ব্রাহ্মণবাড়িয়ার তিতাস নদে নৌকাডুবিতে ২৩ জনের মৃত্যুর ঘটনায় নড়েচড়ে বসেছে স্থানীয় বাসিন্দারা। ঘাটকেন্দ্রিক কোটি টাকার বাণিজ্য আর ফিটনেসবিহীন নৌ চলাচলকে দায়ী করছেন তাঁরা। স্থানীয় বাসিন্দাদের অভিযোগ, বিশেষ এক চক্রের লোভের বলি হচ্ছে ব্রাহ্মণবাড়িয়ার বিভিন্ন নৌ রুটে চলাচলকারী হাজারো যাত্রী।
খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, বর্ষা মৌসুমে প্রায় ছয় মাস (মে থেকে অক্টোবর) ব্রাহ্মণবাড়িয়ার আশপাশে অন্তত ২০টি নৌঘাটে দুই শতাধিক ট্রলার ও ইঞ্জিনচালিত নৌকা চলে। এসব নৌকার কোনোটির লাইসেন্স বা নিবন্ধন নেই। এতে প্রতিদিন হাজারো যাত্রী জীবনের ঝুঁকি নিয়ে যাতায়াত করে। বছরের পর বছর ধরে পরিচালিত হওয়া নৌঘাটেও বাংলাদেশ অভ্যন্তরীণ নৌপরিবহন কর্তৃপক্ষের (বিআইডব্লিউটিএ) কোনো অনুমোদন নেই। তবে ঘাটকে ঘিরে বাণিজ্য বেশ রমরমা।
মৌসুমের শুরুতে বিভিন্ন রুটে সিরিয়ালের জন্য প্রতি নৌকামালিককে গুনতে হয় এক থেকে ৩ লাখ টাকা। সেই হিসেবে প্রতিবছর বর্ষার শুরুতে নৌকামালিকদের থেকে চাঁদা ওঠে প্রায় ৩ কোটি টাকা। এতেই শেষ নয়, প্রতিদিন নৌকা ঘাটের সিন্ডিকেটকে দিতে হয় ৫০ থেকে ১০০ টাকা। ৫০ টাকা করে হিসাব করলে ২০০ নৌকা থেকে দৈনিক চাঁদা ওঠে ১০ হাজার টাকা। ছয় মাসে এই টাকার অঙ্ক দাঁড়ায় ১ কোটি ৮০ লাখ টাকা। এই টাকার পুরো চাপ পড়ে যাত্রী ও মালামাল বহনকারীর ওপর।
জেলার গুরুত্বপূর্ণ প্রধান বাজার হিসেবে ধরা হয় আনন্দবাজারকে। প্রতিদিনই বাজার থেকে প্রায় ১৫টি ঘাটের উদ্দেশে নৌকা ছেড়ে যায়। ঘাটগুলো হচ্ছে মনিপুর, লক্ষীমোড়া, অরুয়াইল, সরাইল ধরন্তি, চাতলপাড়, ইসলামপুর, চম্পকনগর, পত্তন, দত্তখোল, আউলিয়া বাজার, বিষ্ণুপুর, সিংগার বিল, নবীনগর, ভৈরব, আশুগঞ্জ। প্রতিটি ঘাট ঘিরে রয়েছে চক্র। তারা কখনো বাজার কমিটি, কখনো পৌরসভা বা জেলা প্রশাসকের দোহাই দিয়ে ঘাট নিয়ন্ত্রণ করেন।
আনন্দবাজার-সংলগ্ন কারখানা ঘাটের ইজারাদার দাবি করে কালন মিয়া নামের একজন জানান, পৌরসভা থেকে তিনি ঘাটের ইজারা এনেছেন। টাকা নেওয়ার কথা স্বীকার করে তিনি বলেন, ‘ঘাটের প্রতি নৌকা থেকে আকার অনুসারে দৈনিক ৫০ থেকে ১০০ টাকা নিই।’
তবে ঘাট ইজারা দেওয়ার কথা অস্বীকার করেন ব্রাহ্মণবাড়িয়া পৌরসভার সচিব মোহাম্মদ শামসুদ্দিন।
চম্পকনগর ঘাট নিয়ন্ত্রণ করে চম্পকনগর বাজার কমিটি। এখান থেকে টাকা তোলার কথা স্বীকার করেন বাজার কমিটির সহসভাপতি জলপু ভূঁইয়া। তিনি জানান, চম্পকনগর ঘাটে ১৫টি নৌকা আছে। এরা প্রতিবছর ১০-১৫ হাজার টাকা করে দেয়। এই বছর একটু বেশি নেওয়া হয়েছে। তবে এই টাকার বড় অংশ বাজারের মসজিদ পরিচালনায় ব্যয় হয়।
শিমনা ঘাট থেকে প্রায় আনন্দবাজার যাতায়াত করেন ব্যবসায়ী মো. রয়েল। তিনি বলেন, নৌঘাটে সিন্ডিকেট ছাড়া কোনো নৌকা ছাড়ে না। নৌকাগুলোতে ৫০ জনের জায়গায় ২০০ জন নেওয়া হয়। সিরিয়াল ঠিক করার জন্য প্রতিটি নৌকাকে দৈনিক ২০০ টাকা চাঁদা দিতে হয়। সিন্ডিকেটের বাণিজ্যের টাকা আদায় করা হয় যাত্রীদের পকেট কেটেই। আবার এই যাত্রীরাই প্রতিবছর নৌকাডুবিতে মৃত্যুর ঝুঁকিতে পড়ে।
এ বিষয়ে জানতে চাইলে ব্রাহ্মণবাড়িয়ার বিআইডব্লিউটিএর উপপরিচালক শহীদুল্লাহ্ বলেন, এখানে ইঞ্জিনচালিত নৌকাগুলো অতিরিক্ত যাত্রী নিয়ে চলাচল করে। এসব নৌকা ও ঘাটে বিআইডব্লিউটিএর কোনো অনুমোদন নেই। সবগুলো অবৈধভাবে চলছে। অনেক জায়গায় এমন অনিয়ম হচ্ছে। এগুলোর বিরুদ্ধে অভিযান শুরু হয়েছে। ঝুঁকিপূর্ণ নৌযান বন্ধের সুপারিশ জানানো হবে।
ব্রাহ্মণবাড়িয়ার পুলিশ সুপার আনিসুর রহমান বলেন, যে দুর্ঘটনা ঘটেছে তা মাথায় রেখে তদন্ত শুরু করা হয়েছে। নৌঘাট ও অবৈধ নৌযান শৃঙ্খলায় ফিরিয়ে আনতে চেষ্টা চলছে। জেলা প্রশাসনের সঙ্গে সমন্বয় করে কাজ করা হবে।
ব্রাহ্মণবাড়িয়ার জেলা প্রশাসক হায়াত-উদ-দৌলা খান আজকের পত্রিকাকে বলেন, নৌ দুর্ঘটনার পর তদন্ত কমিটি কাজ শুরু করেছে। তদন্ত প্রতিবেদন হাতে এলে বিস্তারিত দেখে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নেওয়া হবে।
এ দিকে ট্রলারডুবির ঘটনার পর ব্রাহ্মণবাড়িয়ার বিজয়নগর উপজেলা থেকে জেলা শহরে আসা সব ধরনের নৌযান চলাচল সাময়িকভাবে বন্ধ করেছে উপজেলা প্রশাসন। তবে তা মানেননি কেউই। ট্রলারডুবির পরদিন শুক্রবার বিকেলে এই নিষেধাজ্ঞা জারি করা হলেও শনিবার সকাল থেকেই এই রুটে ইঞ্জিনচালিত নৌকা চলাচল করতে দেখা গেছে।