অর্থনীতিবিদ অধ্যাপক বিরূপাক্ষ পাল তাঁর ‘মধ্যম আয়ের ফাঁদভীতি ও বাংলাদেশ’ শীর্ষক সাম্প্রতিক এক নিবন্ধে নিম্নমধ্যম আয় থেকে উচ্চমধ্যম আয় হয়ে উচ্চ আয়ের দেশে রূপান্তরিত হওয়ার পথের সম্ভাব্য বাধা ও বাধা অতিক্রমের উপায় এবং এ নিয়ে আইএমএফ ও বিশ্বব্যাংকের মতো প্রতিষ্ঠানগুলোর দিক থেকে যুক্তিহীন কল্পকথা (myth) তৈরির চেষ্টার বিষয়টি নিয়ে বিস্তারিত আলোচনা করেছেন। আর তা করতে গিয়ে মধ্যম আয়ের কথিত ফাঁদ অতিক্রমণের চেষ্টায় অন্যান্য কতিপয় দেশের সাফল্য ও ব্যর্থতার উদাহরণ টেনে সেই সব দেশের অভিজ্ঞতার কথাও তিনি চমৎকারভাবে উল্লেখ করেছেন এবং তিনি এ-ও দেখিয়েছেন যে উত্তরণের এ পথযাত্রায় আসলে ‘ফাঁদ’ বলে কিছু নেই—প্রকৃতপক্ষে যা আছে তা হচ্ছে, জনগণের কাছে দায়বোধসম্পন্ন দক্ষ নেতৃত্বের আওতায় সুষ্ঠু অর্থনৈতিক পরিকল্পনা গ্রহণের প্রয়োজনীয়তা এবং সেই পরিকল্পনা বাস্তবায়নে বর্ধিত গতি সৃষ্টি ও সৃষ্ট গতি ধরে রাখার সামর্থ্য অর্জন।
এখন কথা হচ্ছে, বিশ্বব্যাংক-আইএমএফের কল্পকথা মেনে হোক কিংবা যুক্তিশীল স্বাধীন চিন্তাতাড়িত অর্থনৈতিক কৌশল অনুসরণ করে হোক, অর্থনৈতিক উত্তরণের পথ তো আমাদের খুঁজতেই হবে। তবে সে পথের অনুসন্ধান করতে গিয়ে প্রথমেই বলা দরকার যে উল্লিখিত দুই প্রতিষ্ঠানের পরামর্শ মেনে মাথাপিছু আয়কে উন্নয়নের স্তর নির্ধারণের ভিত্তি হিসেবে গ্রহণের ধারণাটিই চরম ভ্রান্তিপূর্ণ। ফলে উল্লিখিত ধারণার ভিত্তিতে বাংলাদেশকে যে বর্তমানে অর্থনৈতিক উন্নয়নের ক্ষেত্রে নিম্নমধ্যম সারির দেশ হিসেবে চিহ্নিত করা হচ্ছে, সেটি বাস্তবে এর সংখ্যাগরিষ্ঠ জনগণের নিম্নমধ্যম মানের জীবনযাপনের নিশ্চয়তা বিধান করতে পারছে কি? যদি না পেরে থাকে, তাহলে নিম্নমধ্যম আয়ের দেশের পরিচিতি এর সংখ্যাগরিষ্ঠ জনগণের জন্য একটি ‘তকমা’ মাত্র এবং এই তকমা দেশের শাসকশ্রেণি বা আন্তর্জাতিক দাতাদের নিজ নিজ অবস্থানে টিকে থাকার প্রচারকৌশল হিসেবে সুবিধাজনক হলেও সাধারণ মানুষের কাছে এই স্তরোত্তরণের গুরুত্ব খুবই সামান্য।অবশ্য এরপরও এককেন্দ্রিক পুঁজিবাদী বিশ্বব্যবস্থার আওতায় এটাই চলমান বাস্তবতা যে বিশ্বব্যাংক নির্দেশিত স্তরকাঠামো অনুসরণ করেই বাংলাদেশসহ এর সদস্যদেশগুলো তাদের অর্থনৈতিক উন্নয়ন পরিকল্পনা প্রণয়ন ও বাস্তবায়ন করবে। কিন্তু তাই বলে সব দেশেই এর ফলাফল একই রূপ হবে না। কোন দেশে তা কিরূপ হবে, সেটি নির্ভর করবে ওই দেশের সাধারণ জনগণের আকাঙ্ক্ষা ও প্রয়োজনের প্রতি ওই রাষ্ট্র কতটুকু মনোযোগী ও মমতাবান, তার ওপর। রাষ্ট্রের নীতিনির্ধারকেরা যদি বিত্তবান ব্যবসায়ী শ্রেণির স্বার্থরক্ষায় অধিক মনোযোগী হন, তাহলে উচ্চতর অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধির হার হয়তো ঠিকই রক্ষা পাবে, কিন্তু তাতে সাধারণ মানুষের স্বার্থ রক্ষা পাবে খুবই সামান্য। অন্যদিকে রাষ্ট্র যদি সাধারণ মানুষের স্বার্থকে প্রাধান্য দিতে চায়, তাহলে প্রবৃদ্ধির অঙ্কে যৎসামান্য ঘাটতি থাকলেও বৃহত্তর জনগোষ্ঠীকে তা যে বর্ধিত স্বাচ্ছন্দ্য ও পরিতৃপ্তি এনে দেবে, তার উপযোগ মূল্য প্রবৃদ্ধির খানিক ঘাটতির তুলনায় অনেক অনেক বেশি।
উপরিউক্ত পরিস্থিতিতে যেকোনো জবাবদিহিপূর্ণ গণতান্ত্রিক রাষ্ট্রেরই কর্তব্য হবে শেষোক্ত কৌশলটি অবলম্বন করা, অর্থাৎ সাধারণ জনগণের স্বার্থের পক্ষে দাঁড়ানো। কিন্তু রাষ্ট্র পরিচালনার দায়িত্বে থাকা শাসকের, যাঁদের সিংহভাগই সৎ-অসৎ ব্যবসায়ী ও অন্যান্য বিত্তবান শ্রেণি থেকে উঠে আসা, নিজস্ব শ্রেণিচরিত্রের কারণে তা করবেন না বলেই মনে হয়। কিন্তু তা সত্ত্বেও ব্যবসায়ী ও বিত্তবান শ্রেণির একচ্ছত্র বিনিয়োগ ও একচেটিয়া মুনাফার সুবাদে নিম্নমধ্যম থেকে উচ্চমধ্যম আয়ের দেশে পরিণত হওয়ার জন্য বাংলাদেশের অর্থনীতিতে যে ধরনের গতি সঞ্চারিত হওয়া দরকার, তা ঠিকই হয়ে যাবে বলে ধারণা করা চলে। কিন্তু অর্থনৈতিক উন্নয়নের সুফল সাধারণ মানুষের পাতে যৌক্তিক হারে ভাগ না হওয়ার বিষয়টি যে গণমুখী পরিকল্পনা ও নীতিকাঠামোর অভাবে দীর্ঘদিন ধরেই চিলকার বন্দের কানাওয়ালার ফাঁদে পড়ে ঘুরপাক খাচ্ছে, তা থেকে শিগগিরই উদ্ধার না পাওয়ার বিষয়টি এখন প্রায় নিশ্চিত।
তাহলে শেষ পর্যন্ত বিষয়টি দাঁড়াচ্ছে এই, বিত্তবান সুবিধাবাদী বণিকশ্রেণি দ্বারা পরিবেষ্টিত রাষ্ট্র এখনো আগের মতোই তথাকথিত প্রবৃদ্ধি ও মাথাপিছু আয়কেই ‘উন্নয়ন’ বলে চালিয়ে দেওয়ার চেষ্টা অব্যাহত রাখবে এবং এর ফলে মাথাপিছু আয়ের হিসাবে নিম্নমধ্যম থেকে উচ্চমধ্যম আয়ের স্তরে উন্নীত হওয়ার বিষয়টি হয়তো ঠিকই ঘটে যাবে। কিন্তু গৃহীত উন্নয়নকৌশলের আওতায় ক্রমবর্ধমান বৈষম্য শেষ পর্যন্ত কোথায় গিয়ে ঠেকবে, তা নিশ্চিত করে বলা খুবই মুশকিল। তবে যেটি বলা সম্ভব তা হচ্ছে, নিছক মাথাপিছু আয়কেই উন্নয়নের মাপকাঠি ধরে নিয়ে রাষ্ট্র যে অর্থনৈতিক কৌশল নিয়ে এগোচ্ছে, তাতে বৈষম্য শুধু টিকেই থাকবে না—ক্রমান্বয়ে তা আরও বৃদ্ধি পাবে এবং সংখ্যাগরিষ্ঠ সাধারণ মানুষের জন্য তা অধিকতর কষ্ট ও দুর্ভোগের কারণ হয়ে দাঁড়াবে।
এ অবস্থায় বাংলাদেশ যদি তার সম্পদের বণ্টনব্যবস্থাকে অধিকতর যৌক্তিক ও সমতাপূর্ণ করে তোলার লক্ষ্যে তার অর্থনৈতিক কৌশলকে
ঢেলে সাজাতে উদ্যোগী না হয়, তাহলে তা শুধু বড় ভুলই করা হবে না—সেই ভুলের খেসারত হিসেবে এখানে এমন নানা মাত্রিক সামাজিক সংকট তৈরি হতে পারে, যা উন্নয়নের সব নজির ও অহমিকাকেই ম্লান করে দিতে পারে।
এ অবস্থায় বাংলাদেশকে যদি তার নিজস্ব জনগণের চাহিদা ও আকাঙ্ক্ষাকে বিবেচনায় রেখে টেকসই উন্নয়নের পথে এগোতে হয়, তাহলে শুধু বিত্তবান শ্রেণির আয় ও মুনাফানির্ভর উচ্চতর প্রবৃদ্ধির ওপর নির্ভর করলে হবে না; বরং বর্তমান উন্নয়নের ধারায় সৃষ্ট ক্রমবর্ধমান বৈষম্যকে ন্যূনতম সহনশীল পর্যায়ে নামিয়ে আনারও চেষ্টা করতে হবে।
আবু তাহের খান, সাবেক পরিচালক, বিসিক, শিল্প মন্ত্রণালয়