রেলওয়ের চতুর্থ শ্রেণির কর্মচারী ক্যারেজ অ্যাটেনডেন্ট ছিলেন শামছুল আলম। ৯ হাজার টাকা বেতন গ্রেডে চাকরি করতেন তিনি। তবে এই চাকরি থেকে আঙুল ফুলে যেন কলাগাছ হয়েছে। কিনেছেন ৩ কোটি টাকায় তিনটি ফ্ল্যাট, ১ কোটি টাকার দুটি দোকান, ৮০ লাখ টাকার প্লট।
রেলওয়ে শ্রমিক লীগের মার্শালিং ইয়ার্ড শাখার সভাপতি ছিলেন শামছুল আলম। আওয়ামী লীগের প্রভাব খাটিয়ে দায়িত্ব পালন না করেই বেতন তোলার অভিযোগ ছিল তাঁর বিরুদ্ধে। চাকরি থেকে এখন অবসরে আছেন। তবে রাজনৈতিক পটপরিবর্তনে ভোল পাল্টেছেন তিনি। এখন যোগ দিয়েছেন জামায়াতে ইসলামীর রাজনীতিতে।
খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, চট্টগ্রামের সদরঘাট থানার বিপিডিআর আরআর টাওয়ার ১৬৭ মাঝির ঘাট রোডে ১৮০০ স্কয়ার ফুটের একটি বিলাসবহুল ফ্ল্যাট কেনেন শামছুল আলম। ২০১১ সালে ৮০ লাখ টাকায় ওই ফ্ল্যাটটি চট্টগ্রাম ক্যারেজ ডিপোর সাবেক হেড টিএক্সার মো. জামিলের কাছ থেকে কেনেন তিনি। পাহাড়তলী বার কোয়ার্টার এলাকায় চট্টগ্রাম পিবিআই অফিসসংলগ্ন ইউনাইটেড সোসাইটির ১৪ তলা ভবনের ১২/এ (১৯০০ স্কয়ার ফিটের) ফ্ল্যাটটিও শামছুল আলম কিনেছেন। পাঁচ বছর আগে ৯০ লাখ টাকায় কেনেন এ ফ্ল্যাট। এই ভবনে থাকা রেলওয়ের এক কর্মকর্তা আজকের পত্রিকাকে বিষয়টি নিশ্চিত করেছেন। এ ছাড়া ভবনের দারোয়ানও এ তথ্য নিশ্চিত করেছেন। এ ছাড়া চট্টগ্রামে বসুধা রেলওয়ে মেন্স সিটি সেন্টারের ‘মায়েদা ডেটস’ নামে দোকানটিও ১ কোটি টাকায় কিনে নেন তিনি। ওই সেন্টারে আরও একটি দোকান রয়েছে তাঁর। রয়েছে খুলশী ১ নম্বর এলাকায় একটি ফ্ল্যাট ও প্লট।
অভিযোগের বিষয়ে জানতে শামছুল আলমের চট্টগ্রাম পিবিআই অফিসসংলগ্ন ইউনাইটেড টাওয়ারে তাঁর বাসায় যাওয়া হয়। সাংবাদিক পরিচয় শুনে তিনি আর দেখা করেননি। পরে, তাঁর মোবাইলফোনে দুই দিন কল ও ক্ষুদেবার্তা পাঠিয়েও সাড়া পাওয়া যায়নি।
শামছুল আলম ১৯৮৪ সালে ক্যারেজ অ্যাটেনডেন্ট হিসেবে যোগ দেন। ২০২২ সালে অবসরে গেলেও ৫ আগস্টের আগপর্যন্ত আওয়ামী লীগের নেতা ছিলেন। রেলওয়ে শ্রমিক লীগের মার্শালিং ইয়ার্ড শাখার সভাপতিও ছিলেন তিনি। নগর আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক আ জ ম নাছির উদ্দিনের রাজনীতি করতেন। বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনরত শিক্ষার্থীদের ওপর হামলার ঘটনায় সরাসরি জড়িত ছিলেন তিনি। ৫ আগস্টের আগে ৪ আগস্ট চট্টগ্রামের নিউমার্কেটে আওয়ামী লীগ ও শিক্ষার্থীদের মধ্যে সংঘর্ষে অংশ নেন শামছুল আলম। সরকার পতনের পর এখন রেলওয়ে এমপ্লোয়িজ নামে জামায়াতে ইসলামীর ব্যানারে বিভিন্ন অনুষ্ঠানে যাচ্ছেন তিনি। এ-সংক্রান্ত ছবিও সংগ্রহ করেছে আজকের পত্রিকা।
চাকরিরত অবস্থায় চট্টগ্রাম ক্যারেজ ডিপোর প্রধান রেল যান পরীক্ষক মো. আকরাম হোসেনের সই জাল করার অভিযোগও রয়েছে শামছুল আলমের বিরুদ্ধে। ওই ঘটনায় একটি তদন্ত কমিটিও গঠন করা হয়েছে। এ প্রসঙ্গে রেলওয়ের ডিএমই ক্যারেজ সজিব আল হাসান বলেন, এ-সংক্রান্ত কমিটি গঠন করা হয়েছে। খুব শিগগির কমিটি প্রতিবেদন দেবে।
যেভাবে প্রভাব বিস্তার
রেলওয়ের চট্টগ্রাম ক্যারেজ সূত্র জানায়, শামছুল আলম ২০০৮ সাল থেকে আওয়ামী লীগের রাজনীতির সঙ্গে যুক্ত হন। এর পর থেকে আওয়ামী লীগের প্রভাব খাটিয়ে ট্রেনে অ্যাটেনডেন্ট হিসেবে দায়িত্ব পালন করতেন না। চট্টগ্রাম মার্শালিং ইয়ার্ড শাখা আওয়ামী লীগের সভাপতি হওয়ায় অ্যাটেনডেন্টের চাকরি না করে বছরের পর বছর অবৈধ ভাউচারের মাধ্যমে প্রতি মাসে নিয়েছেন টিএ।
আওয়ামী লীগের দলীয় ক্ষমতাকে ব্যবহার করে শামছুল আলম চট্টগ্রাম স্টেশনে করেছেন টিকিট কালোবাজারি, যান্ত্রিক বিভাগের বাসা বরাদ্দ নিতে হলে তাঁর সঙ্গে করতে হতো মোটা অঙ্কের চুক্তি। টিএলআর নিয়োগের দালালি হিসেবে তাঁকে দিতে হতো কমিশন। এ সুবিধা নিয়েছেন—এমন বেশ কয়েকজন আজকের পত্রিকার কাছে তা স্বীকার করেছেন।
রেলের মহাব্যবস্থাপক মো. নাজমুল ইসলাম বলেন, ‘রেলের কোনো সাবেক কর্মচারী অপরাধ বা দুর্নীতি করলে দেশের দুর্নীতিবিরোধী সংস্থা ব্যবস্থা নেবে। তাঁর মাধ্যমে কেউ অপরাধ করছে কি না, সেটি আমরা খুঁজে বের করে ব্যবস্থা নেব।’