চিররঞ্জন সরকার
সম্প্রতি ভারতের কলকাতায় একটি ফ্ল্যাটে নির্মমভাবে খুন হয়েছেন বাংলাদেশের ঝিনাইদহ-৪ আসনের সংসদ সদস্য আনোয়ারুল আজীম আনার। এই মৃত্যু নিয়ে দেশজুড়ে নানা আলোচনা ও বিতর্কের সৃষ্টি হয়েছে। একজন সংসদ সদস্যের দেশের বাইরে ‘চিকিৎসা’ করাতে গিয়ে নির্মমভাবে খুন হওয়ার ঘটনাটি বেদনার শুধু নয়, অত্যন্ত ভয়াবহও বটে। আর তাঁকে শুধু হত্যা করাই হয়নি, তাঁর শরীর থেকে মাংস ছাড়িয়ে টুকরা টুকরা করে হলুদ মেখে তা প্রথমে ফ্রিজে রাখা হয়েছে। এরপর স্যুটকেসে ভরে খালে ফেলে দেওয়া হয়েছে।
অনেক খোঁজাখুঁজির পরও তাঁর শরীরের অংশবিশেষ খুঁজে পাওয়া যায়নি। পাওয়া যাবে বলেও মনে হয় না। বলা হচ্ছে, অত্যন্ত শান্ত মাথায়, পরিকল্পনা করে হত্যা করে তাঁর অস্তিত্ব গায়েব করে ফেলা হয়েছে। এমন ঘটনা একেবারেই বিরল।
এটাও বলা হচ্ছে, ভারতের মাটিতে বসে পৈশাচিক এ হত্যাকাণ্ডটি ঘটিয়েছে বাংলাদেশেরই কয়েকজন মানুষ। দুই দেশের আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর পক্ষ থেকে এই খুনের ঘটনার পেছনে সীমান্তে চোরাচালান নিয়ে বিরোধের বিষয়কে তুলে ধরা হচ্ছে। কোনো কোনো গণমাধ্যমে বলা হচ্ছে, ব্যবসায়িক লেনদেনের সম্পর্কে কিছু বিষয়ে এমপি আনোয়ারুল আজীম আনারের ওপর ক্ষোভ ছিল তাঁর বন্ধু ও হত্যাকাণ্ডের মূল পরিকল্পনাকারী হিসেবে সন্দেহভাজন আক্তারুজ্জামান শাহীনের। ২০০ কোটি টাকার ভাগাভাগি নিয়ে নাকি আনারকে খুন করা হয়। তাঁকে আগেও একাধিকবার খুনের চেষ্টা করা হয়েছে বলে এক পুলিশ কর্মকর্তা জানিয়েছেন।
এই নৃশংস হত্যাকাণ্ডের ঘটনা সৌদি সাংবাদিক জামাল খাসোগির কথা মনে করিয়ে দেয়। সৌদি রাজতন্ত্রের এই সমালোচককে ২০১৮ সালের ৩ অক্টোবর তুরস্কের ইস্তাম্বুলে সৌদি কনস্যুলেটে গিয়ে খুন করার পর শরীর টুকরা টুকরা করা হয়। হত্যার পর ওই ব্যক্তিরা তুরস্ক ছেড়ে চলে যায়। এমপি আনারকেও হত্যার পর টুকরা টুকরা করা হয়। ঘটনার মূল হোতারা বিমানে করে নিরাপদে কলকাতা ত্যাগ করে।
খাসোগি হত্যায় যুক্ত ছিল একটা বড় রাষ্ট্রশক্তি। আর এমপি আনার হত্যায় যুক্ত একটি আঞ্চলিক চোরাচালানি চক্র। খাসোগি হত্যার শিকার হয়েছেন প্রতিবাদী সত্তার কারণে। পক্ষান্তরে আনার খুন হয়েছেন অনৈতিক কোনো ব্যবসার কর্তৃত্ব অথবা অর্থ ভাগাভাগির দ্বন্দ্বে!
আনার হত্যার ঘটনাটি ঠিক সিনেমার গল্পের মতো। কলকাতার নিউ টাউনে যে ফ্ল্যাটে আনারকে হত্যা করা হয়, সেটি এই আক্তারুজ্জামান শাহীনের ভাড়া করা। তিনি ঝিনাইদহের কোটচাঁদপুর পৌরসভার মেয়র মো. সহিদুজ্জামানের ছোট ভাই। তাঁরা ছিলেন একে অপরের বন্ধু ও ব্যবসায়িক পার্টনার। তিনি যুক্তরাষ্ট্রপ্রবাসী এবং মার্কিন পাসপোর্টধারী।
উভয়ের বিরুদ্ধেই সোনা চোরাচালান, হুন্ডিসহ আন্তর্দেশীয় বিভিন্ন অবৈধ ব্যবসার অভিযোগ রয়েছে। এ ছাড়া আনার ভারতে গিয়ে যে বন্ধুর বাসায় উঠেছিলেন, সেই গোপাল বিশ্বাসও নাকি সোনা চোরাচালানে জড়িত। ঘটনায় একটি নারী চরিত্রও আছে। ব্যবসায়ী আক্তারুজ্জামান শাহীন এমপি আনারকে হত্যার জন্য টোপ হিসেবে ব্যবহার করেন তাঁর বান্ধবী শিলাস্তি রহমানকে। কলকাতা নিউ টাউনের অ্যাপার্টমেন্টের সিসিটিভি ফুটেজে এমপি আনারকে শিলাস্তির সঙ্গে ফ্ল্যাটে প্রবেশ করতে দেখা গেছে। এই খুনের কুশীলবেরা নাকি সবাই পরস্পরের পরিচিত।
এই খুনের ঘটনায় খুলনা জেলার ‘সর্বহারা’ বা ‘চরমপন্থী’ কানেকশনও খুঁজে পাওয়া যাচ্ছে। আনারকে খুনের পরিকল্পনা বাস্তবায়নে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখেন সৈয়দ আমানুল্লাহ। তাঁর গ্রামের বাড়ি খুলনার ফুলতলার দামোদর ইউনিয়নে। তিনি একসময় চরমপন্থী সংগঠনের সঙ্গে যুক্ত ছিলেন। গণেশ নামে এক ব্যক্তিকে খুন করে যশোরের অভয়নগর থানার এক মামলায় আমানউল্লাহ সাত বছর (১৯৯১-৯৭) জেল খাটেন। ইমান আলী নামের আরেক ব্যক্তিকে খুনের ঘটনায় ২০০০ থেকে ২০১৩ সাল পর্যন্ত আবার জেল খাটেন তিনি।অবশ্য আমানউল্লাহর আসল নাম শিমুল ভূঁইয়া; যিনি খুলনায় চরমপন্থী সংগঠন পূর্ব বাংলার কমিউনিস্ট পার্টির প্রধান ছিলেন। শিমুল ভূঁইয়াই পরে আমানউল্লাহ হিসেবে নিজেকে পরিচিত করান।
ভারতে গ্রেপ্তার হওয়া ‘কসাই’ জিহাদের বাড়িও খুলনার দিঘলিয়া উপজেলার বারাকপুর ইউনিয়নে। গ্রামের বাড়িতে তাঁর স্ত্রী ও একটি ছোট ছেলে রয়েছে। দেড় বছর ধরে জিহাদ ভারতে রয়েছেন। জিহাদ ডাকাতি ও শেখ আনসার আলী হত্যা মামলার আসামি। এমন একজন ব্যক্তি কীভাবে পুলিশের চোখে ধুলা দিয়ে ভারতে চলে গেলেন, কীভাবেই-বা সেখানে অনুপ্রবেশকারী হিসেবে থাকলেন, সেই প্রশ্নের কোনো জবাব নেই।
এই খুনের প্রধান পরিকল্পনাকারী আক্তারুজ্জামান শাহীন এখনো ধরা পড়েননি। হত্যাকাণ্ডের পরিকল্পনা সাজিয়ে দিয়ে তিনি নাকি ১০ মে ঢাকায় চলে আসেন। এমপি আনারের নিখোঁজের বিষয়টি দেশে আলোচিত হলে তিনি ১৮ মে আবারও ভারত হয়ে নেপালে চলে যান। ২১ মে নেপাল থেকে চলে যান দুবাই। ২২ মে দুবাই থেকে যুক্তরাষ্ট্রে পাড়ি জমান।
আমাদের গোয়েন্দাদের কাছে কত ধরনের প্রতিবেদন থাকে, কত তথ্য থাকে। একজন যুক্তরাষ্ট্রের নাগরিক হুটহাট দেশে দেশে কীভাবে সোনা চোরাচালান নিয়ন্ত্রণ করেন? তাঁর ব্যাপারে গোয়েন্দাদের হাতে কোনো তথ্য নেই কেন? তিনি দেশে এলেন, কলকাতায় গেলেন, বাড়ি ভাড়া করলেন, খুনি ভাড়া করলেন, আবার দেশে ফিরে এলেন, দেশ থেকে কাঠমান্ডু গেলেন—গোয়েন্দারা এর কিছুই জানতে বা করতে পারলেন না, তা কি বিশ্বাসযোগ্য?
সাধারণ নাগরিকেরা একটা পাসপোর্ট করতে গিয়ে সীমাহীন ভোগান্তি পোহান। জাতীয় পরিচয়পত্রের একটা বানান সংশোধন করতে গিয়ে বাপের নাম ভোলার দশায় পড়তে হয়। অথচ শিমুল ভূঁইয়ারা কী সহজেই আমানুল্লাহ হয়ে যান। তাঁদের পরিচয়পত্র, পাসপোর্ট পেতে কোনো অসুবিধা হয় না। এমন একজন দাগি আসামি ভারতের ভিসাও পেয়ে যান কত সহজে!
বিদেশের মাটিতে গিয়ে দেশের একজন সংসদ সদস্যের এভাবে খুন হওয়াটা অত্যন্ত গ্লানির। একজন সংসদ সদস্যের চরিত্র এমন হবে কেন? তিনি কেন প্রলোভনের শিকার হলেন? কে বা কারা তাঁকে কলকাতায় নিয়ে গেল? কেন তিনি ‘চিকিৎসার’ কথা বলে কলকাতায় গিয়ে এদিক-সেদিক ঘোরাফেরা করছিলেন? পরিবারের কোনো সদস্য কেন তাঁর সঙ্গে গেলেন না? তিনি কোথায় যান, কী করেন, কার সঙ্গে মেশেন, কীভাবে টাকা উপার্জন করেন, এ প্রশ্নগুলো কী পরিবারের সদস্যরা কখনো করেছেন? যাঁর বিরুদ্ধে এত এত অভিযোগ ও মামলা, পরিবারের সদস্যরা কি কখনো এসবের সত্যতা জানতে চেয়েছেন? আমরা কেন ভুলে যাই, যা রটে, তার কিছু না কিছু বটে।
একজন ব্যক্তি যদি পরিবারের জবাবদিহির বাইরে চলে যায়, তাহলে তার দুর্নীতি ও অনিয়ন্ত্রিত জীবন বশে আনা যাবে কীভাবে? আরেকটি কথা, আনোয়ারুল আজীমকে বারবার এমপি পদে মনোনয়ন দেওয়া হচ্ছিল কেন? যাঁর বিরুদ্ধে এত অভিযোগ, এত মামলা, তাঁকেই কেন এমপি বানিয়ে আনতে হবে? ওই এলাকায় কি পরিচ্ছন্ন ইমেজের ভালো মানুষ নেই? সংবাদমাধ্যমে সংসদ সদস্য আনোয়ারুল আজীম আনারের অতীত বের হয়ে আসছে ক্রমেই। জানা যাচ্ছে, তিনি আন্তর্জাতিক পুলিশ সংস্থা ইন্টারপোলের ওয়ারেন্টভুক্ত ছিলেন।
হুন্ডি কারবার, চোরাচালান ও পাচারের অভিযোগে ইন্টারপোল তাঁর বিরুদ্ধে রেড নোটিশ জারি করেছিল। আওয়ামী লীগে যোগ দিয়ে, এমপি হয়ে তিনি সেই নোটিশ প্রত্যাহার করিয়ে নিতে সক্ষম হয়েছিলেন। তাঁর রাজনৈতিক বিবর্তনটাও বিস্ময়কর। স্বৈরশাসক হুসেইন মুহম্মদ এরশাদের আমলে তিনি ওই এলাকায় রাজনীতি শুরু করেছিলেন, বিকশিত হয়েছিলেন বিএনপির আমলে আর জনপ্রতিনিধি হয়েছিলেন আওয়ামী লীগের আমলে। পেয়েছিলেন সব জায়গা থেকে ‘দায়মুক্তি’! কিন্তু এমন ব্যক্তিকে বছরের পর বছর দলের মনোনয়ন দেওয়ার দায় থেকে আওয়ামী লীগ কীভাবে মুক্ত হবে?
প্রশ্ন উঠেছে প্রতিবেশী দেশে একজন বাংলাদেশি এমপির নিরাপত্তা নিয়েও। ভারতের মাটিতে একজন এমপি হিসেবে কি তিনি যথাযথ নিরাপত্তা পেয়েছিলেন? এমপি হিসেবে তো বটেই, একজন নাগরিক হিসেবেও তো তাঁর অধিক নিরাপত্তা পাওয়ার কথা ছিল। যথাযথ নিয়ম মেনেই একজন বিদেশি ভারতে প্রবেশ করে থাকেন, এমপি আনারের বেলাও তা-ই হয়েছে। তিনি ভারতের সব ধরনের নিয়ম মেনেই থেকেছেন এবং ওই দেশের সরকারকে ভ্যাট-ট্যাক্সও দিয়েছেন। তাহলে তিনি এভাবে প্রাণ হারালেন কেন? সচরাচর আমরা দেখি, বাংলাদেশে কোনো বিদেশি নাগরিক এলে সরকার তাঁকে সব ধরনের নিরাপত্তা দেয়। গোয়েন্দা সংস্থারও নজরদারিও থাকে। তাহলে কেন একজন এমপিকে ভারত সরকার নিরাপত্তা দিতে ব্যর্থ হলো?
আনারের হত্যা-রহস্য উন্মোচিত হোক, রহস্যের পেছনের রহস্য, খুনের পরিকল্পনাকারী, তাদের গডফাদারদের চরিত্র প্রকাশিত হোক, দোষীরা শাস্তি পাক—এটাই সবার প্রত্যাশা। আনারের মৃতদেহের মতো এই খুনের প্রকৃত কারণ ও কুশীলবেরা যেন গায়েব হয়ে না যায়!
লেখক: গবেষক, কলামিস্ট
সম্প্রতি ভারতের কলকাতায় একটি ফ্ল্যাটে নির্মমভাবে খুন হয়েছেন বাংলাদেশের ঝিনাইদহ-৪ আসনের সংসদ সদস্য আনোয়ারুল আজীম আনার। এই মৃত্যু নিয়ে দেশজুড়ে নানা আলোচনা ও বিতর্কের সৃষ্টি হয়েছে। একজন সংসদ সদস্যের দেশের বাইরে ‘চিকিৎসা’ করাতে গিয়ে নির্মমভাবে খুন হওয়ার ঘটনাটি বেদনার শুধু নয়, অত্যন্ত ভয়াবহও বটে। আর তাঁকে শুধু হত্যা করাই হয়নি, তাঁর শরীর থেকে মাংস ছাড়িয়ে টুকরা টুকরা করে হলুদ মেখে তা প্রথমে ফ্রিজে রাখা হয়েছে। এরপর স্যুটকেসে ভরে খালে ফেলে দেওয়া হয়েছে।
অনেক খোঁজাখুঁজির পরও তাঁর শরীরের অংশবিশেষ খুঁজে পাওয়া যায়নি। পাওয়া যাবে বলেও মনে হয় না। বলা হচ্ছে, অত্যন্ত শান্ত মাথায়, পরিকল্পনা করে হত্যা করে তাঁর অস্তিত্ব গায়েব করে ফেলা হয়েছে। এমন ঘটনা একেবারেই বিরল।
এটাও বলা হচ্ছে, ভারতের মাটিতে বসে পৈশাচিক এ হত্যাকাণ্ডটি ঘটিয়েছে বাংলাদেশেরই কয়েকজন মানুষ। দুই দেশের আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর পক্ষ থেকে এই খুনের ঘটনার পেছনে সীমান্তে চোরাচালান নিয়ে বিরোধের বিষয়কে তুলে ধরা হচ্ছে। কোনো কোনো গণমাধ্যমে বলা হচ্ছে, ব্যবসায়িক লেনদেনের সম্পর্কে কিছু বিষয়ে এমপি আনোয়ারুল আজীম আনারের ওপর ক্ষোভ ছিল তাঁর বন্ধু ও হত্যাকাণ্ডের মূল পরিকল্পনাকারী হিসেবে সন্দেহভাজন আক্তারুজ্জামান শাহীনের। ২০০ কোটি টাকার ভাগাভাগি নিয়ে নাকি আনারকে খুন করা হয়। তাঁকে আগেও একাধিকবার খুনের চেষ্টা করা হয়েছে বলে এক পুলিশ কর্মকর্তা জানিয়েছেন।
এই নৃশংস হত্যাকাণ্ডের ঘটনা সৌদি সাংবাদিক জামাল খাসোগির কথা মনে করিয়ে দেয়। সৌদি রাজতন্ত্রের এই সমালোচককে ২০১৮ সালের ৩ অক্টোবর তুরস্কের ইস্তাম্বুলে সৌদি কনস্যুলেটে গিয়ে খুন করার পর শরীর টুকরা টুকরা করা হয়। হত্যার পর ওই ব্যক্তিরা তুরস্ক ছেড়ে চলে যায়। এমপি আনারকেও হত্যার পর টুকরা টুকরা করা হয়। ঘটনার মূল হোতারা বিমানে করে নিরাপদে কলকাতা ত্যাগ করে।
খাসোগি হত্যায় যুক্ত ছিল একটা বড় রাষ্ট্রশক্তি। আর এমপি আনার হত্যায় যুক্ত একটি আঞ্চলিক চোরাচালানি চক্র। খাসোগি হত্যার শিকার হয়েছেন প্রতিবাদী সত্তার কারণে। পক্ষান্তরে আনার খুন হয়েছেন অনৈতিক কোনো ব্যবসার কর্তৃত্ব অথবা অর্থ ভাগাভাগির দ্বন্দ্বে!
আনার হত্যার ঘটনাটি ঠিক সিনেমার গল্পের মতো। কলকাতার নিউ টাউনে যে ফ্ল্যাটে আনারকে হত্যা করা হয়, সেটি এই আক্তারুজ্জামান শাহীনের ভাড়া করা। তিনি ঝিনাইদহের কোটচাঁদপুর পৌরসভার মেয়র মো. সহিদুজ্জামানের ছোট ভাই। তাঁরা ছিলেন একে অপরের বন্ধু ও ব্যবসায়িক পার্টনার। তিনি যুক্তরাষ্ট্রপ্রবাসী এবং মার্কিন পাসপোর্টধারী।
উভয়ের বিরুদ্ধেই সোনা চোরাচালান, হুন্ডিসহ আন্তর্দেশীয় বিভিন্ন অবৈধ ব্যবসার অভিযোগ রয়েছে। এ ছাড়া আনার ভারতে গিয়ে যে বন্ধুর বাসায় উঠেছিলেন, সেই গোপাল বিশ্বাসও নাকি সোনা চোরাচালানে জড়িত। ঘটনায় একটি নারী চরিত্রও আছে। ব্যবসায়ী আক্তারুজ্জামান শাহীন এমপি আনারকে হত্যার জন্য টোপ হিসেবে ব্যবহার করেন তাঁর বান্ধবী শিলাস্তি রহমানকে। কলকাতা নিউ টাউনের অ্যাপার্টমেন্টের সিসিটিভি ফুটেজে এমপি আনারকে শিলাস্তির সঙ্গে ফ্ল্যাটে প্রবেশ করতে দেখা গেছে। এই খুনের কুশীলবেরা নাকি সবাই পরস্পরের পরিচিত।
এই খুনের ঘটনায় খুলনা জেলার ‘সর্বহারা’ বা ‘চরমপন্থী’ কানেকশনও খুঁজে পাওয়া যাচ্ছে। আনারকে খুনের পরিকল্পনা বাস্তবায়নে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখেন সৈয়দ আমানুল্লাহ। তাঁর গ্রামের বাড়ি খুলনার ফুলতলার দামোদর ইউনিয়নে। তিনি একসময় চরমপন্থী সংগঠনের সঙ্গে যুক্ত ছিলেন। গণেশ নামে এক ব্যক্তিকে খুন করে যশোরের অভয়নগর থানার এক মামলায় আমানউল্লাহ সাত বছর (১৯৯১-৯৭) জেল খাটেন। ইমান আলী নামের আরেক ব্যক্তিকে খুনের ঘটনায় ২০০০ থেকে ২০১৩ সাল পর্যন্ত আবার জেল খাটেন তিনি।অবশ্য আমানউল্লাহর আসল নাম শিমুল ভূঁইয়া; যিনি খুলনায় চরমপন্থী সংগঠন পূর্ব বাংলার কমিউনিস্ট পার্টির প্রধান ছিলেন। শিমুল ভূঁইয়াই পরে আমানউল্লাহ হিসেবে নিজেকে পরিচিত করান।
ভারতে গ্রেপ্তার হওয়া ‘কসাই’ জিহাদের বাড়িও খুলনার দিঘলিয়া উপজেলার বারাকপুর ইউনিয়নে। গ্রামের বাড়িতে তাঁর স্ত্রী ও একটি ছোট ছেলে রয়েছে। দেড় বছর ধরে জিহাদ ভারতে রয়েছেন। জিহাদ ডাকাতি ও শেখ আনসার আলী হত্যা মামলার আসামি। এমন একজন ব্যক্তি কীভাবে পুলিশের চোখে ধুলা দিয়ে ভারতে চলে গেলেন, কীভাবেই-বা সেখানে অনুপ্রবেশকারী হিসেবে থাকলেন, সেই প্রশ্নের কোনো জবাব নেই।
এই খুনের প্রধান পরিকল্পনাকারী আক্তারুজ্জামান শাহীন এখনো ধরা পড়েননি। হত্যাকাণ্ডের পরিকল্পনা সাজিয়ে দিয়ে তিনি নাকি ১০ মে ঢাকায় চলে আসেন। এমপি আনারের নিখোঁজের বিষয়টি দেশে আলোচিত হলে তিনি ১৮ মে আবারও ভারত হয়ে নেপালে চলে যান। ২১ মে নেপাল থেকে চলে যান দুবাই। ২২ মে দুবাই থেকে যুক্তরাষ্ট্রে পাড়ি জমান।
আমাদের গোয়েন্দাদের কাছে কত ধরনের প্রতিবেদন থাকে, কত তথ্য থাকে। একজন যুক্তরাষ্ট্রের নাগরিক হুটহাট দেশে দেশে কীভাবে সোনা চোরাচালান নিয়ন্ত্রণ করেন? তাঁর ব্যাপারে গোয়েন্দাদের হাতে কোনো তথ্য নেই কেন? তিনি দেশে এলেন, কলকাতায় গেলেন, বাড়ি ভাড়া করলেন, খুনি ভাড়া করলেন, আবার দেশে ফিরে এলেন, দেশ থেকে কাঠমান্ডু গেলেন—গোয়েন্দারা এর কিছুই জানতে বা করতে পারলেন না, তা কি বিশ্বাসযোগ্য?
সাধারণ নাগরিকেরা একটা পাসপোর্ট করতে গিয়ে সীমাহীন ভোগান্তি পোহান। জাতীয় পরিচয়পত্রের একটা বানান সংশোধন করতে গিয়ে বাপের নাম ভোলার দশায় পড়তে হয়। অথচ শিমুল ভূঁইয়ারা কী সহজেই আমানুল্লাহ হয়ে যান। তাঁদের পরিচয়পত্র, পাসপোর্ট পেতে কোনো অসুবিধা হয় না। এমন একজন দাগি আসামি ভারতের ভিসাও পেয়ে যান কত সহজে!
বিদেশের মাটিতে গিয়ে দেশের একজন সংসদ সদস্যের এভাবে খুন হওয়াটা অত্যন্ত গ্লানির। একজন সংসদ সদস্যের চরিত্র এমন হবে কেন? তিনি কেন প্রলোভনের শিকার হলেন? কে বা কারা তাঁকে কলকাতায় নিয়ে গেল? কেন তিনি ‘চিকিৎসার’ কথা বলে কলকাতায় গিয়ে এদিক-সেদিক ঘোরাফেরা করছিলেন? পরিবারের কোনো সদস্য কেন তাঁর সঙ্গে গেলেন না? তিনি কোথায় যান, কী করেন, কার সঙ্গে মেশেন, কীভাবে টাকা উপার্জন করেন, এ প্রশ্নগুলো কী পরিবারের সদস্যরা কখনো করেছেন? যাঁর বিরুদ্ধে এত এত অভিযোগ ও মামলা, পরিবারের সদস্যরা কি কখনো এসবের সত্যতা জানতে চেয়েছেন? আমরা কেন ভুলে যাই, যা রটে, তার কিছু না কিছু বটে।
একজন ব্যক্তি যদি পরিবারের জবাবদিহির বাইরে চলে যায়, তাহলে তার দুর্নীতি ও অনিয়ন্ত্রিত জীবন বশে আনা যাবে কীভাবে? আরেকটি কথা, আনোয়ারুল আজীমকে বারবার এমপি পদে মনোনয়ন দেওয়া হচ্ছিল কেন? যাঁর বিরুদ্ধে এত অভিযোগ, এত মামলা, তাঁকেই কেন এমপি বানিয়ে আনতে হবে? ওই এলাকায় কি পরিচ্ছন্ন ইমেজের ভালো মানুষ নেই? সংবাদমাধ্যমে সংসদ সদস্য আনোয়ারুল আজীম আনারের অতীত বের হয়ে আসছে ক্রমেই। জানা যাচ্ছে, তিনি আন্তর্জাতিক পুলিশ সংস্থা ইন্টারপোলের ওয়ারেন্টভুক্ত ছিলেন।
হুন্ডি কারবার, চোরাচালান ও পাচারের অভিযোগে ইন্টারপোল তাঁর বিরুদ্ধে রেড নোটিশ জারি করেছিল। আওয়ামী লীগে যোগ দিয়ে, এমপি হয়ে তিনি সেই নোটিশ প্রত্যাহার করিয়ে নিতে সক্ষম হয়েছিলেন। তাঁর রাজনৈতিক বিবর্তনটাও বিস্ময়কর। স্বৈরশাসক হুসেইন মুহম্মদ এরশাদের আমলে তিনি ওই এলাকায় রাজনীতি শুরু করেছিলেন, বিকশিত হয়েছিলেন বিএনপির আমলে আর জনপ্রতিনিধি হয়েছিলেন আওয়ামী লীগের আমলে। পেয়েছিলেন সব জায়গা থেকে ‘দায়মুক্তি’! কিন্তু এমন ব্যক্তিকে বছরের পর বছর দলের মনোনয়ন দেওয়ার দায় থেকে আওয়ামী লীগ কীভাবে মুক্ত হবে?
প্রশ্ন উঠেছে প্রতিবেশী দেশে একজন বাংলাদেশি এমপির নিরাপত্তা নিয়েও। ভারতের মাটিতে একজন এমপি হিসেবে কি তিনি যথাযথ নিরাপত্তা পেয়েছিলেন? এমপি হিসেবে তো বটেই, একজন নাগরিক হিসেবেও তো তাঁর অধিক নিরাপত্তা পাওয়ার কথা ছিল। যথাযথ নিয়ম মেনেই একজন বিদেশি ভারতে প্রবেশ করে থাকেন, এমপি আনারের বেলাও তা-ই হয়েছে। তিনি ভারতের সব ধরনের নিয়ম মেনেই থেকেছেন এবং ওই দেশের সরকারকে ভ্যাট-ট্যাক্সও দিয়েছেন। তাহলে তিনি এভাবে প্রাণ হারালেন কেন? সচরাচর আমরা দেখি, বাংলাদেশে কোনো বিদেশি নাগরিক এলে সরকার তাঁকে সব ধরনের নিরাপত্তা দেয়। গোয়েন্দা সংস্থারও নজরদারিও থাকে। তাহলে কেন একজন এমপিকে ভারত সরকার নিরাপত্তা দিতে ব্যর্থ হলো?
আনারের হত্যা-রহস্য উন্মোচিত হোক, রহস্যের পেছনের রহস্য, খুনের পরিকল্পনাকারী, তাদের গডফাদারদের চরিত্র প্রকাশিত হোক, দোষীরা শাস্তি পাক—এটাই সবার প্রত্যাশা। আনারের মৃতদেহের মতো এই খুনের প্রকৃত কারণ ও কুশীলবেরা যেন গায়েব হয়ে না যায়!
লেখক: গবেষক, কলামিস্ট
ঢাকা-চট্টগ্রাম মহাসড়কের কুমিল্লা এলাকায় যাত্রীবাহী বাসে ডাকাতি বেড়েই চলছে। এ কারণে চালক ও যাত্রীদের কাছে আতঙ্কের নাম হয়ে উঠছে এই সড়ক। ডাকাতির শিকার বেশি হচ্ছেন প্রবাসফেরত লোকজন। ডাকাতেরা অস্ত্র ঠেকিয়ে লুট করে নিচ্ছে সর্বস্ব। আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর পরিচয়েও ঘটছে ডাকাতির ঘটনা।
০২ মার্চ ২০২৫বিআরটিসির বাস দিয়ে চালু করা বিশেষায়িত বাস র্যাপিড ট্রানজিট (বিআরটি) লেনে অনুমতি না নিয়েই চলছে বেসরকারি কোম্পানির কিছু বাস। ঢুকে পড়ছে সিএনজিচালিত অটোরিকশা, ব্যাটারিচালিত অটোরিকশা। উল্টো পথে চলছে মোটরসাইকেল। অন্যদিকে বিআরটিসির মাত্র ১০টি বাস চলাচল করায় সোয়া চার হাজার কোটি টাকার এই প্রকল্প থেকে...
১৬ জানুয়ারি ২০২৫গাজীপুর মহানগরের বোর্ডবাজার এলাকার ইসলামিক ইউনিভার্সিটি অব টেকনোলজির (আইইউটি) মেকানিক্যাল ইঞ্জিনিয়ারিং বিভাগের শিক্ষার্থীরা পিকনিকে যাচ্ছিলেন শ্রীপুরের মাটির মায়া ইকো রিসোর্টে। ঢাকা-ময়মনসিংহ মহাসড়ক থেকে বাসগুলো গ্রামের সরু সড়কে ঢোকার পর বিদ্যুতের তারে জড়িয়ে যায় বিআরটিসির একটি দোতলা বাস...
২৪ নভেম্বর ২০২৪ঝড়-জলোচ্ছ্বাস থেকে রক্ষায় সন্দ্বীপের ব্লক বেড়িবাঁধসহ একাধিক প্রকল্প হাতে নিয়েছে সরকার। এ লক্ষ্যে বরাদ্দ দেওয়া হয়েছে ৫৬২ কোটি টাকা। এ জন্য টেন্ডারও হয়েছে। প্রায় এক বছর পেরিয়ে গেলেও ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠানগুলো কাজ শুরু করছে না। পানি উন্নয়ন বোর্ডের (পাউবো) তাগাদায়ও কোনো কাজ হচ্ছে না বলে জানিয়েছেন...
২০ নভেম্বর ২০২৪