দেশের বিদ্যুৎ ও জ্বালানি খাতের উন্নয়নে গত ২৭ বছরে ২৩টির মতো মাস্টারপ্ল্যান ও নীতি গ্রহণ করা হয়েছে। তবে এসব উদ্যোগ জনপ্রত্যাশা পূরণ করেনি। জীবাশ্ম জ্বালানির ব্যবহার কমিয়ে নবায়নযোগ্য জ্বালানির ব্যবহারের দিকে এগিয়ে যেতে কার্যকর নীতি প্রণয়ন দরকার। এ জন্য প্রয়োজন জেলা ও বিভাগীয় পর্যায়ের নীতি প্রণয়ন করা। গতকাল সোমবার গবেষণা প্রতিষ্ঠান সাউথ এশিয়ান নেটওয়ার্ক অন ইকোনমিক মডেলিং (সানেম) আয়োজিত ওয়েবিনারে বক্তারা এসব কথা বলেন।
‘বিদ্যুৎ ও জ্বালানি খাতে কার্যকর নীতি প্রণয়নের জন্য একটি অংশগ্রহণমূলক পদ্ধতির উদ্ভাবন’ শীর্ষক ওই ওয়েবিনার পরিচালনা করেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অর্থনীতি বিভাগের অধ্যাপক এবং সানেমের গবেষণা পরিচালক ড. সায়েমা হক বিদিশা। স্বাগত বক্তব্য দেন সানেমের নির্বাহী পরিচালক অধ্যাপক ড. সেলিম রায়হান। সংস্থাটির গবেষণা সহযোগী মোহাম্মদ আসাদুজ্জামান মূল প্রবন্ধ উপস্থাপন করেন।
ওয়েবিনারে প্যানেল আলোচনায় অংশ নেন বাংলাদেশ সোলার অ্যান্ড রিনিউঅ্যাবল এনার্জি অ্যাসোসিয়েশনের সভাপতি দীপল সি বড়ুয়া, নর্থ সাউথ বিশ্ববিদ্যালয়ের অর্থনীতির সহযোগী অধ্যাপক ড. শাকিব বিন আমিন, ইউনাইটেড ইন্টারন্যাশনাল ইউনিভার্সিটির (ইউআইইউ) সহকারী অধ্যাপক শাহরিয়ার আহমেদ চৌধুরী এবং বাংলাদেশ এনার্জি রেগুলেটরি কমিশনের (বিইআরসি) প্রশাসন ও আইন বিভাগের সচিব (উপসচিব) ব্যারিস্টার খলিলুর রহমান খান।
সানেমের নির্বাহী পরিচালক বলেন, ‘আমরা সবাই জানি, বিদ্যুৎ ও জ্বালানি খাত আমাদের অর্থনৈতিক উন্নয়নের জন্য কতটা গুরুত্বপূর্ণ। এই খাতের কিছু চ্যালেঞ্জ সামষ্টিক অর্থনৈতিক চ্যালেঞ্জের সঙ্গে সম্পৃক্ত। বিশেষভাবে চলমান ইস্যু যেমন ডলারের সংকট, ফরেন রিজার্ভের অবমূল্যায়ন। এই সমস্যাগুলো জীবাশ্ম জ্বালানির আমদানিনির্ভরতার দিকে নিয়ে যাচ্ছে, যা উভয় ধরনের জ্বালানির ক্ষেত্রে খুবই নেতিবাচক।’
ড. বিদিশা বলেন, বিভিন্ন মন্ত্রণালয়, বিভিন্ন সরকারি সংস্থার মধ্যে সমন্বয় থাকা খুবই জরুরি, যারা ওই খাত ও নীতিকাঠামোর সঙ্গে সম্পৃক্ত। একই সঙ্গে অংশীজনদেরও পুরো কর্মপ্রণালির সঙ্গে সংযুক্ত করা গুরুত্বপূর্ণ। প্রয়োজন যথাযথ বাজেট এবং এর কার্যকর বাস্তবায়ন।
সানেমের গবেষণা সহযোগী আসাদুজ্জামান বলেন, ১৯৯৬ থেকে ২০২৩ সাল পর্যন্ত বাংলাদেশে ২৩টি মাস্টারপ্ল্যান এবং নীতি নেওয়া হয়েছে। এগুলোর মধ্যে বেশির ভাগই মাস্টারপ্ল্যান।
এসব উদ্যোগের তিন ধরনের বিচ্যুতি রয়েছে জানিয়ে আসাদুজ্জামান বলেন, প্রথমত, অ্যাডহক সিদ্ধান্ত গ্রহণের প্রক্রিয়াগুলো অসংগতিপূর্ণ এবং খাতের উন্নয়নে যথেষ্ট নয়। দ্বিতীয়ত, জনসাধারণের মতামত বাদ দেওয়ায় এবং নাগরিক পরামর্শ ও বিশেষজ্ঞদের হস্তক্ষেপের অভাবে এসব নীতির ক্ষেত্রে ‘প্রয়োজন ও ফলাফলের সংযোগ’ ঘটেনি। এ ছাড়া সরকারি সংস্থাগুলো এবং বেসরকারি খাতের অংশীজনদের মধ্যে সমন্বয়ের অভাব ও অসামঞ্জস্য রয়েছে।
সাকিব বিন আমিন বলেন, বাংলাদেশ জ্বালানি সংকট সমস্যা দূরীকরণে অনেক নীতি গ্রহণ করেছে। বিশেষজ্ঞরা শনাক্ত করেছেন, বেশির ভাগ নীতিই সামগ্রিক ভিত্তিতে (অ্যাগ্রিগেট বেসিস) নেওয়া হয়েছে। এই মুহূর্তে পর্যাপ্ত জ্বালানি নিশ্চিতকরণ এবং প্রান্তিক জনগণের সমস্যা তুলে ধরার জন্য বাংলাদেশের জ্বালানি নীতি হতে হবে জেলা ও বিভাগীয় পর্যায়ের।
দীপল সি বড়ুয়া বলেন, ‘২০০৮ ও ২০০৯ সালে সরকার বিদ্যুৎ উৎপাদনের জন্য উদ্গ্রীব ছিল। সব পরিকল্পনা নেওয়া হয়েছিল বেশি বেশি বিদ্যুতের জন্য। এটা ভালো। আমরা সফল হয়েছি। আপনি যদি টেকসই জ্বালানির ব্যবস্থা না করতে পারেন, তবে এ সফলতা অনেক সময় দায় হয়ে দাঁড়ায়।’
শাহরিয়ার আহমেদ চৌধুরী বলেন, পুরো বিশ্বই এখন নবায়নযোগ্য জ্বালানির দিকে ঝুঁকছে। বাংলাদেশের জ্বালানি খাতের জন্য একটি সমন্বিত মাস্টারপ্ল্যান প্রয়োজন।
স্মার্ট গ্রিড চালু করার আহ্বান জানিয়ে শাহরিয়ার আহমেদ চৌধুরী বলেন, এই স্মার্ট গ্রিডগুলো আইওটি, এআই এবং ইন্টারনেটের ওপর নির্ভর করে। তবে এ ক্ষেত্রে সাইবার আক্রমণের হুমকির ব্যাপারেও সতর্ক থাকতে হবে।
ব্যারিস্টার খলিলুর রহমান খান বলেন, বিদ্যুৎ ও জ্বালানি খাতের নীতিগুলো বৈশ্বিক পরিস্থিতি এবং বিস্তৃত গবেষণার ওপর ভিত্তি করে প্রস্তুত করা হয়। তবে বিশেষজ্ঞরা প্রায়ই ঐকমত্যে পৌঁছাতে ব্যর্থ হন, ফলে সরকার অটোনমি আচরণ করতে বাধ্য হয়।