রাজধানীর নিউমার্কেট এলাকার ব্যবসায়ীদের সঙ্গে ঢাকা কলেজের শিক্ষার্থীদের সংঘর্ষকালে নিহত ডেলিভারিম্যান নাহিদ হাসান ও দোকান কর্মচারী মোরসালিনের পরিবারে ঈদের ছোঁয়া লাগেনি। নিহত দুই তরুণের পরিবারের সদস্যদের চোখে মুখে প্রিয়জন হারানোর বিষাদের ছায়া। রাজধানীবাসীর ঈদের খুশির দিনটি তাদের কাছে বেদনা ভারাক্রান্ত।
সম্পূর্ণ অপরিচিত হলেও ঈদে দুই পরিবারে একই বেদনার পাহাড়। দুজনেই ঢাকা কলেজের শিক্ষার্থীদের হাতে আহত হয়ে ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে মারা যান। দুজনেরই দাফন হয়েছে আজিমপুর কবরস্থানে। দুই পরিবারেরই ঈদ করতে গ্রামে যাওয়ার কথা ছিল। আর হলো না।
আজ বুধবার ঈদের পরের দিন নাহিদ ও মোরসালিনের পরিবারের সঙ্গে কথা বলেন এই প্রতিবেদক। দুজনেরেই বাসা রাজধানীর কামরাঙ্গীরচর এলাকায়।
রাজধানীর কামরাঙ্গীরচরে শিকসন এলাকায় ছোট একটি গলির মুখে নাহিদের বাসা। নীরব নিস্তব্ধ বাসাজুড়ে শোকের আবহ। বাসার সামনে যেতেই দেখা হয়ে গেল নাহিদের বাবা নাদিম হোসেনের সঙ্গে। একটু পরে এলেন মা নার্গিস বেগম। তিনি বলেন, ‘আমাদের কাছে কোনো ঈদ নেই। আমার বড় ছেলেকে ছাড়া আমাদের আনন্দ নেই। ছেলে হারা মায়ের কাছে ঈদ বলতে কিছু নেই।’
ছেলেকে শেষবার ছুঁতে না পারার আক্ষেপে পুড়ছেন মা নার্গিস বেগম। বলেন, ‘আমার ছেলেকে কাছে পেলেই মাথায় হাত বুলাতাম। পাশে বসলে আদর করতাম। কিন্তু ঘটনার দিন সকালেও আমার ছেলেটাকে শেষবার দেখতে পারলাম না। ভোর রাতে আমাকে সাহরিতে ভাত খাওয়ার জন্য ঘুম থেকে ডেকে দিত নাহিদ। যে দিন মারা যায় সেদিনও ডাক দেয়। তখন ঘুম ঘুম চোখে অন্ধকারের মধ্যে অল্প আলোতে নাহিদকে শেষ দেখা দেখি। সকালে নাহিদ কাজে চলে যায়। দিন গড়িয়ে ইফতারের সময়েও নাহিদ বাসায় না ফেরায় চিন্তা হচ্ছিল। এরই মধ্যে আমাদের এলাকার দুইটা ছেলে ফেসবুকে নাহিদের ছবি দেখিয়ে তার আহত হওয়ার খবর দেয়। পরে আমরা ঢাকা মেডিকেলে গিয়ে দেখি নাহিদ আইসিউতে ভর্তি। পরে সেখানেই মারা যায়।’
ছেলের কথা বলতেই চোখ ভিজে যায় মা নার্গিস বেগমের। বলেন, ‘আমার ছেলেটা রোজা ছিল। একটা রোজাও ভাঙে নাই। মানুষের সঙ্গে কখনো ঝগড়া করত না। সেই ছেলেটাকে এভাবে মেরে ফেললো। কত না কষ্ট পেয়েছে আমার ছেলেটা!’
ছেলেকে হারিয়ে শোকে পাথর বাবা নাদিম হোসেন। শোকে পাথর হয়ে গেছেন তিনি। ছেলে সম্পর্কে বলতে গিয়ে যেন শব্দ হারিয়ে ফেলছিলেন। শুধু বললেন, ‘আমার সুখের সংসারে হঠাৎ দুঃখের হানা। সব এলোমেলো করে দিল। ছেলের আয়ে সংসার চলতো আর আমার আয়ের টাকায় পরিশোধ করছিলাম ঋণের টাকা। সোয়া কাঠা জমির ওপর বাড়ি করতে গিয়ে এই ঋণ হয়। ওরা সব শেষ করে দিল। আমার এত ভালো ছেলেটাকে ওরা এভাবে মারলো…!’
কামরাঙ্গীরচর চরে ভান্ডারি মোড় মিনার মসজিদ এলাকার বাসিন্দা ছিলেন নিহত দোকান কর্মচারী মো. মোরসালিন (২২)। তাঁর মৃত্যুতে পুরো পরিবারে শোকের ছায়া নেমে এসেছে। স্ত্রী অর্ণি আক্তার মিতুর কাছে ঈদ মানেই বিষাদের দিন। এক দিকে স্বামী হারানোর শোক অন্য দিকে অবুঝ দুই শিশুর একঘেঁয়ে প্রশ্ন—বাবা কখন ফিরবে।
মিতু বলেন, ‘সাত বছর বয়সী মেয়ে হুমায়রা ইসলাম লামহা ও চার বছর বয়সী ছেলে আমির হামজা। একটু পরপরই এসে বাবার কথা জানতে চায়। ছেলে তো বাবাকে ছাড়া কিছু বুঝত না। সারা দিন বাবা বাবা করে। ঈদ নিয়ে কত পরিকল্পনা ছিল! স্বামীকে হারিয়ে এখন সেই ঈদকেই কালো রাত মনে হচ্ছে।’
ঈদের ছুটিতে পরিবারের সবাইকে নিয়ে পাবনা বেড়াতে যাওয়ার কথা ছিল জানিয়ে মিতু বলেন, ‘আমাদের দুজনেরই জন্ম ঢাকায়। তাই গ্রামে কখনো ঈদ করিনি। এবার পরিকল্পনা ছিল। আর কখনো সেটা হবে না। বাসায় আসলে ছেলে সন্তানদের নিয়ে মেতে থাকত মোরসালিন। প্রতি বছর ঈদের আগে চাঁদ রাতে পরিবারের সবার জন্য ঈদের কেনাকাটা করে আনত মোরসালিন। আমার ছেলে-মেয়ে সেই জামা পরে ঈদ করত, আমরা ঘুরতে যেতাম।’
মামলা না করলেও স্বামী হত্যার বিচার চান মিতু। বলেন, ‘একটা মানুষকে এভাবে নির্মমভাবে হত্যা করা হলো। এভাবে মানুষ মানুষকে মারতে পারে না। আমরা তাদের কঠিন বিচার চাই। যারা এই হত্যাকাণ্ড ঘটিয়েছে।’
নিহত দুই যুবকের পরিবারের পাশে দাঁড়িয়েছে মগবাজার ব্যবসায়ী সমিতি ও বসুন্ধরা। সমিতির পক্ষ থেকে একটি করে পিকআপ ভ্যান ও বসুন্ধরা গ্রুপের পক্ষ থেকে দুই পরিবারকে ১০ লাখ টাকার চেক দেওয়া হয়েছে। এ ছাড়া বিভিন্ন সংগঠন ও ব্যক্তিরা সাহায্য সহযোগিতা নিয়ে নাহিদ ও মোরসালিনের পরিবারের পাশে দাঁড়িয়েছেন।