গাজীপুরের শ্রীপুরে দৌরাত্ম্য বেড়েছে কিশোর গ্যাংয়ের। গত ১৫ দিনের মধ্যে বেশ কিছু ঘটনার জন্ম দিয়েছে গ্যাংয়ের সদস্যরা। মাদক সেবন করে রাস্তায় উল্লাস, নারীদের উত্ত্যক্ত, ওষুধ ব্যবসায়ীকে পিটিয়ে হত্যা, গার্মেন্টস শ্রমিককে ডেকে নিয়ে পাশবিক নির্যাতন, মুক্তিপণ আদায়ের জন্য নারীকে ডেকে নিয়ে দলবদ্ধ ধর্ষণ, চিকিৎসককে তুলে নিয়ে নির্যাতনের পর মুক্তিপণ আদায়সহ কয়েকটি ঘটনা স্থানীয়দের মধ্যে আতঙ্কের জন্ম দিয়েছে।
সুশীল সমাজের প্রতিনিধিরা মনে করছেন, মাদকের ভয়াবহতার কারণে এমন অপরাধের মাত্রা বাড়ছে। আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর ভূমিকা নিয়েও সন্দেহ তাঁদের। ভুক্তভোগীদের দাবি, আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর তৎপরতা না থাকায় দিনের পর দিন এমন অপরাধ মাথাচাড়া দিয়ে উঠছে।
খোঁজ নিয়ে জানা যায়, কিশোর গ্যাং অপরাধপ্রবণ এলাকাগুলোর মধ্যে রয়েছে পৌর শহরের মসজিদ মোড়, ফখরুদ্দিন মোড়, মাওনা চৌরাস্তা উড়াল সেতুর নিচে, শ্রীপুর রেঞ্জ অফিসসংলগ্ন, ওদ্দা দিঘি, তেলিহাটি ইউনিয়নের সফিক মোড়, বরমী ইউনিয়নের বরামা ব্রিজ, পাইটালবাড়ি, কাওরাইদ ইউনিয়নের নান্দিয়া সাঙ্গুন, গলদাপাড়া গ্রামসহ উপজেলার বেশ কিছু পয়েন্টে।
ভুক্তভোগী ও স্থানীয় সূত্রে জানা গেছে, পৌরসভার মসজিদ মোড়ে মা মনি নামক একটি ওষুধের দোকান পরিচালনা করতেন হাসিবুল ইসলাম বাদশা। মাঝেমধ্যেই স্থানীয় কিশোর গ্যাং নেতা রুবেল তাঁর কাছে পোলাপানের খরচের কথা বলে টাকাপয়সা দাবি করত। কয়েক দফা টাকাও নিয়েছে। এ বিষয়ে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর সদস্য ও স্থানীয়দের জানিয়ে প্রতিকার পাননি। সবশেষ ২ জানুয়ারি তাদের হাতেই খুন হন বাদশা। অভিযোগ রয়েছে, ঘরের দরজা ভেঙে ঢুকে ইট দিয়ে আঘাত করে তাঁকে হত্যা করা হয়।
কিশোর গ্যাং নেতা রুবেল ২০২২ সালের ১৮ মার্চ একই এলাকায় সিহাব নামে এক ছাত্রলীগ নেতাকে গুলি করে। ভাগ্যক্রমে বেঁচে যায় সিহাব। এ ছাড়া প্রায় প্রতিরাতে মোটরসাইকেল মহড়া দিয়ে এলাকায় আতঙ্ক সৃষ্টি করে মাদক কারবার চালিয়ে যাচ্ছে। ওষুধ ব্যবসায়ীকে হত্যার পরও কয়েক দফা সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম ফেসবুকে লাইভে এসে হুমকি-ধমকি দিচ্ছে। অথচ আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর সদস্যরা তাকে খুঁজে পাচ্ছেন না।
৮ জানুয়ারি এক পোশাকশ্রমিককে মুক্তিপণের জন্য দুই দিন আটকে রেখে পাশবিক নির্যাতন করা হয়। এ সময় মুক্তিপণ আদায়ের জন্য তাঁর ধর্মের বোনকে (নারী পোশাকশ্রমিক) কৌশলে ডেকে দলবদ্ধ ধর্ষণ করা হয়। ভুক্তভোগী দুজনেই জানিয়েছেন, দফায় দফায় মাদক সেবন করে তাঁদের ওপর নির্যাতন চালানো হয়েছে।
খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, খুন, ধর্ষণ, অপহরণ চক্রের নেতৃত্বে রয়েছেন পৌরসভার ফখরুদ্দিন মোড় এলাকার সাগর। তিনি গড়ে তুলেছেন ‘সাগর বাহিনী’। এ বাহিনীর টার্গেট পোশাকশ্রমিক। মাস শেষে শ্রমিকেরা বেতন পেলেই এ বাহিনীর সদস্যদের উৎপাত বেড়ে যায়। পুলিশ জানিয়েছে, একাধিক মামলার আসামি কিছুদিন আগে জামিনে মুক্ত হয়েছেন।
১১ জানুয়ারি মাওনা চৌরাস্তা এলাকার লাইফ কেয়ার নামক একটি হাসপাতালে চিকিৎসা দিচ্ছিলেন ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের চিকিৎসক মো. আমিনুর রহমান। চিকিৎসা দিয়ে ঢাকায় ফেরার জন্য মহাসড়কের পাশে দাঁড়িয়ে গাড়ির অপেক্ষা করছিলেন। এ সময় তাঁকে অপহরণ করা হয়। হাতুড়ি দিয়ে আঘাত করে শোনানো হয় স্ত্রী-স্বজনদের। মুক্তিপণের ১ লাখ ৩০ হাজার টাকা দেওয়ার পর রাজেন্দ্রপুর জঙ্গলে ফেলে যাওয়া হয় আমিনুরকে।
চিকিৎসকের চাচাতো ভাই সৈয়দ মোয়াজ্জেম হোসেন মিল্টন বলেন, ‘অপহরণের পরপরই আমরা আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর সদস্যদের কাছে উদ্ধারে সহযোগিতা চেয়েছি। সব তথ্য আমরা পুলিশকে সরবরাহ করছি। পুলিশের এত সব আধুনিক প্রযুক্তি ব্যবহার করেও ভাইকে উদ্ধার করতে পারেনি।’
শ্রীপুর নাগরিক ফোরামের সাধারণ সম্পাদক খোরশেদ আলম বলেন, মাদকে আসক্ত হয়ে কিশোর গ্যাংয়ের সদস্যরা এ ধরনের অপরাধে জড়িয়ে যাচ্ছে। মাদকাসক্ত একজন কিশোর কিংবা যুবক অপরাধ করতে কোনো ধরনের দ্বিধাবোধ করছে না। অপহরণ, নারীদের উত্ত্যক্ত এমনকি খুন করতে দ্বিধাবোধ করছে না। তিনি বলেন, পুলিশ যদি তাদের দায়িত্বটা সঠিকভাবে পালন করে, তাহলে এ ধরনের অপরাধ নির্মূল হবে। একটি অপরাধ অপহরণ, ধর্ষণ অথবা খুন সংঘটিত হলে একজন ভুক্তভোগী প্রথমে পুলিশকে জানায়। পুলিশ ঘটনাস্থলে আসার আগেই যোগাযোগ করে অপরাধীর সঙ্গে। এ জন্য পুলিশের ভূমিকা অনেক ক্ষেত্রে প্রশ্নবিদ্ধ।
শ্রীপুর থানার ওসি জয়নাল আবেদীন মণ্ডল বলেন, কিশোর গ্যাং নির্মূলে কাজ করছে পুলিশ। মাদকের বিরুদ্ধে অভিযান অব্যাহত রয়েছে। গত কয়েক দিনে চাঞ্চল্যকর কয়েকটি ঘটনার পরপরই বেশ কয়েকজন কিশোর গ্যাংয়ের সদস্যকে গ্রেপ্তার করে আদালতে পাঠানো হয়েছে। পুলিশের বিরুদ্ধে যে অভিযোগের তিরে এর সঠিক তথ্য-প্রমাণ পেলে ব্যবস্থা নেওয়া হবে।