‘কণ্ঠশিল্পী মমতাজ এইডস রোগে আক্রান্ত’—এমন শিরোনামে গত সোমবার (৪ জুন) দুপুর থেকে সোশ্যাল মিডিয়ায় বেসরকারি টিভি চ্যানেল আইয়ের একটি ফটোকার্ড ব্যাপকভাবে ছড়িয়ে পড়ে। যদিও পরে একই দিন বিকেল সাড়ে ৫টায় চ্যানেলটি নিজেদের ভেরিফায়েড ফেসবুক পেজে একটি ফটোকার্ড প্রকাশ করে জানায়, ‘চ্যানেল আই অনলাইনের কার্ড ব্যবহার করে প্রকাশিত সংবাদটি সত্য নয়। এ ধরনের কোনো সংবাদ চ্যানেল আই অনলাইনে প্রকাশিত হয়নি এবং সংবাদটি পুরোপুরি মিথ্যা।’
আবার গতকাল বৃহস্পতিবার (৬ জুন) সকাল থেকে বিতর্কিত ব্লগার আসাদ নূরকে জড়িয়ে যমুনা টিভির লোগোসংবলিত একটি ফটোকার্ড পোস্ট করে দাবি করা হয়, আসাদ নূর ক্যানসারে আক্রান্ত। ফটোকার্ডটি প্রকাশের তারিখ বুধবার (৫ জুন)। এই পোস্টের পরিপ্রেক্ষিতে আসাদ নূর নিজের পেজে একটি পোস্ট দিয়ে বলেন, ‘আমার ‘কেন্সার’/ক্যান্সার কোনোটাই হয়নি, আমি সম্পূর্ণ সুস্থ। কিছু ধর্মান্ধ ব্যক্তি ও প্রতিষ্ঠান আমার ছবি ব্যবহার করে ভুয়া ফটোকার্ড বানিয়ে তাদের বিকৃত মানসিকতার প্রতিফলন ঘটাচ্ছে বলে মনে করি।’
তবে সংবাদমাধ্যমের ফটোকার্ড ব্যবহার করে রাজনৈতিক ব্যক্তিত্ব শুরু করে বিভিন্ন ব্যক্তিদের জড়িয়ে ভুয়া তথ্য ছড়ানোর ঘটনা এগুলোই প্রথম নয়। বছর দেড় ধরে এই প্রক্রিয়ায় ভুয়া তথ্য ছড়ানোর প্রবণতা বেড়েছে। দেশীয় ফ্যাক্টচেকিং প্রতিষ্ঠান রিউমর স্ক্যানারের ২০২৩ সালের সেপ্টেম্বরে প্রকাশিত একটি প্রতিবেদনে জানা যায়, ওই বছরের প্রথম আট মাসে (জানুয়ারি-আগস্ট) বিভিন্ন সংবাদমাধ্যমের আদলে ফটোকার্ড তৈরি করে ২৩টি ভুয়া কনটেন্ট তৈরি করা হয়। বছর ঘুরতে এই প্রবণতা বেড়েছে বৈ কমেনি। একই প্রতিষ্ঠানের চলতি বছরের গত মে মাসের ভুল, অপতথ্য শনাক্তের মাসিক প্রতিবেদন থেকে জানা যায়, প্রতিষ্ঠানটি গত মে মাসে সংবাদমাধ্যমের নকল ও ভুয়া ফটোকার্ড ব্যবহার করে ১৩টি মিথ্যা ঘটনা প্রচার করা হয়েছে। এর মধ্যে দুটি ফটোকার্ড নিয়ে ফ্যাক্টচেক প্রতিবেদন প্রকাশ করেছে আজকের পত্রিকার ফ্যাক্টচেক বিভাগও।
এসব ভুয়া, নকল ফটোকার্ডের শিকার হচ্ছেন কারা, ছড়াচ্ছেও-বা কে?
আজকের পত্রিকার ফ্যাক্টচেক বিভাগসহ দেশে গুজব, অপতথ্য বা ভুয়া তথ্য নিয়ে কাজ করা ফ্যাক্টচেকিং প্রতিষ্ঠানগুলোর প্রকাশিত প্রতিবেদন বিশ্লেষণে দেখা যায়, সংবাদমাধ্যমের ভুয়া, নকল ফটোকার্ড তৈরির মাধ্যমে অপতথ্যের শিকার হওয়া ব্যক্তিদের তালিকায় আছেন নোবেলজয়ী অর্থনীতিবিদ ড. ইউনূসসহ ফুটবলতারকা লিওনেল মেসি থেকে শুরু করে অভিনয়শিল্পী, ধর্মীয় ব্যক্তি, রাজনীতিবিদ।
আজকের পত্রিকার ফ্যাক্টচেক বিভাগের অনুসন্ধানে আশিকুর রহমান অণু নামের ভেরিফায়েড ফেসবুক পেজ থেকে ফটোকার্ডটি বেশি শেয়ার হতে দেখা যায়। সেখানে অণুকে বাংলাদেশ আওয়ামী লীগের ‘অ্যাকটিভিস্ট’ ও বাংলাদেশ ছাত্রলীগের সাবেক সহসম্পাদক হিসেবে পরিচয় দেওয়া হয়েছে।
আবার কণ্ঠশিল্পী মমতাজ এইডস রোগে আক্রান্ত হওয়ার দাবিতে চ্যানেল আইয়ের কথিত ফটোকার্ডটি সবচেয়ে বেশি ভাইরাল হয়েছে ‘সত্যের সন্ধানে’ নামের একটি ফেসবুক পেজ থেকে। পেজটির পরিচয়ে লেখা ‘সত্য প্রকাশে নির্ভীক’। পেজটির ট্রান্সপারেন্সি বিভাগ থেকে দেখা যায়, পেজটির প্রথম নাম ছিল ‘বাঁসের কেল্লা’, ২০১৬ সালের ২১ আগস্ট নাম পরিবর্তন করে রাখা হয় ‘বি. এন. পি, ও বাংলাদেশ।’
এ তো গেল ভুয়া ফটোকার্ডে রাজনৈতিক ব্যক্তিদের নামে ভুয়া প্রচারণার তথ্য। গত মার্চেই যমুনা টেলিভিশনের লোগো ও ডিজাইন ব্যবহার করে তৈরি ভুয়া ফটোকার্ডে মিথ্যা তথ্যের শিকার হন জনপ্রিয় অভিনেতা ইয়াশ রোহান। যমুনা টিভির লোগোযুক্ত ফটোকার্ডটির উৎস অনুসন্ধানে দেখা যায়, ‘Context Kidhar Hain?’ নামের একটি ফেসবুক পেজ থেকে সম্ভবত ফটোকার্ডটি প্রথম পোস্ট করা হয়। পেজটির পরিচয় জানা থেকে জানা যায়, এটি ব্যঙ্গাত্মক বা স্যাটায়ার কনটেন্ট তৈরি করে থাকে।
গত মে মাসের মাঝামাঝিতে আর্জেন্টাইন এই তারকাকে নিয়ে বেসরকারি সম্প্রচার মাধ্যম ডিবিসি নিউজের কথিত একটি ফটোকার্ড ফেসবুকে প্রচার করে দাবি করা হয়, আর্জেন্টিনার ক্লাবে খেলতে গিয়ে বকেয়া বেতন না পাওয়া বাংলাদেশ জাতীয় ফুটবল দলের অধিনায়ক জামাল ভূঁইয়ার বেতন পরিশোধ করে দেবেন লিওনেল মেসি। ফটোকার্ডটি তৈরি করেছিল ‘Argentine Legends’ নামের ফুটবলকেন্দ্রিক একটি স্যাটায়ার পেজ। একই পেজ থেকে মে মাসের শুরুতেই ব্রাজিলে হওয়া বন্যা ঘিরে প্রচার করা হয়, ‘ব্রাজিলের বন্যার্তদের জন্য ১০০ মিলিয়ন পাউন্ড দান করেছে লিওনেল মেসি।’ এ ক্ষেত্রে ব্যবহার করা হয়েছিল যমুনা টেলিভিশনের লোগো ও ফটোকার্ডের ডিজাইন।
কীভাবে চিনবেন ভুয়া ফটোকার্ড
সংবাদমাধ্যমের ভুয়া ফটোকার্ড চেনার সহজ কিছু উপায় হলো—
–কথিত ফটোকার্ডটির লেখা কপি করে তা গুগল ও ফেসবুকে সার্চ করে দেখা, নিজেকেই নিজে প্রশ্ন করা। ফটোকার্ড-সংশ্লিষ্ট সংবাদমাধ্যমটি এমন কোনো প্রতিবেদন করে থাকলে তা এই সার্চেই সাধারণত চলে আসবে।
–সংশ্লিষ্ট সংবাদমাধ্যমের ফেসবুক পেজের ফটোস অপশনে গিয়ে নির্দিষ্ট ফটোকার্ডটি খোঁজা। যদি সংবাদমাধ্যমটি এমন ফটোকার্ড প্রকাশ করে থাকে, তাহলে তা সহজে এখানে পাওয়া যাবে। তবে কোনো কোনো ক্ষেত্রে সংবাদমাধ্যম একটি ফটোকার্ড প্রকাশের পর তা কোনো কারণে সরিয়ে ফেলতে পারে। এসব ক্ষেত্রে কিছু অ্যাডভান্স অনুসন্ধানের প্রয়োজন হতে পারে।
–ফটোকার্ডে ব্যবহৃত শিরোনামের বানান খেয়াল করা। যেমন বিতর্কিত ব্লগার আসাদ নূরকে জড়িয়ে যমুনা টিভির লোগোসংবলিত ফটোকার্ডটিতে ক্যানসার বানান ‘কেন্সার’ লেখা হয়েছে।
–ফটোকার্ডে ব্যবহৃত শিরোনামের ফন্ট যাচাই করা। কারণ, সাধারণত প্রতিটি সংবাদমাধ্যমই নির্দিষ্ট ফন্ট ব্যবহার করে থাকে। সেটা সহজে ধরা যায়।
–সর্বোপরি, ফটোকার্ডের ক্ষেত্রে সব সময় সংবাদমাধ্যমের পেজ তথা মূল সোর্স থেকে দেখে নেওয়ার অভ্যাস করা জরুরি।