মো. আতাউর রহমান, জয়পুরহাট
মাছ বিক্রেতার স্ত্রী তিনি। স্বামীর মাছ বিক্রির লাভের টাকায় টেনেটুনে দিন চলত। সংসারে অভাব লেগেই থাকত। নুন আনতে পান্তা ফুরানোর অবস্থা। একটা অভাব মিটলে, নতুন করে হাজির হতো আরেকটি। ধারদেনা করেই চলতে হতো। অবস্থা যখন এমন, তখন পরিত্যক্ত মাছের আঁশ বিক্রি করে গোটা পরিবারের দিন বদলে দিয়েছেন ওই গৃহবধূ। গল্পটি জয়পুরহাট পৌর শহরের শান্তিনগর মহল্লার গৃহবধূ নীলা আক্তারের।
নীলা আক্তার জানান, তাঁর স্বামী ও শ্বশুর মাছ ব্যবসায়ী। স্বামীর মাছ বিক্রির লাভের টাকায় কোনোরকমে সংসার চলতো। অভাব পিছু ছাড়তো না তাঁদের। চালের অভাব মিটলে, ডালের অভাব থাকত-অবস্থা এমন। শখ করে কিছু কেনাকাটা করার সুযোগ ছিল না। সংসারের আয় বাড়াতে তিনি মনে মনে নানা পরিকল্পনা করতেন। কিন্তু পুঁজি তো নাই। করবেন কী? ভেবে ভেবে হতাশ হতেন তিনি। অবস্থা যখন এমন, তখন ‘জাকস ফাউন্ডেশন’ নামে একটি বেসরকারি সংস্থা তাঁর মনে আশার আলো জাগিয়ে দিল। বিনা পুঁজিতে মাছের আঁশ প্রক্রিয়াজাত করণের পদ্ধতি হাতে-কলমে শেখানো হলো। দেওয়া হলো প্রশিক্ষণ। সেই সঙ্গে আঁশ প্রক্রিয়াজাতকরণের সব উপকরণও দেওয়া হলো তাঁকে। জানিয়ে দেওয়া হলো, কাতলা, রুই ও মৃগেল জাতীয় মাছের আঁশ কাজে লাগে।
নীলা আক্তার এবার কোমর বেঁধে কাজে নামলেন। তিনি বাজার থেকে পরিত্যক্ত মাছের আঁশ সংগ্রহ করেন। এরপর সেগুলো পানি দিয়ে পরিষ্কার করে স্বাস্থ্যসম্মতভাবে শুকাতে দেন রোদে। শুকানো হলে আঁশগুলো ড্রামে সংরক্ষণ করেন। সংরক্ষিত সেই আঁশগুলো পাইকাররা বাড়িতে এসে তিন হাজার টাকা মন দরে কিনে নিয়ে যান। এভাবে কেটে যায় চার বছর। বাজারে এখন আঁশের চাহিদা ভালো। বিনা পুঁজিতে এখন মাসে তাঁর উপার্জন হয় ১৫-১৬ হাজার টাকা। এভাবে ভাগ্যের চাকাও ঘুরেছে তাঁর। সচ্ছলতা এসেছে সংসারে। নীলা আক্তারের সাফল্যে দেখে, অনেক নারী এ পেশায় এসেছেন।
একই মহল্লার গৃহবধূ বেদেনা, রুমি, রাজেদা, রূপা, জানান, মাছের আঁশ বিক্রির বাড়তি রোজগারে নীলা আক্তারের অসচ্ছল সাংসারে স্বচ্ছতা এসেছে। এটা তাঁদের অনুপ্রেরণা দেয়। তাই মহল্লার ১০-১২ জন গৃহবধূ এখন মাছের আঁশ বিক্রি শুরু করেছেন। তাঁরাও মাসে ১৩-১৪ হাজার টাকা উপার্জন করছেন।
জাকস ফাউন্ডেশনের ভ্যালু চেইন ফ্যাসিলিটেটর আরিফুল ইসলাম আজকের পত্রিকাকে বলেন, ‘একসময় মাছের আঁশকে ফেলে দেওয়ার জিনিস হিসেবে বিবেচনা করা হতো। কিন্তু জাকস ফাউন্ডেশনের পৃষ্ঠপোষকতা, প্রশিক্ষণ ও পরামর্শে জয়পুরহাটের অনেকেই মাছের আঁশ রপ্তানি করে বৈদেশিক মুদ্রা অর্জনের পথ তৈরি করেছেন। এখন জয়পুরহাট সদরের অন্তত ১৪-১৫ জন গৃহিণী এ কাজ শুরু করে সংসারে সচ্ছলতা এনেছেন।’
তিনি আরও বলেন, ‘মাছের আঁশ চিকিৎসাবিজ্ঞানেও কাজে লাগে। মাছের আঁশে থাকে কোলাজেন। এটি খাদ্য, ওষুধ, ফুড সাপ্লিমেন্ট ও কসমেটিকস শিল্পে ব্যবহৃত হয়। তা ছাড়াও ব্যাটারি তৈরি, বৈদ্যুতিক পণ্য, কৃত্রিম কর্নিয়া, মাছ ও পোলট্রির খাদ্য, ক্যাপসুল তৈরিতেও মাছের আঁশ ব্যবহার করা হয়। তবে ছোট মাছের আঁশের কদর নেই। আমার বিশ্বাস, বিকল্প আয়ের পথ হিসেবে যে কেউ মাছের আঁশ বিক্রি করে স্বাবলম্বী হতে পারবেন।’