হোম > জাতীয়

লুটপাটে গায়েব কৃষকের যন্ত্র কেনার টাকা

সাইফুল মাসুম, ঢাকা 

কর্মকর্তাদের দুর্নীতিতে ব্যর্থতায় পর্যবসিত হয়েছে তিন হাজার কোটি টাকার ‘সমন্বিত ব্যবস্থাপনার মাধ্যমে কৃষি যান্ত্রিকীকরণ প্রকল্প’। যন্ত্র কেনার জন্য কৃষককে প্রদেয় ভর্তুকির টাকার বড় অংশ হয়েছে লুটপাট। কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তরের পাঁচ বছর মেয়াদি প্রকল্পটি শেষ হবে চলতি বছরের জুনে। তবে দুর্নীতির দায় মাথায় নিয়ে এটি আর এগিয়ে নিতে আগ্রহী নন কর্মকর্তারা। তাই ব্যয় না করেই প্রকল্পে বরাদ্দ করা প্রায় ৪০০ কোটি টাকা মন্ত্রণালয়ে ফেরত পাঠিয়েছেন তাঁরা।

বাণিজ্যিকীকরণ ও আধুনিকায়নের মাধ্যমে কৃষিকে লাভজনক করে তোলার উদ্দেশ্যে ‘সমন্বিত ব্যবস্থাপনার মাধ্যমে কৃষি যান্ত্রিকীকরণ’ প্রকল্প হাতে নিয়েছিল সরকার। এই প্রকল্পে উন্নয়ন সহায়তার (ভর্তুকি) মাধ্যমে কৃষকদের ১২ ধরনের ৫১ হাজার ৩০০টি কৃষিযন্ত্র দেওয়ার কথা। কৃষিযন্ত্র কেনার জন্য হাওর ও উপকূলীয় এলাকার কৃষকদের ৭০ শতাংশ এবং অন্য সব এলাকার কৃষকদের ৫০ শতাংশ ভর্তুকি দেওয়ার কথা রয়েছে।

মাঠপর্যায়ের তথ্য থেকে জানা গেছে, বহু প্রকৃত কৃষক এ ভর্তুকির ছিটেফোঁটাও পাননি। টাকা জমা দিয়ে যন্ত্রের অপেক্ষায় বসে থাকার নজির যেমন আছে, তেমনি আছে কৃষি পেশার বাইরের লোককে যন্ত্র দেওয়ার ঘটনা। কৃষকদের সঙ্গে কথা বলে এবং খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, প্রকল্পের মোটা অঙ্কের ভর্তুকির সুবিধায় ভাগ বসিয়েছে তিনটি চক্র। চক্র তিনটি হচ্ছে অসাধু কৃষি কর্মকর্তা, যন্ত্র সরবরাহকারী বিভিন্ন কোম্পানি এবং জেলা-উপজেলা পর্যায়ের দালাল। এই দালালেরা মূলত তৎকালীন ক্ষমতাসীন দল আওয়ামী লীগের রাজনীতির সঙ্গে যুক্ত। তাঁদের সুপারিশে উপজেলা কর্মকর্তারা কৃষকদের নাম সুবিধাভোগীর তালিকাভুক্ত করেন। ঘুষ হাতবদল হয়েছে তাঁদের মাধ্যমে। অনেক সময় দালালেরা নিজেদের নামেই ভর্তুকিতে যন্ত্র কিনে বাইরে অনেক বেশি দামে বিক্রি করে দিয়েছে। এমনকি একই যন্ত্র একাধিকবার বিক্রি করে বারবার ভর্তুকি নেওয়ার অভিযোগের সত্যতা মিলেছে এই প্রকল্পে। কৃষিযন্ত্র নষ্ট হলে কোম্পানিগুলো বিক্রয়োত্তর সেবা দেয়নি বলে অভিযোগ করেছেন অনেক কৃষক।

জানা গেছে, শেষ বছরে এসে দুর্নীতির দায়ে সাবেক প্রকল্প পরিচালক (পিডি) তারিক মাহমুদুল ইসলামসহ আট কর্মকর্তাকে সাময়িক বরখাস্ত করেছে কৃষি মন্ত্রণালয়। দুর্নীতি দমন কমিশন (দুদক) ও বিভিন্ন সংস্থার তদন্তে বেরিয়ে আসছে কৃষককে ভর্তুকি দেওয়ার নামে অর্থ লোপাটের অনেক তথ্য। মন্ত্রণালয়ের তথ্য অনুসারে, অনিয়মের অপরাধে বরখাস্ত হতে পারেন প্রকল্পসংশ্লিষ্ট আরও অন্তত ৫০ কর্মকর্তা। এমন পরিস্থিতিতে শেষ অর্থবছরে প্রকল্পের তেমন কোনো অগ্রগতি হয়নি। আগের দায় না নিতে এখন তড়িঘড়ি করে কাজ গোটাতে চাইছেন বর্তমান প্রকল্প পরিচালক মোহাম্মদ সফিউজ্জামান। এ নিয়ে জানতে চাইলে তিনি আজকের পত্রিকাকে বলেন, ‘কয়েক মাস হলো প্রকল্প পরিচালক হয়েছি। কোনো কাজ করতে পারিনি। এ সময়ে ভর্তুকিতে একটি যন্ত্রও সরবরাহ করিনি। আগের অনিয়ম আর দুর্নীতির জবাব দিতে দিতেই ক্লান্ত। শেষ সময়ে প্রকল্পের বাকি কাজ করাও সম্ভব নয়, তাই চলতি অর্থবছরে বরাদ্দের ৪২১ কোটি টাকা ফেরত দিচ্ছি।’

প্রকল্পের তথ্য বলছে, ২০২৪-২৫ অর্থবছরের বার্ষিক উন্নয়ন কর্মসূচি অনুসারে প্রকল্পে বরাদ্দ ধরা হয়েছিল ৫০৮ কোটি টাকা। গত ডিসেম্বর পর্যন্ত ছয় মাসে ব্যয় হয়েছে প্রায় ৫৩ কোটি টাকা। অর্থাৎ অর্থবছরের অর্ধেক পেরোলেও আর্থিক অগ্রগতি মাত্র ১০ শতাংশ। ২০২৫ সালের জুন পর্যন্ত বাকি ছয় মাসের জন্য কিছু টাকা হাতে রেখে প্রায় ৪০০ কোটি টাকা মন্ত্রণালয়ে ফেরত পাঠানো হয়েছে।

অনিয়মের নানা কিসিম

২০২২-২৩ অর্থবছরে কক্সবাজারের চকরিয়া উপজেলার দরবেশ কাটা গ্রামের কৃষক আজম নুরের নামে একটি কম্বাইন হারভেস্টার বরাদ্দ দেখানো হয়েছে। কাগজে-কলমে তাঁকে ভর্তুকি দেওয়া হয়েছে ২১ লাখ ৬৩ হাজার টাকা (৭০ শতাংশ)। কিন্তু আজম নুর টাকা দিয়েও যন্ত্র পাননি। তিনি বলেন, ‘ঋণ নিয়ে ৯ লাখ টাকা দিয়েছি। মেশিন দেখিয়ে নিয়ে গেছে। এখনো মেশিন পাইনি, টাকাও ফেরত দেয়নি।’

দিনাজপুর জেলার ফুলবাড়ী উপজেলার কৃষক মো. মিজানুর রহমান ৫০ শতাংশ ভর্তুকিতে কম্বাইন হারভেস্টার কেনার আবেদন করেছিলেন। কাগজে-কলমে কৃষি অফিস তাঁকেও যন্ত্র বরাদ্দ দিয়েছে। কিন্তু মিজানুর জানিয়েছেন, তিনি কোনো যন্ত্র পাননি।

সরাসরি কৃষিকাজে যুক্ত না থাকলেও ২০২৩ সালের জানুয়ারিতে ৭০ শতাংশ ভর্তুকিতে টি সিডার (পাওয়ার টিলারের সঙ্গে বীজ বপনের যন্ত্র) পেয়েছিলেন নোয়াখালীর হাতিয়া উপজেলার পশ্চিম সোনাদিয়ার বাসিন্দা আমির হোসেন সাজু। খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, স্থানীয় ইউনিয়ন পরিষদের (ইউপি) চেয়ারম্যান মেহেদী হাসানের ঘনিষ্ঠ হিসেবে পরিচিত আমির পরে যন্ত্রটি বিক্রি করে দেন। এ বিষয়ে চেয়ারম্যান মেহেদী হাসান সাজুর সঙ্গে সম্পর্কের বিষয় অস্বীকার না করলেও দাবি করেন, তিনি (সাজু) নিজে আবেদন করেছিলেন। যন্ত্র পেয়েছেন বা বিক্রি করে দিয়েছেন কি না, তা তাঁর জানা নেই।

সরবরাহকারীর তালিকাসহ নানা অনিয়ম

অভিযোগ রয়েছে, ডিপিপিতে উল্লেখ করা প্রাতিষ্ঠানিক যোগ্যতা না থাকা সত্ত্বেও অযোগ্য সরবরাহকারীদের তালিকাভুক্ত করা হয়েছে। ‘উন্নয়ন সহায়তা ব্যবস্থাপনা কমিটি’র সভায় মাঠের চাহিদার সঙ্গে এডিপির অর্থ বরাদ্দের সমন্বয় করে উপজেলা পর্যায়ে যন্ত্র বরাদ্দের সংখ্যা চূড়ান্ত করার কথা। অথচ ২০২২-২৩ অর্থবছরে এই কমিটির একটি সভাও হয়নি। তখনকার পিডি মো. তারিক মাহামুদুল ইসলাম তাঁর পছন্দমতো যন্ত্র বরাদ্দ দিয়েছেন বলে অভিযোগ।

বেশি দামে যন্ত্র সরবরাহ

মন্ত্রণালয়ের অনুমোদন ও উন্নয়ন প্রকল্প প্রস্তাব (ডিপিপি) সংশোধন না করে কম্বাইন হারভেস্টারের ক্ষেত্রে ৭০ শতাংশ ভর্তুকির হারে ১৭ লাখ ৫০ হাজার টাকার জায়গায় প্রায় ২১ লাখ ৬৩ হাজার টাকা এবং ৫০ শতাংশ ভর্তুকির হারে ১২ লাখ ৫০ হাজার টাকার জায়গায় প্রায় ১৫ লাখ ৮৫ হাজার টাকা ব্যয়ে যন্ত্র সরবরাহ করা হয়েছে। প্রকল্পসংশ্লিষ্ট কিছু কর্মকর্তা বলেছেন, এটি ডিপিপির আর্থিক শৃঙ্খলার মারাত্মক লঙ্ঘন। অনিয়ম ও দুর্নীতির জেরেই ১২ ক্যাটাগরির ৫১ হাজার ৩০০টি যন্ত্রের বিপরীতে ৩ হাজার ৩০০ কোটি টাকার বেশি খরচ হয়ে গেছে। অথচ যন্ত্র সরবরাহ করা হয়েছে মাত্র ৪০ হাজার ৬৫৬টি। এর মধ্যে সবচেয়ে বেশি দামের যন্ত্র কম্বাইন হারভেস্টারের সংখ্যা তুলনামূলকভাবে কম—১০ হাজার ৯৬৩টি। কৃষককে মোট দেওয়ার কথা ছিল ১৫ হাজার ৫০০টি। প্রকল্পের চতুর্থ বছরেই বরাদ্দ করা ভর্তুকির অর্থ প্রায় শেষ হয়ে গেছে। এ জন্য যন্ত্র সরবরাহের সঙ্গে ব্যয়িত অর্থের সংগতি পাচ্ছেন না প্রকল্পসংশ্লিষ্টরা। কর্মকর্তারা জানিয়েছেন, কোম্পানিগুলোর সঙ্গে যোগসাজশ করে অযোগ্য কোম্পানি তালিকাভুক্ত করা এবং ভুয়া বিল তৈরি করে অর্থ ভাগাভাগির প্রমাণ পাওয়া গেছে। এরপরও অভিযোগ ওঠা উপপ্রকল্প পরিচালক আলতাফুন নাহার, ঊর্ধ্বতন হিসাবরক্ষক আব্দুল খালেক সরকার ও সহকারী হিসাবরক্ষক আরমান মিয়ার বিরুদ্ধে এখন পর্যন্ত কোনো ব্যবস্থা নেওয়া হয়নি।

সার্বিক বিষয়ে জানতে চাইলে কৃষিসচিব মোহাম্মদ এমদাদ উল্লাহ মিয়ান বলেন, ‘অনিয়মের প্রমাণ পাওয়ায় কিছু কর্মকর্তার বিরুদ্ধে শাস্তিমূলক ব্যবস্থা নেওয়া হয়েছে। দুদকের তদন্ত রিপোর্ট অনুযায়ী অন্য অপরাধীদের বিষয়েও ব্যবস্থা নেওয়া হবে।’ টাকা ফেরতের বিষয়ে সচিব বলেন, ‘প্রজেক্টের মেয়াদ আছে অল্প। কৃষককে ভর্তুকিতে যন্ত্র দেওয়ার বাস্তব চিত্র নিয়ে আমরা সন্তুষ্ট না। তাই প্রকল্পের মেয়াদ আর বাড়াব না।’

অন্তর্বর্তী সরকারের দুর্নীতি দমন সংস্কার কমিশনের প্রধান ও ট্রান্সপারেন্সি ইন্টারন্যাশনাল বাংলাদেশের (টিআইবি) নির্বাহী পরিচালক ইফতেখারুজ্জামান এ বিষয়ে বলেন, ‘কৃষি মন্ত্রণালয়ের তদন্তে যেহেতু বড় ধরনের দুর্নীতি চিহ্নিত হয়েছে, তাই অপরাধী কর্মকর্তাদের সাময়িক বরখাস্ত বা বিভাগীয় ব্যবস্থা যথেষ্ট না। আইনি প্রক্রিয়ায় জরিমানাসহ সাজা নিশ্চিত করতে হবে। রাজনৈতিক ব্যক্তি ও যন্ত্র সরবরাহকারী কোম্পানিরও দায় এড়ানোর সুযোগ নেই। তাদেরও বিচারের মুখোমুখি করতে হবে।’

মালয়েশিয়ায় ৭১ জন অবৈধ বাংলাদেশি আটক

বাংলাদেশের অন্তর্বর্তী সরকারের প্রতি বিশ্বব্যাংকের সমর্থন পুনর্ব্যক্ত

সদা প্রস্তুত থাকতে ইস্ট বেঙ্গল রেজিমেন্টকে সেনাপ্রধানের আহ্বান

স্টারলিংকের স্যাটেলাইট ইন্টারনেট আনছে বাংলালিংকের মালিক ভিওন

দুই ফেসবুক পেজের বিরুদ্ধে মামলা করলেন সারজিস

ছাত্র-জনতার দল গঠন বানচালে বিএনপি-আ.লীগের আঁতাত চলছে: হাসনাত আবদুল্লাহ

ফেসবুককে গুজব প্রতিরোধ জোরদারের আহ্বান ড. ইউনূসের

আইএসআই প্রধানের ঢাকা সফরের খবরটি ভুয়া: প্রধান উপদেষ্টার প্রেস উইং

সলিমুল্লাহ খানসহ দশ গুণী পাচ্ছেন বাংলা একাডেমি সাহিত্য পুরস্কার

নিয়োগে রাজনৈতিক দলের হস্তক্ষেপ অনুচিত, কাকে ইঙ্গিত করলেন আসিফ

সেকশন