কুমারখালী (কুষ্টিয়া) প্রতিনিধি
‘এইডে (ছেলে) কানা, আমি অচল। চেরাগ (বাতি) ধরাতে (জ্বালাতে) পারিনে। পাহা (পাকা) ঘর দেছেন, কল (টিউবওয়েল) দেছেন, এবার একটা সৌরবি (সৌরবিদ্যুৎ) দেন।’
আজ শুক্রবার সকালে এমনটায় আকুতি জানাচ্ছিলেন কুষ্টিয়ার কুমারখালী উপজেলার যদুবয়রা ইউনিয়নের ভবানীপুর গ্রামের মৃত মনসুর আলীর স্ত্রী সাহেরা খাতুন (৬৫)। তিনি একজন বয়োজ্যেষ্ঠ ও অক্ষম নারী। পরিবারে শুধু তাঁর দৃষ্টি প্রতিবন্ধী ছেলে তমিজ মোল্লা ছাড়া (৪৫) আর কেউ নেই।
প্রতিবেশী ও মা-ছেলের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, প্রায় ৪০ বছর আগে এক ছেলে রেখে মারা যান সাহেরা খাতুনের স্বামী মনসুর আলী। সে সময় ৫ বছর বয়সী তমিজ শ্রমিকদের ভাত টেনে যা পেত, তা দিয়েই চলত সংসার। এক সময় তমিজ কুমারখালী শহরে সুতায় রং লাগানোর কাজ করত। কিন্তু অপুষ্টিজনিত কারণে ধীরে ধীরে তাঁর চোখের দৃষ্টিশক্তি লোপ পায়। আর তাঁর মা বয়সের ভারে নুইয়ে পড়েন। সংসারে উপার্জনক্ষম দ্বিতীয় আর কেউ না থাকায় কোন মতে বেঁচে থাকতে ভিক্ষাবৃত্তির পথ বেছে নেন তাঁরা।
সাহেরা খাতুন বলেন, ‘ওপরে আল্লাহ আর নিচে আপনারা ছাড়া আমার আর কেউ নাই। পেট তো শুধু খাইতে চাই। কাম কাজ তো করতে পারিনে। ভিক্ষে করে খাই। মানুষ আর ভিক্ষে দিতে চাই না।’
গত ২০ জুলাই আজকের পত্রিকায় তাঁদের নিয়ে ‘হেঁটেই চলে জীবন’ শিরোনামে একটি সংবাদ প্রকাশিত হয়। সংবাদ প্রকাশের বিষয়টি উপজেলা পরিষদের চেয়ারম্যান আব্দুল মান্নান খানের নজরে আসলে টিআর প্রকল্পের বরাদ্দ থেকে তাঁদের একটি টিন সেটের মেঝে পাকা ঘর নির্মাণ করে দেওয়া হয়। বর্তমানে মা ছেলে সেই ঘরেই বসবাস করছেন।
সোয়া কাঠা জমির ওপর নির্মিত টিনের ঘর ছাড়াও রয়েছে একটি রান্নাঘর, একটি টিউবওয়েল ও একটি স্যানিটারি ল্যাট্রিন। সেখানে এক রুমের ছোট্ট ঘরে ছোট্ট একটি চৌকিতেই ঘুমান মা ও ছেলে। দিনের অধিকাংশ সময় তাঁদের কাটে এই ছোট্ট টিনের ঘরে। আসরের আজান কানে বাজলেই তাঁদের এক ভিন্ন পৃথিবীতে নেমে আসে কাল রাত। ঘরে খাবার থাকলে খাওয়া শেষে তড়িঘড়ি করে বিছানায় ঘুমিয়ে পড়েন তাঁরা। মাঝে মাঝে খাবার না থাকায় অনাহারেই দিন কাটে তাঁদের।
উপজেলা পরিষদের চেয়ারম্যান আব্দুল মান্নান খান বলেন, ‘সংবাদপত্রের মাধ্যমে মা ছেলের বিষয়টি জানতে পারি। এরপর বসবাসের জন্য একটি ঘর নির্মাণ করা হয়েছে। পরবর্তীতে জীবন ধারণের জন্য নানাবিধ সুবিধা প্রদান করা হবে।’
এদিকে সাহেরা খাতুনের বর্তমান অবস্থা দেখতে গত বৃহস্পতিবার বিকেলে পরিদর্শনে যান উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা (ইউএনও) বিতান কুমার মণ্ডল। এ সময় উপজেলা প্রকল্প বাস্তবায়ন কর্মকর্তা মাহমুদুল ইসলাম, যদুবয়রা পুলিশ ক্যাম্পের ইনচার্জ (এসআই) আব্দুল কাদির জিলানীসহ অনেকে উপস্থিত ছিলেন। পরিদর্শনকালে পরিবারটিকে খাদ্য সহায়তা প্রদান করা হয়।
ইউএনও বিতান কুমার মণ্ডল বলেন, ‘পত্রিকায় সংবাদ প্রকাশের পর বিষয়টি জানতে পারি এবং সরেজমিন খোঁজ নিই। তাঁদের খাদ্য সহায়তা দেওয়া হয়েছে। তাঁরা সমাজসেবা কার্যালয় থেকে ছয় মাস পরপর মা বিধবা আর ছেলে প্রতিবন্ধী ভাতা হিসেবে সাত হাজার টাকা পান। তাঁদের একটি ১০ টাকা কেজি চালের কার্ডও আছে।’
তিনি আরও বলেন, ‘একটি ঘর নির্মাণ করা হয়েছে। পরবর্তীতে সৌর বিদ্যুতের ব্যবস্থাও করা হবে।’