কারও পা নেই—কেউ ক্র্যাচে ভর দিয়ে ঘুরছেন। কেউ বছরের পর বছর ছিলেন পরিবার থেকে দূরে, কেউ বা মামলায় জর্জরিত হয়ে থেকেছেন কারাগারে। এমন হাজারো বিএনপির নেতা-কর্মীকে নিয়ে আজ রোববার যশোর জেস গার্ডেনে অনুষ্ঠিত হয়েছে ব্যতিক্রমী এক মিলনমেলা।
যাঁরা বিগত সরকারের শাসনামলে ভিন্নমতের কারণে অত্যাচার-নির্যাতনের শিকার হয়েছেন। দীর্ঘদিন পর একে অন্যের সঙ্গে উন্মুক্ত পরিবেশে খাওয়া-দাওয়া, আড্ডা, কুশলবিনিময় আর স্মৃতিচারণা করেন। এ সময় স্মৃতিচারণা করে অনেকে কান্নায় ভেঙে পড়েন।
অনুষ্ঠানে মেহগনি গাছের সঙ্গে প্লাস্টিকের চেয়ারে হেলান দিয়ে বসে রয়েছেন ইউনুচ আলী ওরফে তারা বাবু। সাদা পায়জামা-পাঞ্জাবি পরিহিত চল্লিশোর্ধ্ব এই ব্যক্তির পাশে রাখা দুটি ক্রাচ। এতে ভর দিয়েই তিনি এসেছেন মিলনমেলায়।
সদর উপজেলার দেয়াড়া ইউনিয়ন বিএনপির সহপ্রচার সম্পাদক ইউনুচ আলী আজকের পত্রিকাকে বলেন, ‘ভিন্নমতের রাজনীতির সঙ্গে জড়িত থাকার কারণে ২০১৪ সালের ২৭ মার্চ বাড়ি থেকে তুলে নিয়ে যায় সাদাপোশাকধারী পুলিশ। এরপর অস্ত্র উদ্ধারের নাটক সাজিয়ে পায়ে গুলি করে হাসপাতালে ভর্তি করে।’
চিকিৎসায় একটি পা কেটে ফেলতে হয় তাঁর। এরপর অস্ত্র, নাশকতার মামলার আসামি করে আদালতে পাঠালে তাঁকে কারাগারে পাঠান বিচারক। তিনি বলেন, ‘দুই বছরের বেশি সময় কারাভোগ করে বাড়ি ফিরলেও স্বাভাবিক জীবনে ফিরতে পারিনি। কোনো সন্ত্রাসী কর্মকাণ্ড না করলেও শুধু বিএনপির রাজনীতির সঙ্গে জড়িত বলেই বিগত সরকারের পুলিশ আমাকে পঙ্গু করেছে।’
২০১৪ সালের ৫ জানুয়ারির ভোট নিয়ে সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে পোস্ট দেন সদরের লেবুতলা ইউনিয়ন স্বেচ্ছাসেবক দলের আহ্বায়ক হায়দার আলী। পরে পুলিশ স্থানীয় বাজার থেকে তুলে এনে ডিজিটাল নিরাপত্তা আইন ও নাশকতা মামলার আসামি করে কারাগারে পাঠায়। দীর্ঘ দুই বছর তিন মাস কারাভোগের পর বাড়ি ফিরলেও আওয়ামী লীগের নেতা-কর্মীদের কাছে লাগাতার হামলা-মামলায় জর্জরিত হন তিনি। তিনি বলেন, ‘দীর্ঘদিন কোনো লোকসমাগম অনুষ্ঠানে যোগদান করতে পারেনি, পুলিশি আটকের ভয়ে। এখন উন্মুক্ত পরিবেশে এমন অনুষ্ঠানে যোগ দিতে পেরে খুশি লাগছে।’
শুধু এ দুজনই নন, বিগত আওয়ামী লীগ সরকারের শাসনামলে ভিন্নমতের কারণে অত্যাচার-নির্যাতনের শিকার হয়েছেন যশোরে এমন হাজার হাজার মানুষ। বছরের পর বছর ঘটে যাওয়া নির্যাতনের চিহ্ন এখনো তাঁরা শরীরে বয়ে বেড়াচ্ছেন।
অনুষ্ঠানে দেখা গেছে, দীর্ঘদিন পর নেতা-কর্মীরা একসঙ্গে হতে পেরে আড্ডায় বসেছেন। কেউ সেলফি তুলে স্মৃতি রাখছেন। অনেককে একসঙ্গে জেলজীবনের নানা স্মৃতিচারণাও করতে দেখা গেছে।
নির্যাতিত নেতা-কর্মীদের সম্মান জানাতে এমন উদ্যোগের আয়োজন জানিয়ে বিএনপির ভারপ্রাপ্ত সাংগঠনিক সম্পাদক অনিন্দ্য ইসলাম অমিত বলেন, ফ্যাসিবাদবিরোধী আন্দোলনে সদর উপজেলা ও নগর বিএনপির অনেক নেতা-কর্মী রাজপথে ছিলেন। অনেকে মিথ্যা মামলায় জেলে গেছেন। আবার অনেকে শহীদ হয়েছেন। পঙ্গুত্ববরণ করেছেন অনেকেই।
আমরা চেয়েছি ফ্যাসিবাদমুক্ত বাংলাদেশকে এক কাতারে আনার। আত্মার আত্মত্যাগকে সম্মান জানানোর জন্য মিলনমেলার আয়োজন করা হয়েছে। একই সঙ্গে জাতীয়তাবাদী দল মনে করে, ফ্যাসিবাদের পতনের শুধু একটি রাজনৈতিক দলের পক্ষে সম্ভব ছিল না। আমরা বারবারই সমমনা রাজনৈতিক দল ও বিভিন্ন শ্রেণি-পেশার মানুষকে ফ্যাসিবাদবিরোধী আন্দোলনে আহ্বান জানিয়েছি। ফ্যাসিবাদবিরোধী আন্দোলনে সবাই অংশ নিয়েছেন। তিনি আরও বলেন, ‘নতুন বাংলাদেশের স্বপ্ন পূরণে সবাইকে ঐক্যবদ্ধ হতে হবে। ঐক্যবদ্ধ না থাকলে কাঙ্ক্ষিত পরিবর্তন সম্ভব হবে না। এই আয়োজনের মাধ্যমে সেই বার্তা দিতে চাই।’