হোম > ফ্যাক্টচেক > আজকের ফ্যাক্ট

শিক্ষার্থীদের ভিডিওতে আ.লীগের ড. ইউনূস–বিরোধী স্লোগান জুড়ে দিয়ে প্রচার

ফ্যাক্টচেক ডেস্ক  

শিক্ষার্থীরা ‘ইউনুস তুই তওবা কর’ শেখ হাসিনার পায়ে ধর’ স্লোগান দেওয়ার দাবিতে ভাইরাল ভিডিও

ছাত্র–জনতার গণ–অভ্যুত্থানে ২০২৪ সালের ৫ আগস্ট ক্ষমতাচ্যুত হন শেখ হাসিনা। তিনি দেশ ছেড়ে ভারতে আশ্রয় নেন। পরে নোবেলজয়ী ড. মুহাম্মদ ইউনূসকে প্রধান উপদেষ্টা করে গঠিত হয় অন্তর্বর্তী সরকার। ভারতীয় সংবাদমাধ্যম দ্য প্রিন্টের তথ্য অনুযায়ী, দিল্লিতেই অবস্থান করছেন শেখ হাসিনা।

হাসিনা সরকারের পতনের পর জনসাধারণের অভিযোগের ভিত্তিতে আইনশৃঙ্খল বাহিনীর হাতে আওয়ামী লীগের অনেক নেতা–কর্মী গ্রেপ্তার হয়েছেন। অনেক নেতা–কর্মী বিদেশেও পালিয়ে গেছেন। আবার কেউ কেউ আত্মগোপনে আছেন। এসবের মধ্যেও আওয়ামী লীগের অনেক নেতা–কর্মীদের নিজেদের উপস্থিতি জানান দিতে মাঝেমধ্যে ঝটিকা মিছিল বের করার তথ্য গণমাধ্যমে আসছে।

এরই মধ্যে, শেখ হাসিনার পক্ষে শিক্ষার্থীরা স্লোগান দিচ্ছে—এমন দাবিতে একটি ভিডিও সোশ্যাল মিডিয়ায় ভাইরাল হয়েছে। ভিডিওটির ক্যাপশনে লেখা, ‘ইউনুস তুই তওবা কর, শেখ হাসিনার পায়ে ধর. . শেখ হাসিনা বীরের বেশে আসবে ফিরে বাংলাদেশে জয় বাংলা জয় বঙ্গবন্ধু’।

ভিডিওতে দেখা যাচ্ছে, কিছু শিক্ষার্থী একটি ভবনের সামনে দাঁড়িয়ে আছে এবং সেই জমায়েত থেকে স্লোগান আসছে। এ ছাড়া একই ভিডিও ভিন্ন একটি ফেসবুক পেজে শেয়ার করে দাবি করা হয়েছে, গাজীপুরের শিক্ষার্থীরা ‘শেখ হাসিনার ভয় নাই, রাজপথ ছাড়ি নাই, ইউনুস তুই তওবা কর, শেখ হাসিনার পায়ে ধর’ বলে স্লোগান দিচ্ছে। ভিডিওতে দেখা যাচ্ছে, একটি বহুতল ভবনের ফটকের সামনে অধিকাংশ সাদা শার্ট পরিহিত এবং পিঠে স্কুলব্যাগ বহনকারী কিছু কিশোর ভবনের সামনে দাঁড়িয়ে আছে। তাদের সঙ্গে প্রাপ্তবয়স্ক অনেককেও দেখা যাচ্ছে।

নাসিমা সুলতানা মহুয়া (Nasima Sultana Mohua) নামের একটি ফেসবুক অ্যাকাউন্ট থেকে ১৪ জানুয়ারি দুপুর আড়াইটার দিকে পোস্ট করা ভিডিওটি বেশি ছড়িয়ে পড়েছে। ওই পোস্টে আজ শনিবার রাত সোয়া ১১টা পর্যন্ত ৫০৪টি রিয়েকশন পড়েছে এবং ভিডিওটি দেখা হয়েছে ৫৪ হাজারের বেশিবার। এ ছাড়া ভিডিওটি ৭৪০টি। কমেন্ট পড়েছে ৫১টি। কমেন্টে মনির মনিরুজ্জামান (Monir Moniruzzaman) নামে একটি অ্যাকাউন্ট থেকে লেখা হয়েছে, ‘সময়ের সাহসী সন্তানদের জন্য দোয়া রইল।’

ভিডিওটির কিছু কি-ফ্রেম রিভার্স ইমেজ সার্চ করা হলে, ‘মুজিব সেনা’ নামের একটি টিকটক অ্যাকাউন্টে ২০২৪ সালের ২০ ডিসেম্বর একই দাবিতে প্রচারিত একটি ভিডিও পাওয়া যায়। দুটি ভিডিও একই।

মুজিব সেনা নামের টিকটক অ্যাকাউন্টে দাবিতে প্রচারিত ভিডিও

টিকটিক অ্যাকাউন্টটি পর্যবেক্ষণ করে ২০২৪ সালের ২১ ডিসেম্বরে ভিন্ন দিক থেকে ধারণ করা আলাদা দুটি ভিডিও পাওয়া যায়।

মুজিব সেনা নামের টিকটক অ্যাকাউন্টে ভিন্ন দিক থেকে তোলা একই ভিডিও

ভিডিও দুটিতে কিশোরদের পোশাক ও আইডি কার্ডের ফিতার মধ্যে এবং শার্টের হাতায় থাকা মনোগ্রামে ‘কাদিরদী কলেজ’ দেখতে পাওয়া যায়। অবশ্য পরে ভিডিও দুটি ডিলিট করা হয়েছে।

মুজিব সেনা নামের টিকটক অ্যাকাউন্টের ভিডিওতে থাকা তরুণদের জামা ও আইডিকার্ডের ফিতা থেকে পাওয়া ‘কাদিরদী কলেজ’-এর নাম।

‘কাদিরদী কলেজ’–এর বিষয়ে গুগলে সার্চ করে দেখা যায়, এটি ফরিদপুর জেলার বোয়ালমারী উপজেলার সাতৈর ইউয়নের কাদিরদী গ্রামে অবস্থিত একটি বেসরকারি কলেজ।

পরবর্তীতে গুগল ম্যাপসের স্ট্রিট ভিওয়ের সাহায্যে ফরিদপুরের বোয়ালমারী উপজেলার সাতৈর ইউয়নের কাদিরদী গ্রামের কলেজটি খুঁজে পাওয়া যায়। এর পাশাপাশি ভাইরাল ভিডিওতে দেখা যাওয়া ভবনটিও পাওয়া যায়।

এসব তথ্যের সূত্র ধরে গুগলে সার্চ করে এটিএন নিউজের একটি ভিডিও প্রতিবেদন পাওয়া যায়। প্রতিবেদনটি এটিএন বাংলার ইউটিউব চ্যানেলে ২০২৪ সালের ২৮ অক্টোবর প্রকাশিত হয়। এই প্রতিবেদনে ভাইরাল ভিডিওটির ভিন্ন দিক থেকে ধারণ করা একটি ফুটেজ পাওয়া যায়। এর সঙ্গে, ভাইরাল ভিডিওতে থাকা একাধিক ব্যক্তি, তাদের পোশাক, পেছনের দেওয়ালের সাদৃশ্য পাওয়া যায়। তবে ভিডিওটির কোথাও ‘ইউনূস তুই তওবা কর, শেখ হাসিনার পায়ে ধর, শেখ হাসিনা বীরের বেশে, আসবে ফিরে বাংলাদেশে, জয় বাংলা জয় বঙ্গবন্ধু’ স্লোগান শোনা যায়নি।

ভাইরাল ভিডিওর সাথে এটিএন বাংলার সংবাদের ফুটেজের সাদৃশ্য

ইউটিউবে প্রতিবেদনটির ডেসক্রিপশন থেকে জানা যায়, হযরত মুহাম্মদ (সা.) এবং তাঁর কন্যা ফাতেমা (রা.)–কে নিয়ে অবমাননাকর মন্তব্য করার অভিযোগে ফরিদপুরের কাদিরদী কলেজের শিক্ষার্থী হৃদয় পালকে সেনাবাহিনীর কাছে হস্তান্তর করেছে কলেজটির শিক্ষার্থী, কলেজ প্রশাসন ও স্থানীয় জনতা।

এ নিয়ে তখন বিডিনিউজ২৪, বিবিসি বাংলা, আজকের পত্রিকাসহ বেশ কয়েকটি গণমাধ্যমে খবর প্রকাশিত হয়েছে।

এসব প্রতিবেদনেও কোথাও উল্লেখিত স্লোগানের বিষয়ে কিছুই উল্লেখ নেই।

পরবর্তী অনুসন্ধানে কাদিরদী কলেজ স্টুডেন্টস ফ্যামিলি (Kadirdi College Student’s Family) নামে একটি ফেসবুক গ্রুপ পাওয়া যায়। গ্রুপটিতে কাদিরদী কলেজ নিয়ে নানা ধরনের পোস্ট রয়েছে। গ্রুপটিতে সম্প্রতি পোস্ট দিয়েছেন এমন কয়েকজন পোস্টকারীর সঙ্গে কথা বলে আজকের পত্রিকার ফ্যাক্টচেক বিভাগ। কাদিরদী কলেজে পড়েন এমন কয়েক জনের সঙ্গে কথা হয়। তাঁরা সবাই জানান, সেদিন এমন কোনো স্লোগান দেওয়া হয়নি।

শাওন আদনান নামের একজন শিক্ষার্থী জানান, সেদিন তিনিসহ তাঁর বন্ধু ও সিনিয়ররা সেখানে উপস্থিত ছিলেন। হজরত মুহাম্মদ (সা.)–কে নিয়ে কটুক্তি করায় হৃদয় পালের ফাঁসির দাবি নিয়ে তাঁরা কলেজ প্রশাসনের কাছে গিয়েছিলেন।

কাদিরদী কলেজের ওয়েবসাইটে কলেজের অধ্যক্ষ মো. নুরুজ্জামান মোল্যার ফোন নম্বর পাওয়া যায়। তাঁর হোয়াটসঅ্যাপ নম্বরে ভাইরাল ভিডিওটি পাঠিয়ে এ বিষয়ে চানতে চাওয়া হলে তিনি জানান, এই ঘটনায় ড. ইউনূসের বিরুদ্ধে বা শেখ হাসিনার পক্ষে কোনো স্লোগান দেওয়া হয়নি। এটি গত বছর হজরত মুহাম্মদ (সা.)–কে নিয়ে তাঁদেরই এক শিক্ষার্থী কটুক্তি করায় তাঁর বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়ার দাবিতে সাধারণ শিক্ষার্থীরা জড়ো হয়েছিলেন। তবে অভিযুক্তের দাবি ছিল, তাঁর ফেসবুক অ্যাকাউন্ট হ্যাকড হয়েছিল। সেদিন ওই ঘটনায় স্থানীয় ইউপি চেয়ারম্যান, ইউএনও উপস্থিত ছিলেন বলে জানান অধ্যক্ষ।

ভিডিওটিও নিয়ে ফরিদপুরের বোয়ালমারী উপজেলার নির্বাহী কর্মকর্তা (ইউএনও) তানভীর হাসান চৌধুরীর সঙ্গে কথা হয় ফ্যাক্টচেক বিভাগের। তিনি জানান, তিনিও সেদিন সেখানে উপস্থিত ছিলেন। ড. ইউনূসের বিরুদ্ধে বা শেখ হাসিনার পক্ষে সেখানে কোনো স্লোগান তিনি শোনেননি।

তাহলে ভিডিওটিতে সেই স্লোগানটি কীভাবে যুক্ত হলো?
স্লোগানের কথাগুলো লিখে গুগলে সার্চ করলে যমুনা টেলিভিশনের ইউটিউব চ্যানেলে একটি ভিডিও পাওয়া যায়। ভিডিওটি ২০২৪ সালের ১৬ ডিসেম্বর প্রকাশিত। ভিডিওতে দেখা যাচ্ছে, রাতের বেলা মোবাইল ফোনের ফ্ল্যাশলাইট জ্বালিয়ে কিছু তরুণ মিছিল করছেন।

ভিডিওটির ১ মিনিট ২৬ সেকেন্ড থেকে ২ মিনিট ২ সেকেন্ড পর্যন্ত ‘ইউনূস তুই তওবা কর, শেখ হাসিনার পায়ে ধর, শেখ হাসিনা বীরের বেশে আসবে ফিরে বাংলাদেশে জয় বাংলা জয় বঙ্গবন্ধু’ স্লোগান শোনা যায়। এই ভিডিওর স্লোগানের কণ্ঠ এবং ভাইরাল ভিডিওটির স্লোগানের কণ্ঠ একই।

ভিডিওটির ডেসক্রিপশন থেকে জানা যায়, এটি গত ১৬ ডিসেম্বর জামালপুর আওয়ামী লীগের ঝটিকা মিছিলের ভিডিও।

ভিডিওটি একই দিনে যমুনা টিভির ফেসবুক পেজেও প্রকাশিত হয়।

সুতরাং, শিক্ষার্থীরা প্রধান উপদেষ্টা ড. ইউনূসের বিরুদ্ধে এবং শেখ হাসিনার পক্ষে স্লোগান দিচ্ছে, দাবিতে ভাইরাল ভিডিওটি এডিটেড। প্রকৃতপক্ষে, ২০২৪ সালের অক্টোবরে হজরত মুহাম্মদ (সা.)–কে নিয়ে কটুক্তি করার অভিযোগে ফরিদপুরের কাদিরদী কলেজের শিক্ষার্থীরা আরেক শিক্ষার্থীর শাস্তির দাবিতে জড়ো হয়। সেই ভিডিওর সঙ্গে গত ১৬ ডিসেম্বর জামালপুর আওয়ামী লীগের ঝটিকা মিছিলের স্লোগান জুড়ে দেওয়া হয়েছে।

সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম, সংবাদমাধ্যম বা যেকোনো মাধ্যমে প্রচারিত কোনো ছবি, ভিডিও বা তথ্য বিভ্রান্তিকর মনে হলে তার স্ক্রিনশট বা লিংক কিংবা সে সম্পর্কিত বিস্তারিত তথ্য আমাদের ই-মেইল করুন। আমাদের ই-মেইল ঠিকানা factcheck@ajkerpatrika.com

পরীক্ষার আগে ডিম খাওয়া মানা— চিকিৎসা বিজ্ঞান কী বলে

সিলেটে আওয়ামী লীগের মশাল মিছিল ও পিকেটিং দাবিতে ভিডিও প্রচার— জানুন আসল ঘটনা

পাইলস রোগের চিকিৎসার জন্য ড. ইউনূসের বিদেশ গমন—ভাইরাল ফটোকার্ড দুটি ভুয়া

ভারতে প্রথমবারের মতো প্রকাশ্যে এলেন শেখ হাসিনা, ভাইরাল ভিডিওর সত্যতা কতটুকু

ড. ইউনূসের লোক মানুষকে নির্যাতন করছে দাবিতে ভিডিও প্রচার—প্রকৃত ঘটনা জানুন

লস অ্যাঞ্জেলেসের দাবানল ঠেকাতে আজান— ভাইরাল ভিডিওটি পাকিস্তানের

মিজানুর রহমান আজহারীর নাচের ভিডিও ভাইরাল— জানুন আসল ঘটনা

নিক্সন চৌধুরী গ্রেপ্তার হওয়ার দাবিতে ভাইরাল ছবিটি এডিটেড

জাস্টিন ট্রুডোর পদত্যাগে কানাডাবাসীর উল্লাস—ভাইরাল ভিডিওটির প্রকৃত ঘটনা জানুন

লস অ্যাঞ্জেলেসে আগুন নেভাতে গিয়ে বিমান বিধ্বস্ত হয়নি, ভাইরাল ভিডিওটি চিলির

সেকশন