Ajker Patrika

অন্যায্যতার বিরোধিতাই একুশের মূল চেতনা

আপডেট : ২১ ফেব্রুয়ারি ২০২৪, ০৮: ১৮
অন্যায্যতার বিরোধিতাই একুশের মূল চেতনা

মাতৃভাষার অধিকার ও মর্যাদা প্রতিষ্ঠার জন্য আত্মদানের ইতিহাস একমাত্র বাঙালিরই আছে। ১৯৫২ সালের ২১ ফেব্রুয়ারি ঢাকার রাজপথ রক্তে রঞ্জিত হয়েছিল। দাবি ছিল বাংলাকে পাকিস্তানের অন্যতম রাষ্ট্রভাষা করার। দাবিটি ছিল অত্যন্ত ন্যায়সংগত ও গণতান্ত্রিক। কারণ পাকিস্তানের সংখ্যাগরিষ্ঠ, অর্থাৎ ৫৬ শতাংশ মানুষ ছিল বাংলাভাষী। বেশি মানুষ যে ভাষায় কথা বলে, সে ভাষারই রাষ্ট্রভাষার মর্যাদা পাওয়ার কথা। কিন্তু পাকিস্তানি শাসকগোষ্ঠী তাদের কায়েমি স্বার্থে এই চিরায়ত গণতান্ত্রিক নীতিবোধ ভেঙে উর্দুকে রাষ্ট্রভাষা করার ঘোষণা দিলে বাঙালি তার প্রতিবাদ জানায়। পাকিস্তান ছিল একটি বহুভাষিক মানুষের দেশ। বাংলাভাষী সংখ্যায় বেশি। এ ছাড়া উর্দু, সিন্ধি, পশতুভাষী মানুষও ছিল। সে জন্য বাঙালিদের দাবি ছিল একাধিক ভাষাকে পাকিস্তানের রাষ্ট্রভাষা করার। একমাত্র বাংলাকে রাষ্ট্রভাষা করার দাবি কিন্তু তোলা হয়নি। বাংলাকে অন্যতম রাষ্ট্রভাষা করার দাবি তোলা হয়েছিল। 

পাকিস্তানি শাসকগোষ্ঠী যুক্তির ভাষা বুঝত না। তারা জোরের ভাষা প্রয়োগে পারদর্শী ছিল। আবার বাঙালির রক্তে বহমান প্রতিবাদের ধারা। অল্পসংখ্যক মানুষের ভাষাকে ‘একমাত্র’ রাষ্ট্রভাষা করার বিরুদ্ধে তাই বাঙালি রুখে দাঁড়িয়েছিল প্রথম মুহূর্ত থেকেই। এই প্রতিবাদী ধারার একটি পরিণতির দিন ১৯৫২ সালের ২১ ফেব্রুয়ারি। উর্দুকে রাষ্ট্রভাষা করার তাৎক্ষণিকভাবে যাঁরা প্রতিবাদ করেছিলেন তাঁদের মধ্যে ছিলেন সেই সময়ের তরুণ নেতা শেখ মুজিবুর রহমান। আরও অনেকেই ছিলেন। তারপর শেখ মুজিব একের পর এক ইতিহাস তৈরি করেছেন। স্বাধীন বাংলাদেশ রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠার সংগ্রামে নেতৃত্ব দিয়ে তিনি হয়েছেন জাতির পিতা। ইতিহাসের যিনি স্রষ্টা, সেই নেতার নাম ইতিহাস থেকে মুছে ফেলার ঘৃণ্য অপচেষ্টাও আমরা দেখেছি। কিন্তু এখন আবার বঙ্গবন্ধুকে স্বমহিমায় প্রতিষ্ঠিত করতে গিয়ে আমরা যেন অন্যদের অবদান ভুলে না যাই। একদিকে বেশি আলো ফেলতে গিয়ে অন্যদিক অন্ধকার করা একধরনের নির্বুদ্ধিতা। এটা যেন আমাদের পেয়ে না বসে। কারণ একুশের মূল চেতনাই হলো সব অন্যায্যতার বিরোধিতা করা।

‘আমার ভাইয়ের রক্তে রাঙানো একুশে ফেব্রুয়ারি...’। হ্যাঁ, ঢাকার শহর রক্তে ভাসিয়ে সারা দেশে তার দ্যুতি ছড়িয়ে বাঙালি যে গৌরবের সমাচার তৈরি করেছিল, এর ধারাবাহিকতাই আমাদের নিয়ে গেছে স্বাধীনতার পথে, গৌরবোজ্জ্বল মুক্তিযুদ্ধে। তাই একুশ আমাদের কাছে অহংকার। একুশ মানে মাথানত না করা। শুরুতে একুশ ছিল শোকের দিন, শহীদ দিবস। কিন্তু ১৯৫২ থেকে ২০২৪-এ এসে একুশে আর শোকের দিন নেই। একুশ এখন উদ্‌যাপনের, প্রতিজ্ঞা গ্রহণের, সামনে এগিয়ে চলার প্রেরণার। 

একুশে ফেব্রুয়ারিতে আমরা এখনো প্রভাতফেরি করি, অমর ভাষাশহীদদের প্রতি শ্রদ্ধা জানাই, তাঁদের স্মৃতি তর্পণ করি, ফুলে ফুলে শহীদ মিনারের পাদদেশ ভরে তুলি কিন্তু পরিবেশটা আর শোক দিবসের থাকে না। একুশে এখন উদ্‌যাপন করা হয় উৎসবের মেজাজে। এতেও দোষের কিছু নেই। একুশ আমাদের শোকে মুহ্যমান হতে শেখায়নি, শিখিয়েছে প্রতিবাদী হতে, বাধা অতিক্রম করে সামনে এগিয়ে যেতে। আবদুল গাফ্ফার চৌধুরীর লেখা একটি কবিতা শহীদ আলতাফ মাহমুদের সুরে গীত হয়ে একুশের অমর সংগীত হয়ে উঠেছে। এমন বাঙালি কি আছে, যার মুখে কখনো ধ্বনিত হয়নি ‘আমার ভাইয়ের রক্তে রাঙানো একুশে ফেব্রুয়ারি, আমি কি ভুলিতে পারি?’ না, আমরা একুশে ফেব্রুয়ারিকে ভুলিনি। আমাদের জাতীয় জীবনে যখনই কোনো সংকট এসেছে, তখনই একুশের স্মরণ নিয়ে আমরা সাহসে বুক বেঁধেছি। সংকটে আমরা বিহ্বল হইনি। একুশ আমাদের পথ দেখিয়েছে।

এত বছর পরে এসে একটি প্রশ্ন মনে খোঁচা দেয়, আমরা একুশকে আড়ম্বর, আনুষ্ঠানিকতার মধ্যে বন্দী করে ফেলছি না তো! একুশ পালনের আয়োজনের ব্যাপকতা আছে, কিন্তু একুশের চেতনার সঙ্গে এসব আয়োজন সংগতিপূর্ণ হচ্ছে কি? বাংলা রাষ্ট্রভাষা। কিন্তু বাংলা ভাষার চর্চা ও ব্যবহারে আমরা কতটুকু যত্নবান? আমাদের মাতৃভাষার প্রতি আমাদের শ্রদ্ধাবোধ অটুট আছে তো? বর্তমান প্রতিযোগিতাপূর্ণ পৃথিবীতে টিকে থাকার জন্য বিদেশি, প্রধানত ইংরেজি ভাষা শিক্ষায় মনোযোগী হয়ে বাংলাকে ‘অবহেলা’ করে ভুল করছি না তো? বাংলা ভালোভাবে শিখছি না। ইংরেজি বা অন্য বিদেশি ভাষা কি ভালোভাবে শিখছি? ইংরেজি শেখা আর ইংরেজিতে শেখা যে এক নয়, সেটা আমরা মনে রাখছি তো? ফেব্রুয়ারি মাস এলে আমরা গদগদ হয়ে উঠি, নানা বোলচালে গণমাধ্যম মাতিয়ে রাখি, ফেব্রুয়ারি বিদায় নিলে আমরা বুঝি মনে মনে জপি, ‘একদিন বাঙালি ছিলাম রে...’! 

আমরা যেন রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের সেই কথা ভুলে না যাই: ‘রাষ্ট্রিক কাজে সুবিধা করা চাই বৈকি, কিন্তু তার চেয়ে বড় কাজ দেশের চিত্তকে সফল ও সমুজ্জ্বল করা। সে কাজ আপন ভাষা, মাতৃভাষা ছাড়া হয় না। দেউড়িতে একটা সরকারি প্রদীপ জ্বালালে চলে কিন্তু একমাত্র তারই তেল জোগানোর খাতিরে ঘরে ঘরে প্রদীপ নেবানো চলে না।’ 

আমরা মাতৃভাষায় শিক্ষার বিস্তার চাই। ঘরে ঘরে শিক্ষার আলো ছড়িয়ে দিতে চাই। আমরা উদারতা ও মানবিকতার প্রসার চাই। আমাদের দেশে শিক্ষিতের হার বাড়ছে, সন্দেহ নেই। কিন্তু প্রকৃত শিক্ষিত বাড়ছে কি? প্রগতিকামী না হয়ে একধরনের অন্ধত্ব কি আমাদের অনেককে গ্রাস করছে না? ধর্মচর্চা বাড়ছে। কিন্তু মনের প্রসারতা বাড়ছে না। শান্তি ও সম্প্রীতির স্থান করে নিচ্ছে উগ্রতা ও অসহিষ্ণুতা। একুশের চেতনার কথা বললে আমাদের অবশ্যই সব ধরনের সংকীর্ণতা ও কূপমণ্ডূকতারও ঊর্ধ্বে উঠতে হবে। 

বাংলা একাডেমি আয়োজিত মাসব্যাপী বইমেলা এখন একুশ উদ্‌যাপনের বড় অনুষঙ্গ হয়ে উঠেছে। বছর কয়েক ধরে বইমেলার ব্যাপ্তি বেড়েছে। সোহরাওয়ার্দী উদ্যানের বিশাল এলাকাজুড়ে প্রতিবছর বইমেলা হচ্ছে। ছয় শতাধিক প্রকাশনা সংস্থা বইমেলায় স্টল দিচ্ছে। প্রতিদিন মেলায় শত শত নতুন বই আসে। এর মধ্যে কতগুলো বই মানসম্পন্ন? হাজার হাজার মানুষ মেলায় আসা-যাওয়া করে। এর মধ্যে কতজন-বা বই কেনে? সারা বছর যদি একটি ভালো বই তিন শ কপিও বিক্রি না হয় তাহলে চলবে কেন? বই প্রকাশের সংখ্যা দেখে মনে হয় আমাদের দেশে লেখক বাড়ছে—এটা আনন্দের বিষয়। কিন্তু একই সঙ্গে পাঠক না বাড়লে চলবে কেন?

আমাদের সাহিত্যের মান নিয়েও প্রশ্ন আছে। গল্প-কবিতা-উপন্যাস-প্রবন্ধ কতটা পাঠকদের নজর কাড়তে পারছে? সৃজনশীলতা-মননশীলতায় আমরা কি পিছিয়ে পড়ছি? বর্তমান সময়ের সেরা লেখক কে, এই প্রশ্ন যদি কারও মনে আসে তাহলে তার জবাব দিতে যে কাউকে অনেক সময় ধরে ভাবতে হবে।  

একুশে উদ্‌যাপনের সময় এসব প্রশ্নের জবাব খোঁজা প্রয়োজন বলেই মনে হয়। অর্থনৈতিকভাবে আমাদের দেশ সমৃদ্ধির পথে অগ্রসর হচ্ছে, প্রযুক্তি ব্যবহারেও আমরা এগিয়ে যাচ্ছি। আমরা যদি সমৃদ্ধ জাতি হিসেবে বিশ্ব দরবারে মাথা তুলে দাঁড়াতে পারি, তাহলে সেটা তো একুশের চেতনারই জয় বলে মনে হবে। 

কিন্তু রাজনীতির দিকে তাকালে কি আমাদের মনে হয় আমরা একুশের চেতনার আলোকবাহী? দেশের রাজনীতি দোষারোপ, সংঘাত ও অনিশ্চয়তা থেকে বের হতে পারছে না—এ দায় কার? গণতন্ত্রচর্চায়ও যে আমরা শিশুকাল অতিক্রম করতে পারছি না, এটাও কি একুশে উদ্‌যাপনে আমাদের পীড়িত করে না? চিন্তনে ও মননে আমরা যদি বিকশিত হতে না পারি, তাহলে একদিন হয়তো আমরা একুশের মর্মবাণী ভুলে কেবল খোলস নিয়েই মাতামাতি করব। একুশে উদ্‌যাপনের সময় এই কামনাই করি, তেমন দুর্দিন বা দুঃসময় যেন আমাদের জীবনে না আসে। 

বায়ান্ন বছর পরে এসেও কি বাংলা ব্যবহারের ক্ষেত্র বড় কোনো পরিবর্তন আমরা দেখছি?

লেখক: বিভুরঞ্জন সরকার,জ্যেষ্ঠ সহকারী সম্পাদক, আজকের পত্রিকা

Google News Icon

সর্বশেষ খবর পেতে Google News ফিড ফলো করুন

এলাকার খবর
খুঁজুন

পাঠকের আগ্রহ

সম্পর্কিত