মুক্তিযুদ্ধের পর বাংলা ছবিতে যে ধারা শুরু হয়েছিল, তাতে বড় পরিবর্তন আসে পঁচাত্তরের পর। সামরিক সরকারের সময় বোম্বের ধারাটা আমাদের মধ্যে আসতে শুরু করল। নকল, মারপিট, ভাঁড়ামো, খোলামেলা পোশাকের ছবি নির্মাণ শুরু হলো ব্যাপকভাবে।
আশির দশকের মধ্যভাগে উল্লেখযোগ্য যে ঘটনাটি ঘটল—আমাদের চলচ্চিত্রে এলেন এক ঝাঁক তরুণ মেধাবী ও শিক্ষিত নির্মাতা। আলমগীর কবিরের নেতৃত্ব বা পৃষ্ঠপোষকতায় এ সময় তাঁরা স্বল্পদৈর্ঘ্য চলচ্চিত্রের উত্থান ঘটালেন। মোরশেদুল ইসলাম, তানভীর মোকাম্মেল, মোস্তফা কামাল, তারেক মাসুদেরা এসে মূলধারার বাইরে গিয়ে বিকল্পধারার চলচ্চিত্র নির্মাণের আন্দোলন গড়ে তোলেন। তাঁরা ছবি বানাতেন। সেটা যে সিনেমাহলেই মুক্তি পেতে হবে—এমন নয়। সেই ধারা থেকে বেরিয়ে এলেন। বিভিন্ন জায়গায় আয়োজন করে ছবি দেখাতেন। ওই সময় তরুণদের কাছে এই ছবিগুলো ব্যাপক সাড়া জাগায়। স্বাধীনতার চেতনাগুলো যখন নির্মূল হয়ে যাচ্ছিল সরকারি পর্যায়ে, তখন এই তরুণেরা মুক্তির চেতনা ভিন্নভাবে ধরে রাখার চেষ্টা করেন।
নব্বইয়ে গণ-আন্দোলনের মধ্য দিয়ে সামরিক সরকারের পতন হলো। আবার মুক্তিযুদ্ধভিত্তিক চলচ্চিত্র নির্মাণ শুরু হলো। কিন্তু তত দিনে বাংলা চলচ্চিত্রের ভাষা ও বিষয়ের যে ক্ষতি হওয়ার, তা হয়ে গেছে। কারিগরি উন্নয়নের সুবাদে নানাভাবে এ দেশে প্রবেশ করতে শুরু করল বিদেশি ছবি। ভিসিপি-ভিসিআর এল; ডিশের লাইন আসা শুরু হলো।
শাবনূর, সালমান শাহ, শবনাজ, নাঈম, মৌসুমীরা এলেন। কিন্তু আমাদের সিনেমার ভাষা ওভাবে তৈরি হলো না। হিটের হিসাব করলে অনেক ছবিই আসবে-যাবে। কিন্তু প্রতিটি দশকে নতুন কী যোগ হলো, সেটাও বিবেচ্য। যেটা আমাদের ভাষা, সেটা কিন্তু হারিয়ে যেতে শুরু করল।
এই সুযোগে আমাদের চলচ্চিত্রে এল অশ্লীলতার থাবা। সেটা ওই বিদেশি সংস্কৃতিরই একটা প্রভাব। আশির দশকটা ছিল বিদেশি ছবি নকলের যুগ। একটা সময় বিদেশি ছবির নকল দেখা বন্ধ করে দিল দর্শক। সিনেমা হলে আর লোকজন যায় না। তখন কাটপিস দেখানো শুরু হলো। ভিসিআরের বদৌলতে অবাধে কাটপিস আসা শুরু হয় দেশে। তাই হলেও এসব ছবি বা দৃশ্য দেখানো শুরু হয়। রুচিশীলদের জন্য এই সময় ছবি বানালেন মোরশেদুল ইসলাম, তানভীর মোকাম্মেল, তারেক মাসুদ, আবু সাইয়িদরা। কিন্তু সাধারণ দর্শকদের জন্য কী তৈরি হলো?
এখন তো সিনেমার ভাষায় ব্যাপক পরিবর্তন এসেছে। পাঁচ মিনিটের ছবি নিয়ে দুনিয়াজুড়ে হইচই হয়। হাতে থাকা মোবাইল ফোন বা ডিভাইস দিয়েই ছবি নির্মাণ হয়। প্রযুক্তিকে অস্বীকারের উপায় নেই। এই বাস্তবতায় সিনেমা হল হয়তো হারিয়েও যাবে। সিনেপ্লেক্স, ওটিটির যুগ এখন। তবে আমাদের যে ঐতিহ্য ছিল কনটেন্ট নির্মাণে, সে বিষয়টিও নির্মাতাদের মাথায় থাকা জরুরি। একটা চলচ্চিত্র সময় ও সভ্যতার অনেক কিছু তুলে ধরে। চলচ্চিত্র দেখে ওই সময়টা অনুধাবন করা যায়। আমার ছবিটি কি শুধুই বিনোদন, নাকি আরও বেশি কিছু—সেটা ভাবতে হবে। নাজির আহমদ, আব্দুল জব্বার খান, খান আতাউর রহমান, জহির রায়হান, সুভাষ দত্তরা যে পথ তৈরি করে দিয়েছেন, সেই পথে প্রযুক্তি ও যুগের প্রেক্ষাপটে আরও নতুনভাবে বাংলাদেশের জীবন, সমাজ ও সংস্কৃতিকে তুলে ধরা উচিত।
অনুপম হায়াৎ: চলচ্চিত্র গবেষক ও বিশ্লেষক। চলচ্চিত্র সেন্সর বোর্ডের সাবেক সদস্য।
(অনুলিখন: মীর রাকিব হাসান)