বিদেশি ভাষার শব্দ হলেও বাংলা ভাষায় পরিচিত একটি শব্দ ‘বুমেরাং’। পরিস্থিতির প্রসঙ্গ অনুসারে আমরা বুমেরাং শব্দটি ব্যবহার করে থাকি। শব্দটির আক্ষরিক অর্থ একটি অস্ত্রকে বোঝালেও আমরা আলংকারিক অর্থে শব্দটি প্রয়োগ করি। কিন্তু আমরা কি জানি বুমেরাং শব্দটি কীভাবে বাংলা ভাষায় প্রবেশ করল? বুমেরাং শব্দটি শোনার সঙ্গে সঙ্গে আমাদের বোমাবাজি বা বোমা ফাটানোর কথা মনে হতে পারে। কিন্তু এর সঙ্গে বুমেরাং শব্দের আদৌ কি কোনো সম্পর্ক রয়েছে? তবে চলুন আজ জানব বুমেরাং শব্দের আদ্যোপান্ত।
বুমেরাং শব্দটি এসেছে অস্ট্রেলিয়ার নিউসাউথ ওয়েলসের অধুনালুপ্ত অ্যাবরোজিনাল ভাষা থেকে। এটি বিশেষ্য পদ। আভিধানিকভাবে এর অর্থ হলো (শিকারের অস্ত্ররূপে অস্ট্রেলিয়ার আদিবাসীদের ব্যবহৃত) শক্ত ও হালকা কাঠের বাঁকানো ক্ষেপণাস্ত্রবিশেষ যা নিক্ষেপ করলে লক্ষ্যবস্তুকে আঘাত করার পর আবার নিক্ষেপকারীর হাতে ফিরে আসে। আর আমাদের বাস্তব জীবনে তথা আলংকারিকভাবে বুমেরাং বলতে বোঝায় কারও উদ্দেশ্যে অসৎ কোনোকিছু করলে বা কারও ক্ষতিসাধন করলে তা যখন উল্টো নিজেরই ক্ষতির কারণ হয় অর্থাৎ আত্মঘাতী কোনো পরিকল্পনা। অন্যভাবে বলতে পারি, নিজের অস্ত্র বা যুক্তিতে নিজেই ঘায়েল হওয়া অথবা নিজের জালে নিজেই জড়ানো হলো বুমেরাং হওয়া।
ইতিহাস থেকে জানা যায় প্রাচীন মিসরীয়, আমেরিকার ক্যালিফোর্নিয়া ও অ্যারিজোনার আদিবাসী এবং দক্ষিণ ভারতীয়রা পাখি, খরগোশ প্রভৃতি মারার জন্য বুমেরাং ব্যবহার করত। অঞ্চলভেদে বুমেরাং শব্দটি উচ্চারণে পার্থক্যও পরিলক্ষিত হয়। বুমেরাং শব্দের আরেক ধরনের উচ্চারণ পাওয়া যায়, সেটি হলো ‘উ-মার-রাং’ (wo-mur-rang)। বুমেরাং হলো একখণ্ড বক্রাকৃতি কাঠ, যা অস্ত্র হিসেবে বা খেলার জন্য ব্যবহৃত হয়। এটি দেখতে অর্ধ চন্দ্রাকৃতির। পৃথিবীতে অঞ্চলভেদে বিভিন্ন আকারের বুমেরাং দেখা যায়। তবে সবচেয়ে পরিচিত হলো প্রত্যাবর্তনক্ষম বুমেরাং, যা সঠিক পদ্ধতিতে নিক্ষেপ করা হলে উপবৃত্তাকার পথে প্রদক্ষিণ করে পুনরায় নিক্ষেপকারীর হাতেই ফিরে আসে। তবে কিছু কিছু বুমেরাং নিক্ষেপকারীর কাছে ফিরে আসে না; এসব বুমেরাং অস্ত্র হিসেবে ব্যবহৃত হয়। বিশেষ করে এগুলো হাতাহাতি লড়াইয়ে অস্ট্রেলিয়ায় ব্যবহৃত হতো। আর প্রত্যাবর্তনক্ষম বুমেরাং বর্তমানে খেলার সামগ্রী হিসেবে বিনোদনের জন্য ব্যবহৃত হয়।
আধুনিক বুমেরাংগুলো বিভিন্ন আকার এবং প্রকৃতির হয়ে থাকে। এগুলো তৈরিতে যথোপযুক্ত উপকরণ ব্যবহৃত হয়। কাঠ ও হাড় বুমেরাং তৈরির প্রধান উপকরণ। আদিম শিকারিরা নানা কৌশলে বুমেরাং তৈরি করত। তবে বর্তমানে খেলার জন্য নানা ধরনের বুমেরাং তৈরি করা হয় প্লাস্টিকসহ নানা উপকরণ সহযোগে। বুমেরাং তৈরির সময় এটির ওজন ৭০ থেকে ১১০ গ্রামের মধ্যে রাখা যুক্তিযুক্ত, কেননা এতে এটির ভারসাম্য বজায় থাকে। এটি ডান কিংবা বাম দুই হাত দিয়েই চালানো সম্ভব। তবে যে হাতেই ছোড়া হোক না কেন এর জন্য বিশেষ দক্ষতার প্রয়োজন রয়েছে। ডানহাতি বুমেরাংগুলো ঘড়ির কাঁটার উল্টো দিকে ঘুরতে ঘুরতে ঘড়ির কাঁটার বিপরীত পথে ফিরে আসে। বাঁহাতিগুলো ঠিক এর বিপরীত। খেলার সময় সাধারণত খোলা প্রান্তরে এটি ছোড়া হয়। দূরত্বের বিচারে এগুলো প্রায় ২০ থেকে ৪০ মিটারের বেশি দূর পর্যন্ত যেতে পারে।
বুমেরাং অস্ত্রটি প্রথম তৈরি করেছিল আদিম অস্ট্রেলীয়রা। এটি তৈরির উদ্দেশ্য ছিল শক্তিশালী জন্তু-জানোয়ারদের সহজেই কুপোকাত করা। তা ছাড়া প্রাচীনকালের যুদ্ধবিগ্রহে যুগপৎ পদাতিক এবং অশ্বারোহী বাহিনীর প্রধান অস্ত্র ছিল এই বুমেরাং। আদিম অস্ট্রেলীয়দের অনুকরণে প্রাচীন ভারতীয়দের মধ্যেও এর ব্যবহার শুরু হয় এবং ক্রমে তারা এ বিষয়ে পারদর্শী হয়ে ওঠে। এর প্রমাণ মেলে কেন্দ্রীয় বিজ্ঞান জাদুঘরে সজ্জিত অজস্র দেয়ালচিত্র দেখে। তবে এ কথা অনস্বীকার্য যে সবচেয়ে ভয়ংকর ছিল প্রাচীন অস্ট্রেলীয়দের ব্যবহৃত বুমেরাং। প্রকৃতপক্ষে বুমেরাং চালনা কোনো জাদুবিদ্যা নয়। পদার্থবিজ্ঞানের একটি মৌলিক সূত্রের মাধ্যমে এটি কাজ করে। এর কয়েকটি বৈশিষ্ট্য হলো: এতে বিমানের প্রপেলারের মতো প্যাঁচ রয়েছে; এটি চলার সময় নানা রকম পাক খেয়ে এঁকেবেঁকে চলতে পারে এবং কোনো কারণে এটি লক্ষ্যভ্রষ্ট হলে ফের নিক্ষেপকারীর হাতেই ফিরে আসে।
এ বিষয়ে কোনো সন্দেহ নেই যে আদিম শিকারিদের অসাধারণ একটি আবিষ্কার হলো বুমেরাং। কিন্তু সাম্প্রতিককালে আমরা এর আক্ষরিক অর্থটি ব্যবহার করছি খেলনা হিসেবে আর আলংকারিক অর্থটি ব্যবহার করছি দৈনন্দিন কথোপকথনে। সুতরাং কৌশলগত কারণে বুমেরাং ব্যবহার করলেও তা যেন আমাদের হিতে বিপরীত না হয় সেদিকে লক্ষ রাখা সমীচীন।
রাজীব কুমার সাহা, আভিধানিক ও প্রাবন্ধিক