চুয়াডাঙ্গার জীবননগর, দামুড়হুদা, ঝিনাইদহের মহেশপুরসহ আশপাশের এলাকার চাষিরা আগে বিভিন্ন কোম্পানির ও নিজ ব্যবস্থায় সংরক্ষিত বীজের মাধ্যমে আলু চাষ করতেন। আলুর জাতও ছিল হাতেগোনা কয়েকটি। একদিকে চাষিরা সঠিক প্রক্রিয়ায় আলুর বীজ সংরক্ষণ করতে না পারায় লোকসানে পড়তেন, অন্যদিকে নামমাত্র অনেক কোম্পানি দ্বারা প্রতারিত হতো।
তবে ২০১৭ সালে বিএডিসির অধীনে জীবননগরের দত্তনগর হিমাগার নির্মিত হওয়ায় আলুচাষিদের দুশ্চিন্তা কমেছে। এ বছর এই হিমাগার থেকে ১০ জাতের ১ হাজার ৮৬৫ মেট্রিক টন বীজ আলু সরবরাহ করা হয়েছে। আর চুক্তিবদ্ধ চাষি হিসেবে এ বছর ৩০৪ জনের মতো কৃষক দত্তনগর হিমাগারের অধীনে ১৪৪ একর জমিতে বীজ আলুর চাষ করেছেন। অধিক ফলনের পাশাপাশি ভালো দাম পাওয়ায় এবার কৃষকদের আগ্রহের শীর্ষে রয়েছে সানশাইন, শান্তানা ও লেবেলা জাতের আলু।
দত্তনগর হিমাগার সূত্রে জানা গেছে, তাদের অধীনে চুক্তিবদ্ধ কৃষকেরা সানশাইন ১৯ একর, লেবেলা ৩ একর, শান্তানা ৫ একর, ডায়মন্ড ১০ একর, এসটেরিক্স ৬০ একর, কার্ডিনাল ৪৮ একর জমিতে চাষ করেছেন। ১০১ মেট্রিক টন বীজ আলু চুক্তিবদ্ধ কৃষকসহ এ হিমাগার থেকে সারা দেশে সরবরাহ করা হয়। এ বছর দত্তনগর হিমাগারে বীজ আলুর সংরক্ষণ লক্ষ্যমাত্রা ২ হাজার মেট্রিক টনের বেশি নির্ধারণ করা হয়েছে।
আলুর মাঠ ঘুরে দেখা যায়, দত্তনগর হিমাগারের তত্ত্বাবধানে রোপণ করা বীজ আলুগাছের বয়স ৪০-৫০ দিনের মতো হয়েছে। আবহাওয়া অনুকূল ও বীজ ভালো হওয়ায় এবার আলুর গাছও ভালো হয়েছে। আর এক থেকে দেড় মাস আবহাওয়া অনুকূল থাকলে ভালোভাবে বীজ আলু উৎপাদন করতে পারবেন বলে জানিয়েছেন চাষিরা।
জীবননগর উপজেলার মিনাজপুর গ্রামের হুজুর আলী বলেন, ‘গত বছর বিএডিসি থেকে সানশাইন জাতের আলুর বীজ নিয়ে আমাদের ব্লকে এক একর জমিতে চাষ করা হয়েছিল। ফলন ভালো হওয়ায় এবার চার একর জমিতে সানশাইন জাতের আলুর চাষ করা হয়েছে। বীজ ভালো হওয়ায় চারা অনেক ভালো হয়েছে। আশা করছি, ভালো ফলন হবে।’
মিনাজপুর মাঠপাড়ার আলু চাষি সোহেল রানা বলেন, ‘এবার আমাদের ব্লকে ছয় একর জমিতে আলু চাষ হয়েছে। এর মধ্যে আমি নিজে লেবেলা আড়াই বিঘা ও সানশাইন দেড় বিঘা চাষ করেছি। সানশাইন আলুর বীজ কাটার সময় একটু সাবধানতা অবলম্বন করতে হয়। কারণ এই আলুর বীজে একদিকে চোখ থাকে। অন্য আলুর মতো কাটলে অর্ধেক আলু থেকে চারা বের হবে না।’
মো. আবু বক্কর বলেন বলেন, ‘বিএডিসির বীজের মান ভালো হওয়ায় আমরা প্রতি বছর সেখান থেকে বীজ সংগ্রহ করি। তাঁরা নিয়মিত মাঠ পরিদর্শন করেন। চারা লাগানো থেকে শুরু করে আলু তোলা পর্যন্ত বিএডিসির স্যারেরা পরামর্শ দেন। আলু তোলার পর তাঁদের নির্দেশনা মতো আলু বাছাই করলে তাঁরা গাড়িতে করে হিমাগারে নিয়ে যান। আমাদের কোনো ঝামেলা থাকে না। আর বাকি আলু আমরা বাইরে বিক্রি করি। কিছু সংরক্ষণ করি।’
সাদ্দাম হোসেন বলেন, ‘গত বছর এসটেরিক্স জাতের আলুর চাষ করেছিলাম। তবে অধিক ফলন হওয়ায় এবার চার বিঘা জমিতে সানশাইন জাতের আলু লাগিয়েছি। এবার বীজ ভালো হওয়ায় গাছ অনেক ভালো হয়েছে। এটা হাইব্রিড এবং অধিক ফলনশীল জাত হওয়ায় বীজ কাটা থেকে শুরু করে রোপণ, সেচ ও পরিচর্যার সময় সতর্কতা অবলম্বন করতে হয়।’
মোহাম্মদ আলী বলেন, ‘আমরা মূলত বীজ আলু উৎপাদন করি। আলু বীজ বিএডিসি থেকে দেয়। কারও চাষের খরচ না থাকলে তারা কৃষি ব্যাংকের মাধ্যমে ঋণের ব্যবস্থা করে দেন।’
দত্তনগর হিমাগারের উপপরিচালক কৃষিবিদ ফরিদুল ইসলাম বলেন, ‘বিএডিসির চুক্তিবদ্ধ কৃষকের উৎপাদিত আলু গ্রেডিং করার পর সরকারনির্ধারিত দামে কিনে আমরা হিমাগারে সংরক্ষণ করি। রোপণের সময় আমরা সরকারনির্ধারিত দামে কৃষকদের কাছে বিক্রি করি। আর আলু রোপণ থেকে শুরু করে তোলা পর্যন্ত আমরা নিয়মিত মাঠ পরিদর্শন করি। কৃষকের পরামর্শ দিই। সহজ শর্তে আমাদের চুক্তিবদ্ধ চাষিদের কৃষি ব্যাংকের মাধ্যমে ঋণের ব্যবস্থাও আমরা করে দিই।’
কৃষিবিদ ফরিদুল ইসলাম আরও বলেন, সানশাইন, শান্তানা ও লেবেলা জাতের আলু খুবই উচ্চফলনশীল। এগুলো খেতে সুস্বাদু, রপ্তানি উপযোগী এবং শিল্পে ব্যবহার করা হয়। শান্তানাটা ফ্রেঞ্চফ্রাই তৈরিতে ব্যবহার করা হয়। ফ্রেঞ্চফ্রাই তৈরির জন্য আমাদের আলু আমদানি করতে হয়। শান্তানা জাতের আলু উৎপাদন বাড়াতে পারলে এবং পরিচিতি বাড়লে আমাদের আর আমদানি করার প্রয়োজন হবে না।’
এ বিষয়ে জানতে চাইলে কৃষিবিদ ফরিদুল ইসলাম আজকের পত্রিকাকে বলেন, ‘বিদেশে, বিশেষ করে ইউরোপের মানুষ সানশাইন আলু পছন্দ করে। বিএডিসির মাধ্যমে বিগত তিন বছর ধরে মালয়েশিয়া ও রাশিয়ায় এই আলু রপ্তানি করা হচ্ছে। এই অঞ্চলে লাল আলুর চাহিদা প্রচুর। লাল আলুর পুরোনো জাত কার্ডিনাল। সেটার পরিবর্তে আমরা লেবেলা জাতের আলুর পরিচিত করানোর চেষ্টা করছি। এই অঞ্চলে ইতিমধ্যে লেবেলা জাতের আলুর চাষ শুরু হয়েছে। কৃষকেরা এই জাত নিয়ে উচ্চ আশা প্রকাশ করছেন।’