অন্তর্বর্তী সরকারের পক্ষ থেকে বারবার একই কথা বলা হচ্ছে যে ভ্যাট বাড়লে জিনিসপত্রের দামের ওপর তার প্রভাব পড়বে না। কিন্তু বাস্তবতা হচ্ছে, ইতিমধ্যে খাদ্যদ্রব্যের দাম তো বেড়েছেই, সেই সঙ্গে ওষুধের মূল্যও বৃদ্ধি পেয়েছে। এই সহজ সত্যটুকু সরকারের উচ্চপর্যায়ের ব্যক্তিরা বুঝতে পারছেন না। খাদ্য উপদেষ্টা বলেছেন সরকারের রাজস্ব ঘাটতি মেটাতে এই ব্যবস্থা নেওয়া হয়েছে।
পূর্বের সরকারগুলো, বিশেষত গত ১৬ বছর ক্ষমতায় থাকা সরকার প্রশাসনকে খুবই ব্যয়বহুল করে গিয়েছে। যার মধ্যে কিছু অপ্রয়োজনীয় ব্যয় যুক্ত হয়েছে। উপসচিব থেকে সচিব পর্যন্ত কর্মকর্তাদের স্বল্প সুদে গাড়ি দেওয়া এবং সেই সঙ্গে মাসে ৫০ হাজার টাকা করে ড্রাইভার ও গাড়ির তেলের খরচ দেওয়া হয়েছে। আবার বছর বছর এ সুদের হার কমেও যায়। বিভিন্ন মন্ত্রণালয়ের সভা অনুষ্ঠানের খরচও ছিল বিলাসবহুল। অনেক জায়গায় নতুন করে সার্কিট হাউস করা হয়েছে। দেশের সাধারণ মানুষের অর্থনীতির দিকে না তাকিয়ে একটি বিলাসবহুল প্রশাসন জনগণের কাঁধে চাপিয়ে দেওয়া হয়েছে। বেতন দ্বিগুণ করে দেওয়ার পর দুর্নীতি তো কমেইনি বরং দ্বিগুণ-তিন গুণ বেড়ে গেছে। যার প্রমাণ প্রতিদিন সংবাদপত্রে দেখা যাচ্ছে।
এরপরেও মহার্ঘ ভাতার জন্য এবং বিভিন্ন দাবিদাওয়ায় বর্তমান অন্তর্বর্তী সরকার প্রচণ্ড চাপের মধ্যে রয়েছে। এর মধ্যে শুরু হয়েছে প্রশাসন ও অন্য ক্যাডারদের দ্বন্দ্ব। সবচেয়ে দুঃখজনক—শিক্ষকদের নিয়োগ-বাণিজ্য, স্কুল-কলেজের উন্নয়নের জন্য যে অর্থ দেওয়া হয়েছে, তার মধ্যে ব্যাপক দুর্নীতি বিরাজমান। স্কুলের চতুর্থ শ্রেণির ছাত্রছাত্রীরাও স্কুল কমিটির দুর্নীতি সম্পর্কে ওয়াকিবহাল। দ্রব্যমূল্যের এই অস্বাভাবিক ঊর্ধ্বগতি সামাল দেওয়া হয়তো দুর্নীতিপরায়ণ কর্মকর্তা-কর্মচারীদের পক্ষে সম্ভব। কিন্তু যারা সাধারণ মানুষ তাদের নাভিশ্বাস উঠে যাচ্ছে।
বহুদিন ধরেই জাতীয় রাজস্ব বোর্ড তার খেয়ালখুশিতে চলছে। দেশের মানুষের জীবনযাপনের খবর তারা রাখে না এবং রাখার প্রয়োজনও বোধ করে না। গত সরকার উচ্চপর্যায়ের কর্মকর্তাদের জন্য একটা ব্যবস্থা করে গেছে, সেই ব্যবস্থায় তাঁদের কোনো অসুবিধা হয় না। আর তখন দুর্নীতির পথ ছিল অবারিত। এখনো সেই দুর্নীতি কতটা কমেছে, তা প্রশ্নসাপেক্ষ। এই মূল্যস্ফীতির অর্থনীতিতে হাবুডুবু খাওয়া মানুষ এখন রাজস্বের ঘাটতি মেটাবে। এ এক অদ্ভুত চিন্তা!
সাধারণত আমরা দেখেছি তত্ত্বাবধায়ক সরকারের সময় দ্রব্যমূল্য, আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতি একটা স্বাভাবিক জায়গায় চলে আসে। কিন্তু এবারে দেখা যাচ্ছে এসবের ওপর অন্তর্বর্তী সরকার কোনো নিয়ন্ত্রণ প্রতিষ্ঠা করতে পারছে না। এর মধ্যে একটাই বড় আওয়াজ, তা হলো নির্বাচন। এতসব ভ্যাট-ট্যাক্সের বোঝা কাঁধে নিয়ে নির্বাচিত সরকারইবা কতটা স্বাভাবিক জীবনযাপনের নিশ্চয়তা দেবে, তা-ও ভাববার বিষয়। আমাদের দেশের রাজনীতিবিদেরা নির্বাচনে যতটা উৎসাহী, জনগণের জীবনযাপন নিয়ে তাঁদের তেমন সুনির্দিষ্ট কর্মসূচি নেই। এদিকে সঞ্চয়পত্রের সুদ বাড়িয়েও রাজস্ব ঘাটতির একটা সমাধান খোঁজার চেষ্টা করা হচ্ছে। আবার যেসব মানুষ সঞ্চয়পত্রের সুদ দিয়েই সংসার চালায়, তাদের ওপরও বড় ধরনের কর আরোপ করা হয়েছে।
এর আগেও বহুবার বলেছি, সরকারের মধ্যে অর্থনীতিবিদ নেই, আমলারাই অর্থনীতিবিদদের কাজটি করে থাকেন। একদা বড় বড় অর্থনীতিবিদ রাষ্ট্রের পরিকল্পনা কমিশন এবং অর্থনীতি বিভাগের দায়িত্ব পালন করতেন। সদ্য প্রয়াত অর্থনীতিবিদ আনিসুর রহমান, অধ্যাপক নুরুল ইসলাম পরিকল্পনা কমিশনে গুরুত্বপূর্ণ দায়িত্ব পালন করেছেন। কিন্তু আমলারা ক্রমাগতভাবে সেই পদগুলো দখল করেছেন এবং প্রায়ই ভুল সিদ্ধান্ত দিয়ে সরকারকে বিব্রতকর অবস্থায় ফেলেছেন। দেশে অর্থনীতিবিদের অভাব নেই। অনেক ভাবনাচিন্তাসম্পন্ন অর্থনীতিবিদ নানা সময় নানা ধরনের প্রয়োজনীয় অভিমত দিয়ে থাকেন। সেসব অভিমতকে সরকারের কোনো পর্যায়েই গুরুত্ব দেওয়া হয় বলে মনে হয় না। ফলে সরকার নিজের সুবিধামতো সবকিছু চালায়, যার মধ্যে ব্যাংক খাতেও ব্যাপক দুর্নীতির প্রমাণ পাওয়া যাচ্ছে।
বাংলাদেশ ব্যাংককে আইনগতভাবে অনেক ক্ষমতা দেওয়া আছে। কিন্তু সেই ক্ষমতার কতটা প্রয়োগ এবং কতটা অপপ্রয়োগ হয়, তা আজকে দিনের আলোর মতো পরিষ্কার। পৃথিবীর সব দেশেই নাগরিকেরা অত্যন্ত আইনানুগভাবে রাষ্ট্রীয় কর দিয়ে থাকে। কর না দিলে নানা রকম শাস্তির ব্যবস্থা আছে। একেবারে বড় বড় উদ্যোক্তা, মালিক, রাজনীতিবিদ কারও পক্ষে কর ফাঁকি দিয়ে স্বাভাবিক জীবনযাপন করা সম্ভব নয়। কিন্তু আমাদের দেশে কেউ সঠিকভাবে কর দিতে গেলেও তার সমস্যা বিস্তর। এসব সমস্যার কোনো সমাধান বা সহজীকরণ ব্যবস্থার জন্য কর কর্মকর্তা বা রাজস্ব বোর্ড তেমন কোনো পদক্ষেপ গ্রহণ করেন না। বরং সহজভাবে কী করে বেশি রাজস্ব পাওয়া যায়, তার পথ খুঁজেছেন। যেমন, বিদেশ থেকে গাড়ি এনে বিক্রি করলে সরকার ভালো রাজস্ব পায়। যত বেশি সিসিসম্পন্ন গাড়ি আনা যায় তত বেশি রাজস্ব। তাই খুলে দেওয়া হলো গাড়ি আমদানির দুয়ার। প্রতিদিন হাজার হাজার গাড়ি বিক্রি হচ্ছে। গাড়িগুলো রাস্তায় নামছে, দুঃসহ যানজটের সৃষ্টি হচ্ছে। এইভাবে গাড়ি রাস্তায় ছেড়ে দিলে তার জন্য প্রয়োজনীয় রাজপথ আছে কি না, তা কি বিবেচনা করার প্রয়োজন পড়ে না? না, পড়ে না। কারণ এলসি খোলা, বন্দরে গাড়ি আসা, গাড়ি ছাড় করা, তার ওপর ট্যাক্সের হিসাবনিকাশ এবং বিআরটিএতে রুট পারমিট থেকে শুরু করে সব ব্যবস্থার মধ্যেই টাকার ছড়াছড়ি। যেখানেই টাকার বিপুল প্রবাহ তার একটা অংশ জুড়ে থাকে দুর্নীতি। এর মধ্যে জনপ্রতিনিধিদের জন্য বিনা শুল্কে গাড়ি দেওয়ার ব্যবস্থা আছে। এমনিতেই তারা সব সময় দুর্নীতিতে অভিযুক্ত হন, তারপরেও খুব আইনানুগভাবে দুর্নীতি করার একটা সুযোগ করে দেওয়া হয়। যাই হোক, আদার ব্যাপারীর জাহাজের খবর নেওয়ার দরকার কী!
মাঝে মাঝে দেখা যায় পেঁয়াজ, কাঁচা মরিচের দাম অসহনীয় হয়ে উঠেছে। হিড়িক পড়ে যায় বিদেশ থেকে আমদানির। তবু স্বস্তি মেলে না, পেঁয়াজের ঝাঁজ ও কাঁচা মরিচের ঝাল বাড়তেই থাকে। মানুষ এই জায়গাটায় স্বস্তি চায়। সে দুধেভাতে উৎপাত চায় না, নির্বিঘ্নে ডাল-ভাত খেয়ে জীবনযাপন করতে চায়। দুর্বিষহ ভ্রমণ চায় না, বাসে একটা সিট পেলেই সে সন্তুষ্ট। সুপেয় পানি চায়, দূষণমুক্ত বাতাস চায়, গুন্ডা-মাস্তান-দুষ্কৃতকারীদের চলাচল দেখতে চায় না এবং অসুখেবিসুখে সরকারি হাসপাতালের আশ্রয় চায়, ওষুধের দাম তার নিয়ন্ত্রণের মধ্যেই চায়। ক্লিনিক বা প্রাইভেট হাসপাতালের ভয়াবহ অর্থের আগ্রাসনের হাত থেকে মুক্তি চায়। এ সবই রাজনৈতিক বিষয়। যদিও এইটুকু দিতে গেলেই রাজনীতিবিদ, সরকারি কর্মকর্তা, আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীতে নিয়োজিত কর্মীরা বাজার ব্যবস্থাপনার সদস্যদের স্থানীয় সরকারের সদস্যদের রাত-দিন পরিশ্রম দরকার। এই পরিশ্রমের জন্য তাঁকে লাখ লাখ টাকা দিতে হবে না, প্রাডো গাড়ি দিতে হবে না। যা লাগবে তা হচ্ছে দেশপ্রেম এবং মানুষের প্রতি কর্তব্যে অঙ্গীকার।
এই অঙ্গীকারের ঘাটতি দেখছি বহু বছর ধরে। প্রাচীন সরকারি কর্মচারী, রাজনীতিবিদ, তাঁদের মধ্যে কয়েকজনকে ছোটবেলা থেকেই দেখে এসেছিলাম কিন্তু টাকার ঝড়ে তারা আজ কোথায় হারিয়ে গেল? মনে রাখা দরকার, এই টাকার ঝড় অনেক অসুখ বয়ে এনেছে। অসুখটা শুধু শারীরিক নয়, মানসিকও। প্রথমটির হয়তো নিরাময় আছে, কিন্তু দ্বিতীয়টির আরোগ্য সম্ভব নয়। সেই দিক বিবেচনা করে স্কুল-কলেজের পাঠ্যপুস্তক থেকে শুরু করে আজকের দিনের শক্তিশালী গণমাধ্যমগুলোর মধ্যে প্রবল সচেতনতা প্রয়োজন। এসব কোনো কথাই নতুন নয়। কিন্তু কোনো কাজ হচ্ছে না। মানুষের ধর্ম বিশ্বাস কি শুধু পোশাকের অবয়বে? বাংলাদেশে যে পরিমাণে মসজিদ, মন্দির এবং চার্চ রয়েছে, যে পরিমাণে লোক ধর্ম বিশ্বাসী, সেখানে অনৈতিক কিছু হওয়ার আশঙ্কা থাকার কথা নয়। কিন্তু দুঃখের বিষয়, কণ্ঠে যদি ধর্মের বাণী থাকে এর সঙ্গে হৃদয়ে আনুগত্য আছে কি না, সেটাই প্রশ্ন হয়ে দাঁড়িয়েছে।
যাই হোক, খাদ্য উপদেষ্টার একটি ঘোষণা দেখলাম—আগামী দুই মাস ৫০ লাখ মানুষ ১৫ টাকা কেজিতে চাল পাবে। বহুদিন ধরেই বাংলাদেশ থেকে রেশন কার্ড উঠে গিয়েছিল। খোলাবাজারের ওপর নির্ভরশীল হয়ে পড়েছিল মানুষ। এই ৫০ লাখ মানুষকে লাইনে দাঁড় করিয়ে ১৫ টাকা কেজিতে চাল দিলে বাকি ১৭ কোটি মানুষের কী হবে? বিষয়টা ভাববার অবকাশ আছে।
মামুনুর রশীদ, নাট্যব্যক্তিত্ব