Ajker Patrika

ইলিশ ও বিদ্যুতের কাহিনি

মামুনুর রশীদ, নাট্যব্যক্তিত্ব
ইলিশ ও বিদ্যুতের কাহিনি

১৯৬০ সালের কথা। বাজার থেকে একটি ইলিশ মাছ কিনে মধ্যবিত্ত চাকুরে বাড়ি ফিরেছেন। বাড়িতে খাওয়ার লোক ৮-১০ জন। মাছটির দাম পড়েছে ৬ আনা থেকে ৮ আনা। ভদ্রলোক বেতন পান ১৫০ থেকে ২০০ টাকা। যে সাইজের ইলিশ তাতে দুই বেলার খাওয়া চলবে।
২০২৪ সালের ইলিশের বাজার। ৫০০ থেকে ৬০০ গ্রাম ইলিশের কেজি ১ হাজার ৬০০ টাকা। এক কেজি ইলিশের দাম ২ হাজার ৬০০ টাকা। সবকিছুরই দাম বেড়েছে, সন্দেহ নেই। তখনকার ১০০ টাকা ভরি সোনার দাম এখন লাখ টাকার ওপরে। কিন্তু ইলিশের দাম এত বাড়ল কেন?

পুরো ষাটের দশক থেকে আশির দশক পর্যন্ত ইলিশের দাম একটু বেড়েছিল বোধ হয়—যতটা মনে পড়ে, ২ টাকা থেকে ৫ টাকা পর্যন্ত। কিন্তু এখনকার মতো এতটা বোধ হয় ওই শতাব্দীতেও বাড়েনি। গত বছর থেকে লাফ দিয়ে যেন সবকিছুর দাম বাড়তে শুরু করেছে। তেমনি লাফালাফি শুরু করেছে ইলিশের দামও। মধ্যবিত্ত, নিম্নমধ্যবিত্তরা অনেক কিছু থেকেই বঞ্চিত এবং শেষ পর্যন্ত প্রকৃতির দান ইলিশের স্বাদ থেকেও চিরতরে বিদায় নিল।

আজকাল বিপুল পরিমাণে মাছের চাষ হচ্ছে। যেখানে টাকাপয়সার লগ্নিও কম নয়। পুকুর খনন, মাছের খাবার দেওয়া, লোকজন রাখা—সব জায়গায় খরচ। সেসব খরচ করেও যদি দামটা সহনীয় রাখা হয়, তাহলে একেবারেই লগ্নিবিহীন একটি প্রাকৃতিক উৎপাদনের জন্য এত টাকা দাম হবে কেন? মুদ্রাস্ফীতি, ডলারের দাম, জ্বালানির খরচ—এসব তো নেই। হ্যাঁ, ট্রলারের ভাড়া, তেল আর মাঝিদের খরচ আছে। যাঁরা মাছ ধরেন, তাঁরা কি এত টাকা পান? প্রবাসে যে ইলিশ পাওয়া যায় তার দাম কিন্তু এখানকার চেয়ে কম। তাদের আয়ের সঙ্গে সংগতিহীন নয়। ইলিশের অবশ্য রপ্তানি বেড়েছে। তাই দেশের বাজারে নিম্নমানের ইলিশ ছেড়ে দিয়ে এবং ভালো মানের ইলিশ রপ্তানি করে বৈদেশিক মুদ্রা অর্জন করাই মুখ্য বিষয় হয়ে দাঁড়িয়েছে।

শাক-সবজির বাজারেও লাফিয়ে লাফিয়ে দাম বাড়ে। যিনি উৎপাদক, তিনি কি ন্যায্যমূল্য পান? করোনার সময় ঢাকায় লেবুর দাম ন্যূনতম হালি ৪০ টাকা হয়ে গেল। কিন্তু আমার জানামতে, কৃষকের ভাগ্যে তখন হালি ৩ থেকে ৪ টাকা। অবশ্যই ইলিশের ক্ষেত্রে মধ্যস্বত্বভোগীর দল আছে। লোভী এই চক্র এতই সক্রিয় যে তারা এক রাতেই বড়লোক হতে চায় এবং বড়লোক হয়েও যাচ্ছে। কিন্তু যাঁরা মৎস্যজীবী, তাঁদের ভাগ্যের কোনো পরিবর্তন হচ্ছে না। যখন মাছ ধরতে পারছেন না সরকারি বিধিনিষেধের কারণে, তখন তাঁদের না খেয়ে থাকতে হয়। সম্প্রতি সরকারি সাহায্যের কারণে উপোস থাকতে হচ্ছে না কারও কারও। সে সাহায্যও কখনো কখনো প্রশ্নবিদ্ধ হতে দেখা যায়।

১৪ মের খবরের কাগজে দেখলাম, প্রধানমন্ত্রী দ্রব্যমূল্য সহনীয় রাখার জন্য নির্দেশ দিয়েছেন। কিন্তু কে শুনবে সে কথা? ডলারের দাম বাড়ে, জ্বালানির দাম বাড়ে—এসব অজুহাতে ব্যবসায়ীরা মুখে ফেনা তুলে ফেলেন এবং মানুষকে দিন দিন অসহায় ও নিরুপায় অবস্থায় ফেলে দিচ্ছেন। এখন থেকেই বলা হচ্ছে, এবার আমের সরবরাহে সংকট দেখা দেবে। এর সোজাসাপ্টা অর্থ হচ্ছে, আমের দাম এমন বাড়বে যে সাধারণ মানুষ আমের স্বাদ থেকেও বঞ্চিত হবে।

আজকের দিনের শিশু-কিশোরেরা এমনিতেই শাক-সবজি-মাছ খেতে চায় না। ফলে তাদের শারীরিক বিকাশটাও ঠিকমতো হচ্ছে না। শুধু ব্রয়লার মুরগি খেয়ে একটা মেধাহীন প্রজন্মকে আমরা ভবিষ্যতে দেখতে পাব। যা হোক, বোঝা যায়, ব্যবসায়ীদের নিয়ন্ত্রণ করা সরকারের পক্ষে সম্ভব নয়। আমাদের জনগণ আবার সবকিছুতেই সরকারের মুখের দিকে তাকিয়ে থাকে। সরকার যেমন ইলিশ ধরা একটি নির্দিষ্ট সময় পর্যন্ত বন্ধ করতে পারে, তেমনি ইলিশের মূল্যও ইচ্ছা করলে নিয়ন্ত্রণ করতে পারে। যদিও গরুর মাংসের দাম একবার কমে গেলেও তারপর কিছুদিন পর ঠিকই আগের জায়গায় চলে এল।

দেশে অনেক জায়গাতেই গণপ্রতিনিধি আছেন। রাজনৈতিক দলেরও অনেক শাখা-প্রশাখা। সেসব মানুষ কী করেন? তাঁরাও দেখা যায় বছরে বছরে আয় বাড়িয়ে চলেন—দুই গুণ, তিন গুণ নয়, শত গুণ বেশি। লুণ্ঠনের স্বর্গ আমাদের এ দেশ। এই লুণ্ঠনের অর্থ আবার এ দেশে থাকে না। পাচার হয়ে যায়, ভালো ইলিশ যেমন বিদেশে রপ্তানি হয়ে যায়! ইলিশের স্বাদ মনে হয় একটা সুদূর অতীতের স্মৃতি হয়ে থাকবে। শুধু আমলা, ঠিকাদার, প্রকৌশলী, কমিশন আদায়কারীদের পারস্পরিক অবৈধ বিনিময়ের মাধ্যম হিসেবে ইলিশ জাগরূক হয়ে থাকবে।

এতক্ষণ এক প্রাকৃতিক বিষয়ের ওপর কথা বললাম। এবার বলব খাদ্যের মতোই নিত্যপ্রয়োজনীয় আরেকটি বিষয় বিদ্যুৎ নিয়ে। বিদ্যুৎ এখনো রাষ্ট্রায়ত্ত। যদিও কিছু অংশ ব্যবসায়ীদের কাছ থেকে কিনে নিয়ে সরকারি সংস্থার মাধ্যমে জনগণের কাছে বিতরণ করা হয়। বহু বছর ধরেই বিদ্যুতের বিল নিয়ে নানা আলোচনার পর সরকার কিছু জায়গায় স্বয়ংক্রিয় ব্যবস্থা করেছে—কখনো কার্ডের মাধ্যমে, কখনো সেলফোনে মেসেজ পাঠিয়ে। অতিরিক্ত বিলের অত্যাচারে জর্জরিত ভোক্তারা একদিন দেখলেন, একটি স্বয়ংক্রিয় ব্যবস্থা এসেছে। কিসের কি! সেখানেও ইলিশের দামের মতোই লাফিয়ে লাফিয়ে বিল আসছে। এক্ষুনি বিল দিন, না হলে বিরতিহীন বিদ্যুৎ বন্ধ হয়ে যাবে—দুপুরে মেসেজ এল, এবার রাতেও। এই সময়ের মধ্যে বিল এসে সেলফোনকে গরম করে দিল।

বিদ্যুৎ অফিসের লোকজনও কোনো জবাব দিতে পারে না। কোনো জবাবদিহি নেই। একেবারেই একমুখী ব্যবস্থা। কোনো উত্তর নেই, কোনো সমাধান নেই। লোডশেডিংয়ের অধিকারও অটুট। কিন্তু বিলের ব্যাপারে কোনো কথা নেই। স্বয়ংক্রিয় ব্যবস্থার মধ্যেও ভূত ঢুকে আছে। আগে তো একটা বিল আসত। সেখানে দিনক্ষণের কথা, মিটার রিডিংয়ের বিষয় লেখা থাকত। এখান মিটার রিডিং এবং টাকার কথা জানানো হয়। বিদ্যুৎ বিভাগ থেকে একটা কথা আমাদের বরাবর জানানো হতো—লাইনে নাকি একটা বিপুল পরিমাণ লস হয়।

ভোক্তাদের কাছ থেকে অতিরিক্ত অর্থ আদায় করেই কি লাইন লস পোষানোর একটা ব্যবস্থা হয়েছে? হতেও পারে। একেবারেই অবাক হব না।

পানি, বিদ্যুৎ—এসবই নাগরিক জীবনের হৃৎস্পন্দন। সেসবেই যদি বিঘ্ন ঘটে যায়, তাহলে মানুষ বাঁচবে কী করে? আবার এসব জায়গায় যাঁরা কাজ করেন, তাঁরা নাকি আঙুল ফুলে কলাগাছ হয়ে যান। তাঁদের থামাতে দুদকের কাজ বাড়ে, কিন্তু কোনো কাজ হয় না। দুর্নীতি তার আপন শক্তিতে বেড়ে চলে। তাহলে এটাই কি আমাদের ভবিতব্য? যাদের আয় বছর বছর বাড়ে না, পরিমাণও স্বল্প, তাদের সংখ্যাই তো এ দেশে বেশি। তারা তাহলে খেতে পারবে না, পানি-বিদ্যুতের বিলের অত্যাচারে জর্জরিত হবে, শিক্ষা-স্বাস্থ্যের, পরিবহনের ভাড়ার ঊর্ধ্বগতিতে নিজেকে সমর্পণ করে অস্থিচর্মসার শরীরটাকে নিয়ে একসময় বিদায় নেবে? এ দেশের পক্ষীকুল বিদায় নিচ্ছে, প্রাণিকুল অনাহারে। তাদের সঙ্গে কি সবচেয়ে বুদ্ধিদীপ্ত প্রাণীটিও সেই হাহাকারে পড়ে যাবে?

Google News Icon

সর্বশেষ খবর পেতে Google News ফিড ফলো করুন

এলাকার খবর
খুঁজুন

পাঠকের আগ্রহ

সম্পর্কিত