এক আত্মীয়ের বিয়ের জন্য পাত্রী দেখতে পরিবারের সদস্যদের সঙ্গে বের হয়েছিলেন তাসরিফ আক্তার (১৮)। পথে ফরিদপুরে অরক্ষিত রেলক্রসিংয়ে ঢাকাগামী মধুমতি এক্সপ্রেসের সঙ্গে তাঁদের বহনকারী মাইক্রোবাসের সংঘর্ষ হয়। এই দুর্ঘটনায় এক দম্পতিসহ ৫ জন নিহত হয়েছেন। দুর্ঘটনায় প্রাণে বেঁচে ফিরে হাসপাতালে চিকিৎসাধীন তাসরিফ। অথচ তিনি এখনো জানেন না, তাঁর মা-বাবা আর নেই।
এর আগে আজ মঙ্গলবার (৭ জানুয়ারি) দুপুর সোয়া ১২টার দিকে ফরিদপুর সদরের গেরদা ইউনিয়নের মুন্সিবাজার-গজারিয়া আঞ্চলিক সড়কের কাফুরা রেলগেট এলাকায় এ ঘটনা ঘটে। এতে ঘটনাস্থলে মাইক্রোবাসের তিনজন এবং হাসপাতালে নেওয়ার পথে আরও দুজন যাত্রীর মৃত্যু হয়।
নিহত ব্যক্তিরা সবাই পরস্পরের আত্মীয়। তাঁদের মধ্যে রয়েছেন নারায়ণগঞ্জ সদরের ভুইয়াপাড়া এলাকার মামুন চৌধুরী লিটন (৫০) ও তাঁর স্ত্রী ফাহমিদা শারমিন মুন (৪২); তাঁর শ্যালক শহিদ ভুইয়ার স্ত্রী আতিফা রহমান (৩৬) ও তাঁর চাচাতো ভাই হাসিব জহিরের স্ত্রী সাজিয়া সাজু (৪৫) এবং বন্দর থানার দড়িমোল্যাকান্দা এলাকার উম্মে তাসরুমা রিনতু (৩০)।
এ ছাড়া লিটন চৌধুরীর মেয়ে তাসরিফ আক্তার (১৮), শ্যালিকা অরিন (৩৫), মাইক্রোবাসের চালক নাজমুল হোসেন (৩৫) ও স্থানীয় চা-দোকানি মো. জিন্নাহ আহত হয়েছেন। দুর্ঘটনার পর স্থানীয়রা তাঁদের উদ্ধার করে ফরিদপুর মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে নিয়ে যায়।
স্টেশনমাস্টার তাকদির হোসেন বলেন, দুপুর ১২টা ৫ মিনিটের দিকে ট্রেনটি ফরিদপুর স্টেশন থেকে ঢাকার উদ্দেশে ছেড়ে আসে। আর মাইক্রোবাসটি মুন্সিবাজার থেকে গজারিয়ার দিকে যাচ্ছিল।
ঘটনার সময় রেলক্রসিং-সংলগ্ন এক চায়ের দোকানে বসা ছিলেন স্থানীয় হারুন অর রশিদ। তিনি বলেন, ‘আমরা পাশে বসেই চা খাচ্ছিলাম। ট্রেনের হুইসেলও শুনি নাই। হঠাৎ শব্দ শুনে বের হয়ে দেখি, একটি মাইক্রো ঠেলে নিয়ে যাচ্ছে ট্রেন। তখন মাইক্রোর সিলিন্ডার বিস্ফোরণ হয়ে আগুনও ধরে যায়। কিছু দূরেই মাইক্রোটি পাশের পুকুরে পড়ে যায়। তখন আমরা দৌড়ে গিয়ে ৫ জনকে গাড়ি থেকে বের করে হাসপাতালে পাঠাই এবং ৩ জনকে মৃত অবস্থায় বের করি।’
ফরিদপুর মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে গিয়ে দেখা যায়, আহত অবস্থায় রয়েছেন মামুন চৌধুরী লিটনের মেয়ে তাসরিফ আক্তার। তিনি জানেন না, তাঁর বাবা-মা বেঁচে নেই।
তাসরিফ জানান, নারায়ণগঞ্জ থেকে সকালে তাঁরা এক আত্মীয়ের বিয়ের জন্য মেয়ে দেখতে ফরিদপুর সদরপুর উপজেলার চন্দ্রপাড়ায় যাচ্ছিলেন। পথিমধ্যে এ দুর্ঘটনা ঘটে।
সংশ্লিষ্ট সূত্র জানায়, মাইক্রোবাসটি নিহত মামুন চৌধুরী লিটনের ব্যক্তিগত। দুই বছর ধরে গাড়িটি চালাচ্ছিলেন খুলনা জেলার নাজমুল হোসেন। তিনিও নিশ্চিত করেন, নিহতদের এক আত্মীয়ের জন্য মেয়ে দেখার জন্য যাচ্ছিলেন।
খবর পেয়ে ঘটনাস্থলে যান জেলা প্রশাসক কামরুল হাসান মোল্লা ও পুলিশ সুপার আব্দুল জলিল। জেলা প্রশাসক বলেন, ‘দুঃখের বিষয়, গুরুত্বপূর্ণ এই ক্রসিংয়ে কোনো গেটম্যান না থাকায় এমন দুর্ঘটনা ঘটেছে। এখানে স্থায়ীভাবে রেলগেট করার জন্য সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষকে জানানো হবে। এ ছাড়া নিহতদের বহন ও দাফনের জন্য আর্থিক সহায়তা দেওয়া হবে।’
এই দুর্ঘটনায় ক্ষোভ জানিয়ে স্থানীয়রা বলেন, এখানে রেলগেট নির্মাণ না করা পর্যন্ত কোনো ট্রেন চলবে না। প্রায়ই এখানে দুর্ঘটনা ঘটছে, তবু রেলগেট করা হয়নি।
ফরিদপুর স্টেশনমাস্টার তাকদির হোসেন আজকের পত্রিকাকে বলেন, ওই এলাকা মূলত অরক্ষিত ছিল। সেখানে কোনো অনুমোদিত রেলগেট কিংবা গেটম্যান নেই। এ ছাড়া রেলক্রসিংটি গুরুত্বপূর্ণ না হওয়ায় রেলগেট নির্মাণের জন্য ঊর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষকে কখনো অবগত করা হয়নি বলে তিনি মন্তব্য করেন।
তাকদির হোসেন বলেন, ‘রেলওয়ের কয়েকটি বিভাগ থাকায় এবং আমরা নিম্ন পর্যায়ের কর্মকর্তা হওয়ায় আমাদের কথা অনেক সময় গুরুত্ব দেওয়া হয় না। বিষয়টি এখন জানানো হবে।’