মিরাজ হলো ঊর্ধ্বগমন বা সফর; অর্থাৎ মসজিদুল হারাম থেকে মসজিদুল আকসা; সেখান থেকে সাত আসমান পাড়ি দিয়ে সিদরাতুল মুনতাহা; তারপর মহান আল্লাহর সাক্ষাৎ পর্যন্ত রাসুলুল্লাহ (সা.)-এর মহিমান্বিত সফর। মিরাজের সফরে রাসুলুল্লাহ (সা.)-কে বিভিন্ন নিদর্শন দেখানো হয়েছে। এর মধ্যে নানা পাপকর্মের শাস্তিও রয়েছে। রাসুলুল্লাহ (সা.) উম্মতকে সবই জানিয়ে দিয়েছেন। এর মাধ্যমে ইমানের দৃঢ়তা অর্জনের অনুপ্রেরণা এবং পাপ থেকে বাঁচার মহান শিক্ষাও যোগ হয়েছে। তবে মিরাজের বড় প্রাপ্তি হলো, পাঁচ ওয়াক্ত নামাজ। ইসলামের মৌলিক স্তম্ভগুলোর মধ্যে নামাজ অন্যতম শ্রেষ্ঠ ইবাদত।
মিরাজের প্রেক্ষিত
ইসলাম প্রচারের শুরু থেকেই রাসুল (সা.) ও তাঁর অনুসারীদের ওপর নেমে আসে নানা ধরনের অত্যাচার, জুলুম ও নির্যাতন। এসবে অতিষ্ঠ হয়ে একপর্যায়ে কিছু মুসলমান আবিসিনিয়ায় হিজরত করেন। কুরাইশরা তাঁদের ফিরিয়ে আনতে আবিসিনিয়ার বাদশার কাছে লোক পাঠিয়ে ব্যর্থ হয়। এদিকে হামজা ও ওমর (রা.)-এর মতো বীরপুরুষেরাও ইসলাম গ্রহণ করেন। এভাবে প্রতিনিয়ত ইসলামের আলো একটু একটু করে বিকশিত হতে থাকে। তখন কুরাইশরা সিদ্ধান্ত নেয়; মুহাম্মদ (সা.), তাঁর গোত্র বনু হাশিম এবং তাঁদের সাহায্যকারীদের সঙ্গে সব সম্পর্ক ছিন্ন করা হবে। ওঠাবসা, লেনদেন, বিয়েশাদি, সাহায্য-সহযোগিতা—সবকিছুই বন্ধ থাকবে। এ মর্মে চুক্তিপত্র লিখে কাবাঘরের দেয়ালে ঝুলিয়ে দেওয়া হয়। বাধ্য হয়ে আবু তালিব স্বীয় গোত্রসহ শিয়াবে আবু তালিবে আশ্রয় নেন। বনু মুত্তালিব মুমিন-কাফির সবাই সেখানে অনেক দুঃখ-কষ্টে দিন কাটাতে থাকেন। নবুওয়াতের দশম বছরের শাওয়াল মাসে নবী (সা.)-এর চাচা আবু তালিব ইন্তেকাল করেন। এর কয়েক দিন পর তাঁর সহধর্মিণী খাদিজাতুল কুবরা (রা.) ইন্তেকাল করেন। তাঁদের ইন্তেকালে রাসুলুল্লাহ (সা.) খুবই বিচলিত হন। আবু তালিব ঘরের বাইরে এবং খাদিজাতুল কুবরা (রা.) ঘরে রাসুল (সা.)-কে শক্তি ও সাহস জোগাতেন। ইতিহাসে বছরটি শোকের বছর হিসেবে পরিচিতি পায়। এর কিছুদিন পর রাসুলুল্লাহ (সা.) তায়েফ গিয়ে সীমাহীন লাঞ্ছনার শিকার হন। শিয়াবে আবু তালিবের বন্দিজীবন, শোক-দুঃখ আর তায়েফের মর্মন্তুদ প্রস্তরাঘাতের মাধ্যমে যখন রাসুলুল্লাহ (সা.) ও তাঁর অনুসারীদের ওপর মুশরিকদের অত্যাচার চূড়ান্ত পর্যায়ে পৌঁছায়, তখনই মহান আল্লাহ তাঁকে মিরাজ নামক এক মর্যাদাপূর্ণ শোভাযাত্রার মাধ্যমে সম্মানিত করেন। (সিরাতুল মুস্তফা, ১/২৮৮-২৮৯)
মিরাজের তাৎপর্য
প্রথমত, আল্লাহর পথে নির্যাতিত ও লাঞ্ছিত হওয়ার প্রতিদান সম্মান, উচ্চাসন ও ঊর্ধ্ব গমনই হয়ে থাকে। মিরাজের সফরে সেটিরই বাস্তব চিত্র ফুটে উঠেছে।
দ্বিতীয়ত, সব নবী-রাসুলের মধ্যে রাসুলুল্লাহ (সা.)-এর শ্রেষ্ঠত্ব প্রমাণিত হয়েছে। মসজিদে আকসায় সব নবী-রাসুল সমবেত ছিলেন। রাসুলুল্লাহ (সা.) সেখানে পৌঁছানোর পর আজান ও একামত দেওয়া হয়। সব নবী ও রাসুল কাতারবন্দী হয়ে দাঁড়িয়ে যান। জিব্রাইল (আ.) রাসুলুল্লাহ (সা.)-এর হাত ধরে ইমামতির জন্য সামনে বাড়িয়ে দেন। রাসলুল্লাহ (সা.) ইমামতি করেন। (সিরাতুল মুস্তফা, /২৯৫-২৯৬)
তৃতীয়ত, নামাজ অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ ইবাদত। মহান আল্লাহ ইসলামের অন্যান্য নির্দেশনা অহির মাধ্যমে প্রদান করলেও রাসুলুল্লাহ (সা.)-কে মিরাজে ডেকে নিয়ে নামাজ দান করেন। ইমানদারেরা নামাজ আদায়ের মাধ্যমে আল্লাহর সাহায্য লাভ করতে পারে। আল্লাহ্ বলেন, ‘হে মুমিনগণ, তোমরা ধৈর্য ও নামাজের মাধ্যমে সাহায্য প্রার্থনা করো।’ (সুরা বাকারা, আয়াত: ১৫৩)
মিরাজের সত্যতা
মিরাজের বিষয়টি কোরআন ও বিশুদ্ধ হাদিস দ্বারা প্রমাণিত। কাজেই মিরাজের সত্যতা নিয়ে সন্দেহ করার কোনো অবকাশ নেই। আবু বকর সিদ্দিক (রা.) মিরাজের সত্যতা এক বাক্যে স্বীকার করে নিয়েই ইসলামে সিদ্দিক (সত্যায়নকারী) উপাধিতে ভূষিত হয়েছেন। মিরাজের বর্ণনায় আল্লাহ বলেন, ‘পবিত্র ও মহিমাময় তিনি, যিনি তাঁর বান্দাকে [মুহাম্মাদ (সা.)] রাতের বেলায় ভ্রমণ করিয়েছেন মসজিদুল হারাম থেকে মসজিদুল আকসা পর্যন্ত। যার পরিবেশ আমি করেছিলাম বরকতময়, তাকে আমার নিদর্শন দেখানোর জন্য; তিনিই সর্বশ্রোতা, সর্বদ্রষ্টা।’ (সুরা বনি ইসরাইল, আয়াত: ১)
মিরাজের ঘটনাপ্রবাহ
মসজিদুল হারাম থেকে মসজিদুল আকসা, সেখান থেকে শুরু হয় ঊর্ধ্বগমন। রাসুলুল্লাহ (সা.)-কে নিয়ে যাওয়া হয় সাত আসমানের ওপর। পথে প্রথম আসমানে আদম (আ.), দ্বিতীয় আসমানে ইয়াহইয়া ও ঈসা (আ.), তৃতীয় আসমানে ইউসুফ (আ.), চতুর্থ আসমানে ইদরিস (আ.), পঞ্চম আসমানে হারুন (আ.), ষষ্ঠ আসমানে মুসা (আ.) ও সপ্তম আসমানে ইবরাহিম (আ.)-এর সঙ্গে সাক্ষাৎ হয়। সেখানে রাসুল (সা.) সিদরাতুল মুনতাহা, জান্নাত, জাহান্নামসহ আল্লাহর অসংখ্য নিদর্শন দেখেন। এরপর রাসুলুল্লাহ (সা.) মহান আল্লাহর দিদার লাভ করেন। আব্বাস (রা.) থেকে বর্ণিত, তিনি বলেন, আল্লাহর বাণী—‘তিনি যা দেখেছেন, তাঁর অন্তঃকরণ তা অস্বীকার করেনি এবং নিশ্চয়ই তিনি তাঁকে আরেকবার দেখেছেন।’ -এর মর্মার্থ হলো, রাসুলুল্লাহ (সা.) তাঁর রবকে অন্তঃকরণ দ্বারা দুবার দেখেছেন। (মুসলিম, হাদিস: ৪৫৫) রাসুলুল্লাহ (সা.) সব ইবাদত আল্লাহর সামনে উপস্থাপন করেন। আল্লাহ তাআলা তাঁকে সালাম, রহমত ও বরকত প্রদান করেন। রাসুলুল্লাহ (সা.) আল্লাহর দেওয়া সালামে সব নেককার বান্দাকে শামিল করেন। নামাজে পঠিত ‘আত্তাহিয়্যাতু’তে যা বিবৃত হয়েছে।
মিরাজের অনন্য প্রাপ্তি নামাজ
মিরাজের সবচেয়ে বড় প্রাপ্তি হলো পাঁচ ওয়াক্ত নামাজ। সঠিক, সুন্দর ও একনিষ্ঠ হয়ে নামাজ আদায় একজন মানুষকে মহান আল্লাহর সান্নিধ্যলাভে সক্ষম করে। মহান আল্লাহ নবী (সা.)-কে সাত আসমান পার করে ঊর্ধ্বালোকে তাঁর কাছে নিয়ে গিয়ে নামাজের বিধান দিয়েছেন। অন্য কোনো ইবাদতের ক্ষেত্রে এমনটি হয়নি। সুতরাং নামাজ যে অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ, তা বলার অপেক্ষা রাখে না। প্রথমে আল্লাহ তাআলা ৫০ ওয়াক্ত নামাজই ফরজ করেছিলেন। তবে পরে হজরত মুসা (আ.)-এর পরামর্শে মহানবী (সা.) আল্লাহর কাছে গিয়ে কমিয়ে দেওয়ার সুপারিশ করেন। এভাবে শেষ পর্যন্ত ৫ ওয়াক্ত নামাজ ফরজ করা হয়। হাদিসে এসেছে, শেষে আল্লাহ বললেন, ‘এই পাঁচই (নেকির দিক দিয়ে) পঞ্চাশ (বলে গণ্য হবে)। আমার কথার কোনো রদবদল হয় না।’ (মুসলিম, হাদিস: ১৬৩)
লেখক: সহযোগী অধ্যাপক, আরবি বিভাগ, রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়