বাংলাদেশে ছাত্র–জনতার আন্দোলনে গত সপ্তাহে ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগ সরকারের পতনের পর থেকেই কার্যত ভেঙে পড়ে দেশের আইনশৃঙ্খলা ব্যবস্থা। বর্তমান অন্তর্বর্তীকালীন সরকার গঠনের মাধ্যমে আইনশৃঙ্খলা ব্যবস্থা পুনরুদ্ধারের চেষ্টা চলছে। এই সুযোগে দেশের বিভিন্ন প্রান্তে সংখ্যালঘুদের ওপর হামলাসহ মন্দির–বসতবাড়ি ভাঙচুরসহ লুটপাটের ঘটনা।
গতকাল শনিবার বাংলাদেশ হিন্দু বৌদ্ধ খ্রিষ্টান ঐক্য পরিষদ এবং বাংলাদেশ পূজা উদ্যাপন পরিষদ নামে দুটি সংগঠন দাবি করেছে, শেখ হাসিনার পতনের পর দেশের ৫২টি জেলায় সংখ্যালঘু জনগোষ্ঠীর ওপর ২০৫টি হামলার ঘটনা ঘটেছে। এসব ঘটনার মধ্যেই সাম্প্রদায়িক হামলার নামে এক্সে (সাবেক টুইটার) ক্রমাগত ছড়ানো হচ্ছে বিভিন্ন ভুল তথ্য সংবলিত দাবি, অপ্রাসঙ্গিক ভিডিও। এসব অ্যাকাউন্টের মধ্যে ভারতীয়দের দ্বারা পরিচালিত অ্যাকাউন্ট যেমন আছে, তেমনি বাংলাদেশ, ভারত ছাড়াও অন্যান্য দেশের অ্যাকাউন্টও আছে। এসব দাবির সত্যতা যাচাই করে দেখেছে আজকের পত্রিকার ফ্যাক্টচেক বিভাগ।
দাবি ১: বাংলাদেশি ছোটপর্দার অভিনেত্রী ঊর্মিলা শ্রাবন্তী করের বাড়িতে নিষিদ্ধ ঘোষিত রাজনৈতিক সংগঠন জামায়াতে ইসলামীর হামলা
‘বাবা বানারাস (Baba Banaras)’ নামে একটি ভেরিফায়েড এক্স অ্যাকাউন্ট থেকে গত শুক্রবার (৯ আগস্ট) বাংলাদেশি ছোটপর্দার অভিনেত্রী ঊর্মিলা শ্রাবন্তী করের একটি ছবি টুইট করে দাবি করা হয়, তাঁর বাড়িতে নিষিদ্ধ ঘোষিত রাজনৈতিক সংগঠন জামায়াতে ইসলামীর সন্ত্রাসীরা হামলা চালিয়েছে।
দাবি ২: হিন্দুদের ওপর হামলা করছে বাংলাদেশ সেনাবাহিনী
‘বাবা বানারাস (Baba Banaras)’ নামের একই অ্যাকাউন্ট থেকে আজ রোববার ২৯ সেকেন্ডের একটি ভিডিও টুইট করে দাবি করা হয়, জামায়াতে ইসলামীই নয় কেবল, বাংলাদেশ সেনাবাহিনীও হিন্দুদের ওপর হামলা চালাচ্ছে। ভিডিওটিতে দাবি করা হয়, হিন্দুদের ওপর সাম্প্রদায়িক হামলার ঘটনায় যেসব হিন্দু প্রতিবাদ জানাচ্ছে, সেসব হিন্দুদের ওপর হামলা চালাচ্ছে সেনাবাহিনী। ভিডিওটিতে দেখা যাচ্ছে, দুই তরুণকে বাংলাদেশ সেনাবাহিনীর দুই সদস্য লাঠিপেটা করছেন। ভিডিওটিতে ‘নারায়ে তাকবীর, আল্লাহ আকবার’ স্লোগান দিতে শোনা যাচ্ছে।
প্রসঙ্গত, ‘বাবা বানারাস (Baba Banaras)’ অ্যাকাউন্টটি থেকে বাংলাদেশে হিন্দুদের ওপর সাম্প্রদায়িক হামলার দাবিতে ক্রমাগত ভুল তথ্য ছড়ানো হচ্ছে। এর আগেও আজকের পত্রিকার ফ্যাক্টচেক বিভাগ অ্যাকাউন্টটি থেকে একাধিক সাম্প্রদায়িক হামলার দাবিতে প্রচারিত ভুল তথ্য শনাক্ত করেছে।
দাবি ৩: বাংলাদেশে হিন্দুদের ওপর হামলার দাবিতে বগুড়ার রথযাত্রার দুর্ঘটনার ভিডিও প্রচার
‘মি. ন্যাশনালিস্ট’ নামের এক্স অ্যাকাউন্ট থেকে ১ মিনিটের একটি ভিডিও প্রচার করে দাবি করা হচ্ছে, বর্তমানে বাংলাদেশের হিন্দুদের অবস্থা এটি। ভিডিওটিতে দেখা যাচ্ছে, বেশ কয়েকজন নারী–পুরুষ সড়কে এবং সড়ক বিভাজকে পড়ে আছেন। কেউ কেউ তাঁদের উদ্ধারের চেষ্টা করছেন।
আজকের পত্রিকার ফ্যাক্টচেক বিভাগের অনুসন্ধানে দেখা যায়, ভাইরাল ভিডিওটির সঙ্গে হিন্দুদের ওপর সাম্প্রদায়িক হামলার কোনো সম্পর্ক নেই। ইংরেজি দৈনিক ডেইলি স্টারের ইউটিউব চ্যানেলে গত ৭ জুলাই হুবহু একই ভিডিও পোস্ট করা হয়। ভিডিওটি বগুড়ায় রথযাত্রায় বিদ্যুতায়িত হয়ে পাঁচজনের মৃত্যু এবং অন্তত ৩০ জন আহত হওয়ার ঘটনার। বগুড়া শহরের সেউজগাড়ী আমতলী মোড় এলাকায় এ দুর্ঘটনা ঘটে।
‘মি. ন্যাশনালিস্ট’ নামের এক্স অ্যাকাউন্ট থেকে গত শুক্রবার (৯ আগস্ট) ৩১ সেকেন্ডের একটি ভিডিও টুইট করা হয়। ভিডিওটিতে দেখা যাচ্ছে, এক তরুণী কান ধরে ওঠবস করছেন এবং আশপাশে অন্য তরুণীরা সেই দৃশ্যের ভিডিও ধারণ করছেন। ভিডিওটি শেয়ার করে দাবি করা হচ্ছে, ‘এই মেয়ের নাম জ্যোতিকা বসু চ্যাটার্জি। তিনি বাংলাদেশে একটি মানবিক সহায়তা প্রতিষ্ঠান পরিচালনা করেন। এই প্রতিষ্ঠানের মাধ্যমে তিনি হিন্দুদের থেকে প্রাপ্ত সহায়তা দিয়ে মুসলিমদের স্বাস্থ্য ও শিক্ষার উন্নয়নে কাজ করেন। তবে বাংলাদেশে সাম্প্রদায়িক হামলা শুরু হওয়ার মানুষ সব ভুলে গিয়ে জ্যোতিকাকে কান ধরে ওঠবস করায়। পরে প্রায় ২০ জন তাঁকে উলঙ্গ করে ধর্ষণ করে ধর্মীয় স্লোগান তুলে জীবন্ত পুড়িয়ে দেয়। জ্যোতিকার ভাই এই ঘটনায় ভিডিও বার্তায় ভারত সরকারের সহযোগিতা চান। পরে তাঁকেও আগুনে পুড়িয়ে মেরে ফেলা হয়।’
ভিডিওটি সম্পর্কে অনুসন্ধানে একটি বাংলা জাতীয় দৈনিকে গত ২৬ জুলাইয়ে প্রকাশিত প্রতিবেদন থেকে জানা যায়, ভিডিওর ঘটনাটি গত ১৭ জুলাইয়ের।
আজকের পত্রিকার ফ্যাক্টচেক বিভাগের অনুসন্ধানে জানা যায়, এই ছাত্রলীগ নেত্রীর নাম সাগরিকা, ইডেন মহিলা কলেজ শাখা ছাত্রলীগের সহসভাপতি সুস্মিতা বাড়ৈ গ্রুপের কর্মী হিসেবে পরিচিত। কোটা সংস্কার আন্দোলনকে কেন্দ্র করে সাধারণ শিক্ষার্থীদের তোপের মুখে পড়েন ইডেন কলেজের ছাত্রলীগ নেত্রীরা। তিনিও তাঁদের একজন। আরেকটি জাতীয় দৈনিকে প্রকাশিত প্রতিবেদন থেকে জানা যায়, সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে ‘আজকে ইডেনের শিক্ষার্থীদের জন্য ঈদের দিন’ শিরোনামে একটি ফেসবুক ভিডিও পোস্টে দেখা যায়, শিক্ষার্থীরা এক ছাত্রলীগ নেত্রীকে কান ধরে ওঠবস করাচ্ছেন।
দাবি ৫: ঈদযাত্রার ভিডিওকে হিন্দুদের বাংলাদেশ থেকে পালিয়ে যাওয়ার বলে দাবি
‘হুদা জান্নাত (Hoda_Jannat)’ নামের একটি ভেরিফায়েড এক্স অ্যাকাউন্টে আজ রোববার নদীতে কিছু যাত্রীবাহী লঞ্চের ভিডিও প্রচার করে দাবি করা হচ্ছে, ইসলামি উগ্রপন্থীদের হামলায় হিন্দুরা বাংলাদেশ থেকে পালিয়ে যাচ্ছেন। ভিডিওটি থেকে কিছু কি–ফ্রেম নিয়ে রিভার্স ইমেজ অনুসন্ধানে ‘Gola Bazar Gorakhpur’ নামের একটি ফেসবুক পেজে পাওয়া যায়। ভিডিওটি গত ৩০ মে পেজটিতে পোস্ট করা হয়। ক্যাপশনে ইংরেজিতে লেখা, ‘ঈদ উপলক্ষে লঞ্চের ছাদে অনেক যাত্রী।’ অর্থাৎ ভাইরাল ভিডিওটি বাংলাদেশে সাম্প্রতিক কোটা সংস্কার আন্দোলন শুরু হওয়ার অনেক আগে থেকেই ইন্টারনেটে বিদ্যমান।
ভারতের উত্তরপ্রদেশ রাজ্যের গাজিয়াবাদে বসবাসকারী বেশ কয়েকটি মুসলিম শ্রমিক পরিবারকে অবৈধ বাংলাদেশি আখ্যা দিয়ে মিস্টার সিনহা নামের একটি ভেরিফায়েড এক্স অ্যাকাউন্ট থেকে গতকাল শনিবার (১০ আগস্ট) একটি ভিডিও টুইট করা হয়। টুইটটিতে দাবি করা হয়, এই বাংলাদেশিরা তাঁদের অস্থায়ী তাঁবুতে বাংলাদেশের পতাকা উড়িয়ে বাংলাদেশের অভ্যন্তরে হিন্দুদের ওপর হামলা উদ্যাপন করছিল। ভারতের হিন্দু রক্ষা দল (এইচআরডি) এটি দেখে ক্ষুব্ধ হয়ে তাঁদের তাঁবুগুলো গুঁড়িয়ে দিয়েছে। এ সময় কাউকে আঘাত করা হয়নি।