‘ভারতীয় গরুর ব্যবসা এবং মৌসুমে আমের ব্যবসার আড়ালে টাকা লুট করেন তিনি। তবে কোনো বাসা বাড়ি থেকে নয়, টাকা লুট করেন ব্যাংকসহ বিভিন্ন প্রতিষ্ঠান থেকে। আর এই কাজে সঙ্গে কাউকে নিতেন না। নিজেই পরিকল্পনা করে তা বাস্তবায়ন করতেন।’
শফিকুল ইসলাম (৪০) নামের এক ব্যক্তিকে গ্রেপ্তারের পর তাঁর সম্পর্কে এসব তথ্য দিয়েছেন বগুড়া জেলা পুলিশ সুপার সুদীপ কুমার চক্রবর্তী। আজ বৃহস্পতিবার তাঁকে আদালতের মাধ্যমে কারাগারে পাঠানো হয়েছে।
গ্রেপ্তারকৃত শফিকুল ইসলাম নওগাঁ জেলার সাপাহার উপজেলার পশ্চিম করমডাঙ্গা গ্রামের মৃত আব্দুস সালামের ছেলে। গতকাল বুধবার রাতে তাঁর নিজ বাড়ি থেকে গ্রেপ্তার করে বগুড়া জেলা গোয়েন্দা পুলিশ।
পুলিশ সুপার সুদীপ কুমার চক্রবর্তী বলেন, ‘শফিকুল গ্রেপ্তারের পর তাঁর হেফাজত থেকে একটি নোটবুক উদ্ধার করা হয়। সেখানে কোন মাসে, কোন জেলার, কোন প্রতিষ্ঠানের টাকা লুট করবে তাঁর তালিকা ছিল। সেই অনুযায়ী পরবর্তী টার্গেট ছিল বগুড়ার শেরপুর উপজেলার ভবানীপুর মন্দির। নোটবুকে লেখা রয়েছে ভবানীপুর মন্দিরের সিন্দুকে নগদ টাকা ছাড়াও বিপুল পরিমাণ সোনার গয়না রয়েছে।’
পুলিশ সুপার সুদীপ কুমার চক্রবর্তী বলেন, ‘গত ২৩ এপ্রিল (রোববার) রাতে বগুড়া প্রধান ডাকঘরের নৈশ প্রহরীর দায়িত্বে থাকা অফিস সহায়ক প্রশান্ত আচার্যকে খুন করে, ভল্ট কেটে ৮ লাখ টাকা লুট করেন শফিকুল একাই। ডাকঘরের টাকা লুটের জন্য গত ১২ মার্চ থেকে পরিকল্পনা করেন তিনি। বগুড়া ছাড়াও ঢাকা, রাজশাহী, চাঁপাইনবাবগঞ্জ ও নওগাঁতেও একই কায়দায় এর আগে টাকা লুট করেছেন তিনি। এমনকি ভারতেও টাকা লুট করতে গিয়ে ধরা পরে এক বছরের কারা ভোগ করতে হয় শফিকুল। তাঁর নামে বিভিন্ন জেলায় টাকা লুটের ৯টি মামলা থাকলেও সহজে জামিন পেয়ে যান প্রতিটি ঘটনার সঙ্গে একাই জড়িত থাকার জন্য। কারণ একাই টাকা লুট করায় প্রথমে ডাকাতি মামলা হলেও পরে তা চুরি মামলায় রূপান্তর হয়।’
পুলিশ সুপার আরও বলেন, ‘বগুড়া প্রধান ডাকঘরের টাকা লুটের পর ভল্ট কাটার কাজে ব্যবহৃত শান মেশিন (কাটার) ও তার প্যাকেটসহ বিভিন্ন সরঞ্জাম ফেলে রেখে চলে যান। সেই শান মেশিনের প্যাকেটে থাকা কিউআর কোড ধরেই পুলিশ টাকা লুটের রহস্য উদ্ঘাটন করে।’
শফিকুল ইসলাম ২০১৬ থেকে ২০২০ সাল পর্যন্ত স্থানীয় পাথারি ইউনিয়ন পরিষদের সদস্য (মেম্বার) ছিলেন। এবার ওই ইউনিয়নে চেয়ারম্যান পদে নির্বাচন করার ইচ্ছাও ছিল তাঁর। পুলিশের হাতে গ্রেপ্তার হওয়া শফিকুলের বিরুদ্ধে ২০১৯ সালে ঢাকার বনানীতে জনতা ব্যাংকের ভল্ট কেটে টাকা লুটসহ ৯টি মামলা চলমান।
ডাকঘরের ভল্ট লুটের ঘটনার বর্ণনায় গ্রেপ্তারকৃত শফিকুলের বরাত দিয়ে পুলিশ কর্মকর্তা সুদীপ কুমার বলেন, ‘গ্রেপ্তার হওয়া শফিকুল খুবই চতুর ও সাহসী। গত ১২ মার্চ মোটরসাইকেল যোগে বগুড়ায় আসেন। বগুড়া শহরের সাতমাথায় প্রধান ডাকঘরের সামনে মোটরসাইকেল রেখে ডাকঘরে প্রবেশ করেন। এরপর ডাকঘরে ভোল্টের অবস্থান, সিসি ক্যামেরা, প্রবেশ ও বের হওয়ার ব্যবস্থা এবং নিরাপত্তার বিষয়টি পর্যবেক্ষণ করে ফিরে যান। এরপর ১৫ মার্চ পুনরায় মোটরসাইকেল যোগে বগুড়ায় পৌঁছে, সদর থানার পেছনে বিআরটিসি মার্কেট থেকে গ্রিল ও ভল্ট কাটার যন্ত্রপাতি কেনেন। এরপর ২০ এপ্রিল বাসযোগে রাত ১০টার দিকে বগুড়ায় পৌঁছে রাতভর ডাকঘরের আশপাশে ঘোরাঘুরি করেন। রাত ৩টার দিকে প্রাচীর টপকে ভেতরে ঢোকেন। এরপর ডাকঘর চত্বরে গ্যারেজ ও মসজিদের কোনায় লুকিয়ে ছিলেন। সকাল ৬টার দিকে গার্ড কেচি গেট খুলে রেখে বাইরে প্রস্রাব করতে গেলে, শফিকুল ডাকঘরে প্রবেশ করে দোতলায় সিঁড়ি ঘরে লুকিয়ে থাকেন। এ সময় সঙ্গে নিয়ে যাওয়া শুকনা খাবার, সিগারেট ও পানি পান করেন। শুক্রবার দুপুরে গার্ড নামাজে গেলে শফিকুল সিঁড়ি ঘর থেকে নেমে গ্রিল কেটে ভল্টের রুমে প্রবেশ করেন। এই সময়ে সে সিসি টিভি ক্যামেরার লাইন কেটে দেওয়া এবং ভল্টের দরজার একাংশ কেটে ফেলার কাজ করেন। কিন্তু ভল্টের ভেতরে ঢুকতে পারে না। সন্ধ্যার পর গার্ড কেচি গেট খুলে রেখে ডাকঘর চত্বরে ঘোরাফেরা করার সুযোগে তিনি কৌশলে সেখান থেকে বের হয়ে বাড়ি যান।’
পুলিশ সুপার সুদীপ কুমার চক্রবর্তী বলেন, ‘পুলিশ ঘটনার সংবাদ পেয়ে ডাকঘরে গিয়ে যেসব আলামত উদ্ধার করে তার মধ্যেই ছিল কিউআর কোড সংবলিত শান মেশিনের প্যাকেট। এ ছাড়া ডাকঘরের সিসিটিভি ক্যামেরা অকেজো করার আগের কিছু চিত্র তাদের হাতে আসে। সেই সূত্র ধরেই তদন্ত চালিয়ে শনাক্ত করা হয় আসামিকে। এরপর তাঁকে আটক করে জিজ্ঞাসাবাদ করলে তিনি হত্যাকাণ্ডসহ টাকা লুটের বিষয়টি স্বীকার করেন। পুলিশি জিজ্ঞাসাবাদে তিনি জানিয়েছেন-শুধু দেশেই নয়, ভারতে গিয়েও একাই টাকা লুট করতে গিয়ে ধরা পড়ে এক বছর কারা ভোগ করেছেন।’