হোম > সারা দেশ

নিজের চাপ কমাতে অন্যের ওপর গলা চড়াচ্ছে চীন

তাসনিম মহসিন

ঢাকা: বাংলাদেশের ও চীনের মধ্যে বেশ উষ্ণ সম্পর্ক বিদ্যমান। বাংলাদেশের বহু উন্নয়ন প্রকল্পে দেশটির বিনিয়োগ রয়েছে। এ ছাড়া সাম্প্রতিক করোনাভাইরাস মহামারির সময়েও চীনকে বন্ধুর মতো করেই পাশে পেয়েছে বাংলাদেশ। এমনকি এই কয়েক দিন আগে যখন করোনার টিকা পাওয়া–না পাওয়া নিয়ে দোলাচল শুরু হয় তখনো চিন তার সিনোভ্যাক টিকা নিয়ে পাশে দাঁড়িয়েছে। এমন সুন্দর সম্পর্কের মধ্যেই গতকাল সোমবার হঠাৎ করেই বাংলাদেশে নিযুক্ত চীনের রাষ্ট্রদূত লি জিমিং কোয়াড নিয়ে বেশ কড়া হুঁশিয়ারি উচ্চারণ করেছেন, যা সবাইকে নড়েচড়ে বসতে বাধ্য করেছে। কূটনীতিকেরা মনে করেছন, বৈশ্বিক ও আঞ্চলিক নানা চাপ সামলাতে গিয়ে চীন নিয়ন্ত্রণ হারিয়েছে। তাই অন্যের ওপর গলা চরাচ্ছে তারা।

চীন বর্তমান বিশ্বের অন্যতম বড় বাণিজ্যিক শক্তি। যুক্তরাষ্ট্রের নেতৃত্বাধীন একমেরু বিশ্বকাঠামোয় নিজের হিস্যা বুঝে নিতে লড়ছে দেশটি। যুক্তরাষ্ট্রও বসে নেই। এশিয়াসহ গোটা বিশ্বে নিজেদের প্রভাব বাড়াতে নানা কৌশল ও জোট গঠনের পরিকল্পনা করছে দেশটি। এ ক্ষেত্রে ইউরোপের পরীক্ষিত মিত্রদের নিজের পাশে পাচ্ছে যুক্তরাষ্ট্র। সঙ্গে চীনের প্রতিবেশীদের মধ্যেও অনেককে পাশে পাচ্ছে ওয়াশিংটন।

কোভিড-১৯, তাইওয়ান, হংকং, দক্ষিণ চীন সাগরসহ বিভিন্ন ইস্যুতে চীনের বিরুদ্ধে যুক্তরাষ্ট্রের নেতৃত্বে বিশ্বের ক্ষমতাধর দেশগুলোর অবস্থান। চীনকে কোনঠাসা করতে মার্কিন নেতৃত্বে গড়ে উঠেছে কয়েকটি জোট। এগুলো নিয়ে চীন আগে খুব একটা সোচ্চার না থাকলেও বর্তমানে নিজেদের অবস্থান ধরে রাখতে সোচ্চার হয়েছে। দীর্ঘ দিন ধরে শুধু মার্কিন নেতৃত্বে ভারত, জাপান, অস্ট্রেলিয়া বা দক্ষিণ চীন সাগরের কয়েকটি দেশ নিজ স্বার্থে চীন বিরোধিতা করে আসছিল। তবে এবার পুরো অঞ্চলের দেশগুলোকে এ জোটে টানার চেষ্টা করছে যুক্তরাষ্ট্র। ইন্দো প্যাসিফিক কৌশলের (আইপিএস) মাধ্যমে ভারত মহাসাগর অঞ্চলের দেশগুলোকে কাছে টানছে যুক্তরাষ্ট্র। গঠন করা হয়েছে কৌশলগত জোট কোয়াড, যেখানে রয়েছে যুক্তরাষ্ট্র, জাপান, ভারত ও অস্ট্রেলিয়া।

সম্প্রতি কোয়াডের দেশগুলো কোভিড-১৯ পরিস্থিতি নিয়ে বৈঠক করেছে। আর এ বৈঠক থেকে আসিয়ানভুক্ত দেশ ও আইপিএসের সদস্য রাষ্ট্রগুলোকে ১০০ কোটি ডোজ টিকা দেওয়ার ঘোষণা দেয়া হয়। এতে টিকার ফর্মূলা দেবে যুক্তরাষ্ট্র এবং অর্থায়ন করবে জাপান ও অস্ট্রেলিয়া। আর টিকা উৎপাদন করবে ভারত। আর এটাই নতুন করে মাথা ব্যাথার কারণ হয়ে দাঁড়িয়েছে চীনের জন্য। কারণ আসিয়ানের দেশগুলোর সবাই চীনের প্রতিবেশী। দীর্ঘ দিন ধরে চীন এ দেশগুলোর ওপর এক ধরনের নিয়ন্ত্রণ করে আসছিল।

বিশ্লেষকদের মতে, বিশ্বের দেশগুলোকে যুক্তরাষ্ট্র ও চীন নিজের দিকে টানার চেষ্টা করছে। যুক্তরাষ্ট্র ও চীনের সম্পর্ক টানাপোড়েন যত বাড়বে, অন্য দেশগুলাকে ততই বিপদে পড়তে হবে। বাংলাদেশ কখনোই কোনো নিরাপত্তা জোটে অংশ নেয়নি। কুয়েত বা ইরাক যুদ্ধে যুক্তরাষ্ট্র থেকে বাংলাদেশের কাছে জোটভুক্ত হওয়ার প্রস্তাব ছিল। কিন্তু বাংলাদেশ যায়নি। পররাষ্ট্রনীতির কারণেই বাংলাদেশের কাঠামোতে সামরিক দিকে যাওয়ার সুযোগ নেই। কিন্তু বাংলাদেশ যেহেতু সামরিক অংশ বাদ দিয়ে আইপিএসে যোগ দেওয়ার কথা বলেছে, তাই বাংলাদেশের ওপর চীনের তীক্ষ্ণ নজর পড়েছে। আর এমন পরিস্থিতিতেই গতকাল সোমবার চীন অনেকটা হঠাৎ করেই এমন হুঁশিয়ারি দিয়েছে।

গতকাল সোমবার বাংলাদেশে নিযুক্ত চীনের রাষ্ট্রদূত লি জিমিং এক ভার্চ্যুয়াল সংবাদ সম্মেলনে বলেন, যুক্তরাষ্ট্র, জাপান, ভারত ও অস্ট্রেলিয়ার কৌশলগত জোট কোয়াডকে চীনবিরোধী একটি ছোট গোষ্ঠী হিসেবে বিবেচনা করে বেইজিং। তাই চীন মনে করে, এতে যেকোনোভাবে বাংলাদেশের অংশগ্রহণ ঢাকা-বেইজিং সম্পর্ককে ‘যথেষ্ট খারাপ’ করবে।

এমন বক্তব্যের প্রতিক্রিয়ায় পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয় বলছে, বাংলাদেশ সমতা বজায় রেখেই দেশগুলোর সঙ্গে সম্পর্ক রাখবে। কোনো দেশের শত্রু বাংলাদেশের শত্রু হবে, তা ভাবার কোনো কারণ নেই। এটি বাংলাদেশের পররাষ্ট্রনীতির বাইরে। বাংলাদেশের প্রধান লক্ষ্য—জনগনের উন্নয়ণ। এ জন্য সব দেশের সঙ্গে বন্ধুত্বপূর্ণ সম্পর্ক বজায় রেখে অর্থনৈতিক উন্নয়নে কাজ করবে বাংলাদেশ।

তবে এমন বক্তব্য সুনির্দিষ্ট প্রশ্নের প্রেক্ষাপটেই এসেছে বলে মনে করেন ঢাকায় নিযুক্ত পশ্চিমা মিশনের কর্মকর্তারা। তাঁরা বলছেন, চীনা রাষ্ট্রদূতকে একটি প্রশ্ন করা হয়েছিল। তার উত্তর তিনি দিয়েছেন। প্রশ্নটি এই মুহূর্তে একটু অন্য রকম হলেও সমসাময়িক ছিল। বিশেষ করে চীন যেভাবে তার কূটনীতিকে পরিচালনা করে, তার তুলনায় এর উত্তর অন্য সময়ের থেকে বেশি জোরালো ছিল। বিগত দিনগুলোর পরিস্থিতি, চীনের প্রতিরক্ষামন্ত্রীর ঢাকা সফর, টিকা কূটনীতিসহ সামনের দিনে চীনের অবস্থানের একটি পরিষ্কার বার্তা এই বক্তব্যের মধ্য দিয়ে দিয়েছে বেইজিং।

চীনের হুমকির বিষয়ে বাংলাদেশের অবস্থান জানতে চাইলে পররাষ্ট্রমন্ত্রী এ কে আবদুল মোমেন বলেন, ‘ন্যাচারালি তিনি একটি দেশের প্রতিনিধিত্ব করেন। তাঁরা হয়তো এটা চায় না। তিনি তাঁর বক্তব্য বলবেন। যে প্রতিষ্ঠানের কথা বলেছেন, সে প্রতিষ্ঠানের লোকজন আমাদের কাছে অ্যাপ্রোচও করে নাই। এটা একটু আগ বাড়িয়ে বলা হয়েছে। আমরা এটা নিয়ে খুব একটা... উনি বলেছেন, ফাইন, দ্যাটস মাচ। এটা নিয়ে আমাদের বিশেষ বক্তব্য নাই। বাট উই উইল ডিসাইড হোয়াট টু ডু (কিন্তু আমরা ঠিক করবে যে, আমরা কী করব)। আমরা আমাদের জনগণের জন্য, মাননীয় প্রধানমন্ত্রী এত দিন ধরে দেখেছেন। বহু সময় বহু লোক বহু কিছু বলেছেন। কিন্তু আমাদের দেশের স্বার্থের ব্যপারে, আমাদের দেশের মঙ্গলের জন্য, যা যা করার, আমরা সেটাই করেছি। উই মেইনটেইন আ নন অ্যালাইন (জোটনিরপেক্ষ) এবং একটি ব্যালেন্স ফরেন পলিসি (ভারসাম্যপূর্ণ পররাষ্ট্রনীতি)। অ্যান্ড উই কনটিনিউ টু ডু ইট (আমরা এই ধারাবাহিকতা ধরে রাখব)।’

চীনের বক্তব্যটিকে ভাষাগত দিক থেকে বিবেচনা করছেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের আন্তর্জাতিক সম্পর্ক বিভাগের অধ্যাপক ইমতিয়াজ আহমেদ। আজকের পত্রিকাকে তিনি বলেন, ‘চীনা রাষ্ট্রদূত প্রশ্নের পরিপ্রেক্ষিতে উত্তর দিয়েছেন। আর চীনের তো একটি অবস্থান রয়েছেই। কোয়াড বা আইপিএস হলো একটি সামরিক জোট। ফলে এখানে চীন বাংলাদেশকে এর অংশীদার হিসেবে দেখতে চায় না। ব্রিটিশরা বললে হয়তো আরও পরিশীলিত ভাষায় বলত। চীনারা ভাষাগত দিক থেকে একটু সরাসরি বলেছে।’

এদিকে চীনের রাষ্ট্রদূতকে পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ে তলব করে বাংলাদেশের অবস্থান জানিয়ে দেওয়ার গুঞ্জন উঠেছে। চীনের রাষ্ট্রদূতকে তাঁর মন্তব্যের জন্য তলব করা হবে কি না—জানতে চাইলে পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের দায়িত্বশীল একটি সূত্র জানায়, ‘এখনো সে রকম কোনো সিদ্ধান্ত হয়নি। তবে এ বিষয়ে এখনো পরিষ্কার কোনো সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়নি যে, তলব করা হবে না। তাঁর সঙ্গে আমরা কথা বলব।’

এ নিয়ে পররাষ্ট্রমন্ত্রী এ কে আবদুল মোমেন বলেন, ‘আমরা কী করি–না করি, তা আমরা সব মিডিয়াকে বলি না। উই হ্যাভ ভিশন...ওয়েস অব ডুয়িং থিংস (আমাদের নিজস্ব লক্ষ্য ও কাজের ধরন আছে)।’

২০১৬ সালের অক্টোবরের মাঝামাঝি চীনের রাষ্ট্রপতি সি চিন পিং বাংলাদেশ সফর করেন। সফরে মধ্য দিয়ে দুই দেশের সহযোগিতামূলক সম্পর্ক কৌশলগত সম্পর্কে উন্নীত হয়। সে সময় দেশের ২৭টি প্রকল্পে ২ হাজার ৪০০ কোটি মার্কিন ডলার ঋণ প্রদানে সমঝোতা স্মারক (এমওইউ) সই হয়। এরই অংশ হিসেবে ২০১৭ সালকে দুই দেশের জন্য বন্ধুত্বের বছর হিসেবে ঘোষণা করেছিলেন চীনের প্রেসিডেন্ট। ২০২০ সালের মধ্যে ওই ২৭ প্রকল্পের সই হওয়া সমঝোতা স্মারকগুলো ঋণ চুক্তিতে বাস্তবায়নের মেয়াদকাল ধরা হয়েছিল। তবে ২০২০ সালের মে পর্যন্ত এ ২৭ সমঝোতার মাত্র ছয়টি ঋণ চুক্তিতে রূপান্তর হয়েছে। আর ২১টি প্রকল্পের ক্ষেত্রে ঐকমত্যে পৌঁছাতে পারেনি চীন-বাংলাদেশ। তবে এর মধ্যেই আরও নয়টি প্রকল্পে মোট ৬৪১ কোটি ৪৮ লাখ ডলার চেয়েছে বাংলাদেশ।

বাংলাদেশে এ মুহূর্তে চীনের ঋণে যেসব প্রকল্প চলমান, তার মধ্যে রয়েছে ৫০ কোটি ডলারের ‘ইনস্টলেশন অব সিঙ্গেল পয়েন্ট মুরিং উইথ ডাবল পাইপলাইন’, ২০ কোটি ডলারের ‘মর্ডানাইজেশন অব টেলিকমিউনিকেশন নেটওয়ার্ক ফর ডিজিটাল কানেক্টিভিটি’, ১৬৫ কোটি ৮৫ লাখ ডলারের ‘পদ্মা ব্রিজ রেল লিংক (ফেজ-১)’ ও ৯১ কোটি ৭১ লাখ ডলারের ‘পদ্মা ব্রিজ রেল লিংক (ফেজ-২)’ প্রকল্প। এ ছাড়া ‘ডেভেলপমেন্ট অব ন্যাশনাল আইসিটি ইনফ্রা-নেটওয়ার্ক ফর বাংলাদেশ গভর্নমেন্ট ফেজ-৩’ ও ‘কনস্ট্রাকশন অব টানেল আন্ডার দ্য রিভার কর্ণফুলি’ প্রকল্পের কথাও উল্লেখ করা যায়। এ দুই প্রকল্পের সম্ভাব্য ব্যয় ধরা হয়েছে যথাক্রমে ১৫ কোটি ও ৭০ কোটি ৫৮ লাখ ডলার। এখন পর্যন্ত প্রায় ১০০ কোটি ডলারের বেশি ঋণের অর্থ ছাড় করেছে চীন। এর বাইরে সররকারি ব্যবস্থানায় পায়রায় কয়লাভিত্তিক বিদ্যুৎকেন্দ্র এবং চট্টগ্রামে এস আলম গ্রুপের একটি কয়লাভিত্তিক বিদ্যুৎকেন্দ্রের কাজ করছে চীনারা।

এ বিষয়ে নাম প্রকাশ না করার শর্তে পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের ঊর্ধ্বতন এক কর্মকর্তা আজকের পত্রিকাকে বলেন, ‘চীনের এ আচরণে আমরা বিরক্ত হয়েছি কথাটা পুরোপুরি ঠিক না হলেও ভুল না। এটাকে এককথায় বিরক্ত না বলে অপ্রত্যাশিত বলাটা ঠিক হবে। কারণ, বিরক্ত শব্দের আলাদা অর্থ রয়েছে। চীনের একজন রাষ্ট্রদূতের কাছ থেকে আমরা এ রকম আচরণ প্রত্যাশা করিনি। চীনকে এ নিয়ে তলব করা হবে কি না, তা নিয়ে আলোচনা চলছে। চীনের রাষ্ট্রদূতকে তলব করার বিষয়টি নিয়ে এ মুহূর্তে নানা হিসাব করা হচ্ছে। শুধু চীনা প্রকল্প নয়, চীনা টিকারও প্রয়োজন রয়েছে বাংলাদেশের। ফলে জনগণের স্বার্থে যেটি ভালো হবে, আলোচনা করে সেই সিদ্ধান্তই নেওয়া হবে।

মাগুরায় শ্রমিকনেতার মরদেহ উদ্ধার

লক্ষ্মীপুরে ড্রাম ট্রাকের ধাক্কায় অটোরিকশার দুই যাত্রী নিহত

বাটা শো-রুমে আগুনের সূত্রপাত গোডাউন থেকে: ফায়ার সার্ভিস

মেঘনা নদীতে মাটি বহনকারী দুই বাল্কহেডসহ আটক ৯

ফকিরহাটে ৫ তুলার গুদামে আগুন লেগে ২ কোটি টাকার ক্ষতি

স্বর্ণ ও ইয়াবার বিনিময়ে অনুপ্রবেশ রোহিঙ্গাদের

রাজশাহীতে সম্মেলনের পর ব্যানার-ফেস্টুন সরিয়ে নিল জামায়াত

মুন্সিগঞ্জে পূর্বশত্রুতার জেরে যুবককে গুলি করার অভিযোগ

শ্রীপুরে কারখানায় বয়লার বিস্ফোরণে ২০ শ্রমিক আহত

পদ্মায় বড়শিতে আটক ৯ কেজির বোয়াল, ‘কম দামে’ বিক্রি

সেকশন