Ajker Patrika

শব্দের আড়ালে গল্প: ষোলোকলা

রাজীব কুমার সাহা
শব্দের আড়ালে গল্প: ষোলোকলা

বাংলা ভাষায় ষোলোআনার মতোই সুপরিচিত একটি শব্দ হলো ষোলোকলা। সাধারণত পরিস্থিতির প্রসঙ্গভেদে কোনো ব্যক্তি বা বিষয়ের ক্ষেত্রে পরিপূর্ণতা বা অধঃপতনের সামগ্রিক ভাব প্রকাশে আমরা ষোলোকলা শব্দটির প্রয়োগ করি। কিন্তু সাধারণভাবে মনে হতে পারে, এই ষোলো জাতের কলা আবার কী কী? অথবা এই ষোলোকলা পরিপূর্ণ হলে প্রয়োগভেদে শব্দটি ইতিবাচক এবং নেতিবাচক উভয় অর্থে কীভাবে প্রযুক্ত হয়? আমরা কি জানি এই ষোলোকলার গূঢ় কথা কী? তবে প্রথমেই বলে রাখি, এই কলা ভক্ষণযোগ্য কোনো কলা নয়। এর সূত্র ধরে চলুন আজ উন্মোচন করি ষোলোকলার ষোলোআনা। 

বাংলা ‘ষোলো’ ও সংস্কৃত ‘কলা’ শব্দ সহযোগে গঠিত হয়েছে ‘ষোলোকলা’ শব্দটি। শব্দটি প্রয়োগভেদে ক্রিয়াবিশেষণ ও বিশেষ্য রূপ প্রকাশ করে। শব্দটির আভিধানিক অর্থ হলো সম্পূর্ণরূপে বা সম্পূর্ণভাবে (ক্রিয়াবিশেষণ) এবং চন্দ্র বা চাঁদের ষোলোটি অংশ (বিশেষ্য)। মূলত চন্দ্রের ষোলোকলা থেকে ষোলোকলা ভুক্তিটি বাংলা ভাষায় গৃহীত হয়েছে। ইতিবাচক অর্থে ষোলোকলা পূর্ণ হওয়া মানে হলো কোনো বিষয় সম্পূর্ণরূপে সংঘটিত হওয়া বা সর্বাঙ্গসুন্দর হওয়া। 

ষোলোকলার সূত্র সন্ধানে চাঁদ সম্পর্কিত কিছু প্রাসঙ্গিক তথ্য আমরা জেনে নিতে পারি। সূর্যের মতোই চাঁদ পূর্বদিকে ওঠে আর পশ্চিম দিকে অস্ত যায়। চাঁদের এক দিন (অর্থাৎ চাঁদ নিজের অক্ষের ওপর একবার ঘুরতে যে সময় নেয়) পৃথিবীর প্রায় এক মাসের সমান। চাঁদের নিজস্ব কোনো আলো নেই। সূর্যের আলো চাঁদের পিঠে প্রতিফলিত হয়ে পৃথিবীতে এসে পৌঁছায়। পৃথিবীর যে জায়গায় দাঁড়িয়ে আমরা চাঁদ দেখি, সেখান থেকে চাঁদের যে আলোকিত অংশটি দেখতে পাই, সেটাকেই সেই সময়ের চাঁদের একটা নির্দিষ্ট তিথি বলছি। তাই চাঁদ দেখা সর্বদাই চাঁদ, পৃথিবী ও সূর্যের পারস্পরিক অবস্থানের ওপর নির্ভরশীল। 

চাঁদের আকারের পরিবর্তন বলতে অনেকে মনে করেন যে দৃশ্যান্তরে চাঁদ ছোট বা বড় হয়ে যায়। আসলে তা নয়, চাঁদ একই রকম থাকে। তার ওপর আলো পড়ে যতটকু দেখা যায়, সেটারই পরিবর্তন সূচিত হয়। পুরো চাঁদ দৃশ্যমান হলে পূর্ণিমা আর একটুও দৃশ্যমান না হলে হয় অমাবস্যা। দিনের বেলায়ও চাঁদ থাকে, তবে সূর্যের আলোর কারণে তা দৃশ্যমান হয় না। চাঁদের হ্রাস-বৃদ্ধির ব্যাপারটি খুবই প্রাকৃতিক নিয়ম মেনে চলে। চাঁদ যখন পৃথিবী ও সূর্যের মাঝখানে চলে আসে, তখন চাঁদের যে দিকটা পৃথিবীর দিকে থাকে, সেটাতে কোনো আলো পড়ে না। ফলে সেদিকে পুরোটাই অন্ধকার। তখন চাঁদের অমাবস্যা। পরদিন চাঁদ কিছুটা ঘুরে যায় তার কক্ষপথে। পৃথিবী থেকে আমরা তার কাস্তের মতো চিকন একটা অংশ দেখতে পাই। শুরু হয় শুক্লপক্ষ। চাঁদ যখন অমাবস্যা থেকে পূর্ণিমার দিকে যায় তখন শুক্লপক্ষ, আবার যখন পূর্ণিমা থেকে অমাবস্যার দিকে যায়, তখন হয় কৃষ্ণপক্ষ। চন্দ্রের আলোকিত অংশের এই হ্রাস-বৃদ্ধির একেকটি অধ্যায়কে বলা হয় কলা বা চন্দ্রকলা। এই চন্দ্রকলার সংখ্যা সর্বমোট ষোলো। ষোলোটি কলাকে একত্রে বলা হয় ষোলোকলা। প্রতিটি কলার আলাদা আলাদা নাম রয়েছে। চন্দ্রের কলাগুলো হলো: অমৃতা, মানদা, পূষা, তুষ্টি, পুষ্টি, রতি, ধৃতি, শশিনী, চন্দ্রিকা, কান্তি, জ্যোৎস্না, শ্রী, প্রীতি, অক্ষদা, পূর্ণা এবং পূর্ণামৃতা। ষোলোটি কলা পূর্ণ হলে তবেই চাঁদের পূর্ণিমা ও অমাবস্যা সম্পন্ন হয়। চাঁদের এই ষোলোটি কলা থেকেই প্রকৃতপক্ষে ‘ষোলোকলা’ শব্দের উৎপত্তি। 

কবিগুরু রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর তাঁর ‘নষ্টনীড়’ গল্পে ষোলোকলা শব্দটি প্রয়োগ করেছেন এভাবে: ‘অমাবস্যার অতলস্পর্শ অন্ধকারের মধ্যে ষোলোকলা চাঁদের সমস্ত আলোক স্তরে স্তরে আবদ্ধ হইয়া আছে।’ আবার শরৎচন্দ্র চট্টোপাধ্যায় তাঁর ‘দত্তা’ উপন্যাসে লিখেছেন: ‘বাপের স্বভাব একেবারে ষোলকলায় পেয়েছে দেখতে পাচ্চি।’ এ ছাড়াও ষোলোকলা শব্দটি অনেক কবি-সাহিত্যিক কারও অধঃপতন হওয়া অর্থেও প্রযুক্ত করেছেন। যেমন বলা হয়ে থাকে, ‘ওর পাপের ঘড়া ষোলোকলা পূর্ণ হয়েছে।’ 

পরিশেষে ষোলোকলা পূর্ণ হওয়ার একটি বাস্তবিক উদাহরণ দিয়ে ভুক্তিটি শেষ করছি। ২০১৫ সালের একটি খবরে একটি পরিবারের অপরাধমূলক কর্মকাণ্ডের ষোলোকলা পূর্ণ হওয়ার গল্প প্রকাশিত হয়। গল্পটি এমন—‘মাদকসহ বড় ছেলে ধরা পড়েন ফেব্রুয়ারি মাসে। পরের মাসে একই অপরাধে গ্রেপ্তার হন ছোট ছেলে। এপ্রিল মাসে মাদক বিক্রি করার সময় গ্রেপ্তার করা হয় স্ত্রীকে। তিনজনই এখন কারাগারে রয়েছেন। সব শেষে ইয়াবা ও গাঁজাসহ ধরা পড়লেন গৃহকর্তা রহমত উল্লাহ।’ ঠিক এভাবেই একটি পরিবারের অপরাধের ষোলোকলা পূর্ণ হয়েছিল। সুতরাং, চলুন অসৎ কর্মে ষোলোকলা পূর্ণ না করে সমগ্র মানব জাতির কল্যাণে ষোলোআনা ব্রতী হই।

লেখক: রাজীব কুমার সাহা
আভিধানিক ও প্রাবন্ধিক

Google News Icon

সর্বশেষ খবর পেতে Google News ফিড ফলো করুন

এলাকার খবর
খুঁজুন

পাঠকের আগ্রহ

সম্পর্কিত