‘একটি দেশের জন্য গান’ নামে প্রামাণ্যচিত্রের উদ্বোধনী প্রদর্শনী শেষে মিলনায়তন ভর্তি দর্শক তখন দাঁড়িয়ে গেছেন। সবার করতালি যেন থামছেই না। সেই সঙ্গে কারও কারও চোখে আবেগের জল। কেউ কেউ চিৎকার করে বলছেন, ‘অসাধারণ’। এমনটাই ছিল দর্শকদের প্রতিক্রিয়া। আর এমনিভাবে ভালোবাসার বৃষ্টিতে ভিজল মুক্তিযুদ্ধের পক্ষে অসামান্য একটি উদ্যোগকে ঘিরে নির্মিত প্রামাণ্যচিত্রটি। দ্য কনসার্ট ফর বাংলাদেশকে ঘিরে প্রামাণ্যচিত্রটি নির্মাণ করেছেন লেখক ও সাংবাদিক শামীম আল আমিন; যার ইংরেজি নাম দেওয়া হয়েছে ‘সংস ফর আ কান্ট্রি’।
নিউইয়র্কের জ্যাকসন হাইটসের জুইশ সেন্টারে গত ৩১ জুলাই সন্ধ্যায় এই প্রামাণ্যচিত্রের উদ্বোধনী প্রদর্শনী অনুষ্ঠিত হয়। কনসার্ট ফর বাংলাদেশের ৫০ বছর উপলক্ষে এই বিশেষ অনুষ্ঠানের আয়োজন করা হয়। ফ্রেন্ডস অব ফ্রিডম নামে সংগঠনের আয়োজনে এই অনুষ্ঠানে নিউইয়র্ক ছাড়াও যুক্তরাষ্ট্রের অন্যান্য কয়েকটি স্টেট থেকেও অতিথিরা অংশ নেন। অনুষ্ঠানে বাংলাদেশের পররাষ্ট্রমন্ত্রী ড. এ কে আব্দুল মোমেন, তথ্যমন্ত্রী ড. হাছান মাহমুদ, যুক্তরাষ্ট্রের কংগ্রেসওম্যান গ্রেস মং ও যুক্তরাষ্ট্রে নিযুক্ত বাংলাদেশের রাষ্ট্রদূত এম সহিদুল ইসলামের ধারণকৃত বক্তব্য শোনানো হয়। এতে উপস্থিত ছিলেন নিউইয়র্কে বাংলাদেশের কনসাল জেনারেল সাদিয়া ফয়জুননেসা।
গোটা উৎসবটি উৎসর্গ করা হয় কনসার্ট ফর বাংলাদেশের অন্যতম দুই উদ্যোক্তা জর্জ হ্যারিসন ও পণ্ডিত রবি শংকরের প্রতি। বিশেষ সম্মাননা জানানো হয় কনসার্টে অংশ নেওয়া কিংবদন্তি সরোদ শিল্পী ওস্তাদ আলী আকবর খানকে। সেখানে উপস্থিত হয়ে বাবার পক্ষে সম্মাননা গ্রহণ করেন তাঁর বড় ছেলে ও বিশিষ্ট শিল্পী ওস্তাদ আশীষ খান। এ ছাড়া বিশেষ সম্মাননা দেওয়া হয় মুক্তিযুদ্ধের আমেরিকান বন্ধু ‘মুক্তির গান’ চলচ্চিত্রের চিত্রগ্রাহক লিয়ার লেভিনকে। কনসার্টের প্রত্যক্ষদর্শী লিন্ডা এন্তোনুচি অনুষ্ঠানে স্মৃতিচারণ করেন। তাঁর হাতে তুলে দেওয়া হয় স্মৃতিস্মারক।
অনুষ্ঠানে সম্মাননা গ্রহণ করে লিয়ার লেভিন বলেন, ‘আমি সেদিন নিজের ভেতরের অনুভূতি থেকে, দায়িত্ব পালনের জন্য ছুটে গিয়েছিলাম বাংলাদেশে। আমি বিশ্ববাসীকে জানাতে চেয়েছিলাম বাংলাদেশে কী নির্মমতা চলছে।’ তিনি বলেন, ‘এত বছর পরও বাংলাদেশের মানুষের কাছ থেকে যে সম্মান ও ভালোবাসা পাচ্ছি, তাতে আমি অভিভূত।’
কনসার্টে অংশ নেওয়া সব শিল্পীর প্রতি শ্রদ্ধা জানিয়ে ওস্তাদ আশীষ খান বলেন, ‘বাবার পক্ষে আরও একটি সম্মাননা গ্রহণ করলাম। বাবা সেদিন যা করেছিলেন, তার জন্য গর্ব বোধ করি।’
কনসাল জেনারেল সাদিয়া ফয়জুননেসা বলেন, ‘মুক্তিযুদ্ধের বিভিন্ন অধ্যায় নিয়ে এমনিভাবে আরও কাজ হতে পারে। যেন পরবর্তী প্রজন্ম আমাদের গৌরবের ইতিহাস ভালোভাবে জানতে পারে।’ তিনি প্রামাণ্যচিত্রটির নির্মাতা শামীম আল আমিনকে ধন্যবাদ জানান।
নির্মাতা শামীম আল আমিন বলেন, ‘১৯৭১ সালের ১ আগস্ট ছিল রোববার। ৫০ বছর পর সেই তারিখটি আবারও রোববার। এখন সময় বদলে গেছে। বাংলাদেশ এখন গৌরবের একটি দেশ। তবে বড় প্রয়োজনের সেই দিনগুলোতে যারা আমাদের পাশে ছিলেন, তাঁদের অবদানকে শ্রদ্ধার সঙ্গে তুলে ধরার এটি একটি প্রয়াস।’
অনুষ্ঠানের শুরুতে স্বাগত বক্তব্য রাখেন ফ্রেন্ডস অব ফ্রিডমের সমন্বয়ক ও প্রামাণ্যচিত্রের ক্রিয়েটিভ ডিরেক্টর আশরাফুন নাহার লিউজা। শুভেচ্ছা বক্তব্য রাখেন সংগঠনটির উপদেষ্টা ডা. প্রতাপ দাস। সঞ্চালনা করেন নাফিসা আহমেদ।
শেষে সরোদ পরিবেশন করেন গ্র্যামি অ্যাওয়ার্ডের জন্য মনোনীত শিল্পী ওস্তাদ আশীষ খান। মনোমুগ্ধকর সেই আয়োজনে সেতারে ছিলেন মোর্শেদ খান অপু এবং তবলায় তপন মোদক। উৎসবের এই অংশটিও সবাইকে গভীর আনন্দে ভাসায়। ১৯৭১ সালে কনসার্ট ফর বাংলাদেশে সরোদ বাজিয়েছিলেন বাবা ওস্তাদ আলী আকবর খান। সেই কনসার্টের ৫০ বছর পূর্তির উৎসবে সরোদ বাজিয়ে সবার অন্তরকে ছুঁয়ে গেলেন ছেলে ওস্তাদ আশীষ খান।
পররাষ্ট্রমন্ত্রী ড. এ কে আব্দুল মোমেন প্রামাণ্যচিত্রটির নির্মাতাকে বিশেষভাবে ধন্যবাদ জানিয়ে বলেন, ‘এই আয়োজন ইতিহাসের চমৎকার একটি অধ্যায় তুলে ধরার চমৎকার প্রয়াস। ভবিষ্যৎ প্রজন্মের জন্য এটি অসাধারণ একটি দলিল হয়ে থাকবে। সেদিনের কনসার্টটির গুরুত্ব ছিল অনেক, যা বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধের পক্ষে বিশ্বজনমত গঠনে বিশেষ ভূমিকা রেখেছিল।’ বর্তমানে বাংলাদেশ যে উন্নয়নের পথ ধরে সারা বিশ্বের রোল মডেল—সে কথাও তুলে ধরেন তিনি।
তথ্যমন্ত্রী ড. হাছান মাহমুদ বলেন, ‘১৯৭১ সালে আমাদের মহান মুক্তিযুদ্ধের সময় বিশ্বব্যাপী জনগণ আমাদের সমর্থন দিয়েছিল। মুক্তিযুদ্ধের পক্ষে জনসমর্থন আদায়ে কাজ করেছিলেন অনেকে। শিল্পীরাও এ ক্ষেত্রে পিছিয়ে ছিলেন না।’ কনসার্ট ফর বাংলাদেশের উদ্যোক্তা ও অংশগ্রহণকারীদের ধন্যবাদ জানিয়ে তিনি বলেন, ‘৫০ বছর পর বাংলাদেশ এখন বিশ্বের বুকে মাথা উঁচু করে দাঁড়িয়ে থাকা একটি জাতি।’
মার্কিন কংগ্রেসওম্যান গ্রেস মং বলেন, ‘সেদিনের কনসার্টটি বিশ্বব্যাপী মানুষের হৃদয় স্পর্শ করেছিল। আজ তার ৫০ বছর পূর্ণ হয়েছে। কংগ্রেসে চমৎকার এই বাংলাদেশি কমিউনিটির প্রতিনিধিত্ব করতে পেরে আমি সত্যিই গর্বিত।’
রাষ্ট্রদূত এম সহিদুল ইসলাম বলেন, ‘সেই কনসার্টের মাধ্যমে বিশ্ববাসী বাংলাদেশের মুক্তিসংগ্রাম সম্পর্কে ভালো করে জানতে পারে। যা বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধের পক্ষে জনমত গঠনে বলিষ্ঠ ভূমিকা রেখেছিল।’ কনসার্টের ৫০ বছর পূর্তির উৎসবকে স্বাগত জানান তিনি।