প্রশান্ত মৃধা, কথাসাহিত্যিক
যদি বিষয়টা পরপর দুভাবে সাজানো হয়, তাহলে প্রথমবারের সমস্ত দৃশ্য দ্বিতীয়বার উল্টে যাবে। তাতে ভুল ঘটার আশঙ্কা তৈরি হয় কিছু। কিন্তু কখনো জীবনে এমন ভুল ঘটে থাকে, যা কথাসাহিত্যের কল্পনার জগৎকেও হার মানায়। ধরা যাক, দ্বিতীয় ঘটনাটি ঘটেছে অথবা ঘটেনি।
১. ইউনুস আলী একেবারে বিধ্বস্ত ক্লান্ত হয়ে টিলাগড় পর্যন্ত পৌঁছেছে। আসছে জাফলং থেকে, যাবে সুনামগঞ্জের জামালগঞ্জে। সেখানে তার বাড়ি। এক ঠিকাদার তাকে আরও কয়েকজনের সঙ্গে জামালগঞ্জ থেকে ট্রাকে তুলে নিয়ে এসেছিল জাফলংয়ে পাথর তোলার কাজের সহায়ক হিসেবে। গত সপ্তাহে এসেছিল সে। আজ সকালে শুনেছে সেই ঠিকাদার পাথরভাঙার মালিকের কাছ থেকে টাকা নিয়ে চলে গেছে। তাদের পাওনার দেয়নি কিছুই। তার সঙ্গে আরও যারা এসেছিল, তাদের প্রায় সবাই অন্য ঠিকাদারের কাছে ভিড়ে গেছে। বাকিরা কেউ কেউ গরুর ট্রাকে করে ফিরে এসেছে। ইউনুস আলী গরুর ট্রাকেও আসতে পারেনি।
তাই সে জাফলং-তামাবিল থেকে একেবারে ভোর-ভোর হাঁটতে শুরু করে এই প্রায় সন্ধ্যায় সিলেট শহরের টিলাগড়ে এসে উপস্থিত হয়েছে।
সে এখনো জানে না সুনামগঞ্জ আর কতটা রাস্তা।
কেমন মানুষ সেই ঠিকাদার। এভাবেও মানুষকে ঠকানো যায়। যায় তো। দুনিয়াব্যাপী ঠকানোর যত কায়দা, তার ভেতরে পাঁচ দিনের মজুরি মেরে দেওয়ার এই অভিনব কৌশলটি বরং কম নম্বরই পাবে। এর চেয়ে দগদগে আর মসৃণ কৌশল আছে ঠকানোর। তা প্রতিদিনই ভীষণ নিপুণ কায়দায় প্রযুক্ত হচ্ছে। ইউনুস আলী জানে না এখান থেকে কোন পথে সুনামগঞ্জ যাওয়া যাবে। এমন মানুষ এখনো আছে, এই জমানায়!
এই যে প্রায় ন্যুব্জ হয়ে হেলেপড়া বছর পঁচিশেকের তরুণটি তার জলজ্যান্ত উদাহরণ। সঙ্গী বলল, ‘আর কত পথ হাঁটবা, ভাই। ওই যে টিলাগড় পয়েন্ট, ওই জায়গা থেকে কুমারগাঁওয়ের দিকের সিএনজি যায়, ওর একটায় উঠে পড়ো। কুমারগাঁও গিয়ে বাসে সুনামগঞ্জ চলে যেতে পারবা।’ ইউনুস আলী বলে, ‘আমরার কাছে পয়সা নাই।’
শোনামাত্র সঙ্গী তাকে টাকা দিল। সে টাকায় যাতায়াত ও রাতের খাওয়ার খরচের পরও কিছু থাকবে। ইউনুস টিলাগড় পয়েন্টের দিকে হাঁটতে শুরু করল।
লোকটির বাঁ পায়ে একটু খুঁত আছে। সেদিকে একটু হেলে হাঁটে।
২. বিয়ানীবাজারের কলেজ রোড ধরে একটু পশ্চিম মুখে হেঁটে একটা দোকানের সামনে দাঁড়িয়েছি। পানির বোতল কেনা যাক। একটা রিকশা পাওয়া যায় তো এই বিকেলে হেলে যাওয়া রোদে আর হাঁটতে হয় না। এ সময় রাস্তার উল্টো দিক থেকে একটা লোক এসে সামনে দাঁড়াল। লোকটির কপাল বেয়ে নামা ঘাম মুখটাও সয়লাব করে ফেলেছে। ভীষণ অস্বস্তিকর এই গরমে তার এমন দশা দেখে মনে হলো অনেকটা পথ হেঁটে এসেছে।
জানতে চাইল, সিলেট কোন দিক দিয়া যাইতাম? সিলেট? হুঁ, এই পশ্চিমমুখী রাস্তায় হাঁটলে যাওয়া যাবে। কিন্তু সে তো বহুদূর। এখান থেকে অন্তত ৪০ কিলোমিটার। হাত তুলে দেখলাম। তারপরই মনে হলো, এ তো হেঁটে যাওয়ার পথ নয়। একটু পেছনে সেদিকের সিএনজি পাওয়া যায় অথবা বাঁয়ের রাস্তায় ঢুকে যাওয়া যায়। স্ট্যান্ডের লোকটি গভীর চোখে আমার মুখের দিকে তাকাল। বলল, পয়সা নেই। হেঁটেই যাবে সে। আর কোনো কথা না বলে হাঁটা শুরু করল।
তখন লক্ষ করলাম, এ-ও বাঁ দিকে একটু হেলে হাঁটে। তাহলে সে ইউনুস আলী। আমাকে চিনতে পেরে আর দাঁড়াল না। আমার তখনই মনে না হলেও পরে মনে হয়েছে, ওই-ই ইউনুস আলী, এমন করেই হাঁটে আর কাউকে বলার মতো মনে হলে মুখে একটা হাবাগোবা ভাব ধরে দূরের পথ জানতে চায়। হেঁটেই যাবে এমন ভঙ্গি করে। এটা তার সাহায্য প্রার্থনার একটা কৌশল!