ, চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়
ঢাকা-চট্টগ্রাম মহাসড়কের কুমিল্লা এলাকায় যাত্রীবাহী বাসে ডাকাতি বেড়েই চলছে। এ কারণে চালক ও যাত্রীদের কাছে আতঙ্কের নাম হয়ে উঠছে এই সড়ক। ডাকাতির শিকার বেশি হচ্ছেন প্রবাসফেরত লোকজন। ডাকাতেরা অস্ত্র ঠেকিয়ে লুট করে নিচ্ছে সর্বস্ব। আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর পরিচয়েও ঘটছে ডাকাতির ঘটনা।
০২ মার্চ ২০২৫বিআরটিসির বাস দিয়ে চালু করা বিশেষায়িত বাস র্যাপিড ট্রানজিট (বিআরটি) লেনে অনুমতি না নিয়েই চলছে বেসরকারি কোম্পানির কিছু বাস। ঢুকে পড়ছে সিএনজিচালিত অটোরিকশা, ব্যাটারিচালিত অটোরিকশা। উল্টো পথে চলছে মোটরসাইকেল। অন্যদিকে বিআরটিসির মাত্র ১০টি বাস চলাচল করায় সোয়া চার হাজার কোটি টাকার এই প্রকল্প থেকে...
১৬ জানুয়ারি ২০২৫গাজীপুর মহানগরের বোর্ডবাজার এলাকার ইসলামিক ইউনিভার্সিটি অব টেকনোলজির (আইইউটি) মেকানিক্যাল ইঞ্জিনিয়ারিং বিভাগের শিক্ষার্থীরা পিকনিকে যাচ্ছিলেন শ্রীপুরের মাটির মায়া ইকো রিসোর্টে। ঢাকা-ময়মনসিংহ মহাসড়ক থেকে বাসগুলো গ্রামের সরু সড়কে ঢোকার পর বিদ্যুতের তারে জড়িয়ে যায় বিআরটিসির একটি দোতলা বাস...
২৪ নভেম্বর ২০২৪ঝড়-জলোচ্ছ্বাস থেকে রক্ষায় সন্দ্বীপের ব্লক বেড়িবাঁধসহ একাধিক প্রকল্প হাতে নিয়েছে সরকার। এ লক্ষ্যে বরাদ্দ দেওয়া হয়েছে ৫৬২ কোটি টাকা। এ জন্য টেন্ডারও হয়েছে। প্রায় এক বছর পেরিয়ে গেলেও ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠানগুলো কাজ শুরু করছে না। পানি উন্নয়ন বোর্ডের (পাউবো) তাগাদায়ও কোনো কাজ হচ্ছে না বলে জানিয়েছেন...
২০ নভেম্বর ২০২৪