সমাজচ্যুত করে ব্যবসা প্রতিষ্ঠানে ঝুলিয়ে দেওয়া হয় তালা। হত্যা ও ঘরবাড়ি পুড়িয়ে দেওয়ার হুমকির পর জনপ্রতিনিধিসহ উপজেলা প্রশাসনকে লিখিতভাবে জানিয়েছিলেন ভুক্তভোগী। পুলিশের কাছেও গিয়েছিলেন, কিন্তু থানা–পুলিশ ফিরিয়ে দিয়েছে। এরপর ওই ক্ষুদ্র ব্যবসায়ীর বাড়িতে তাণ্ডব চালানো হয়।
অভিযোগ উঠেছে, মসজিদের মাইকে ঘোষণা দিয়ে মো. তাহের আলী নামের ওই ব্যবসায়ীর বাড়িতে হামলা চালান জৈন্তাপুর উপজেলার চিকনাগুল ইউনিয়ন পরিষদের সদস্য ফারুক আহমদ ও তাঁর লোকজন।
এমন ঘটনায় ইউপি সদস্য ফারুককে প্রধান আসামি করে অর্ধশতাধিক ব্যক্তির বিরুদ্ধে থানায় মামলা করেছেন ভুক্তভোগী মো. তাহের আলী। তিনি একই উপজেলার উমনপুর গ্রামের মো. সিদ্দেক আলীর ছেলে। হামলাকারীরা তাহের আলীর বসতঘর ও আসবাবপত্র ভাঙচুর করে আগুন ধরিয়ে দেয়। সহিংসতা থেকে বাদ যায়নি পরিবারের অন্তঃসত্ত্বা নারী এবং শিশুরাও। দুই বছরের শিশুর মাথায় ধারালো অস্ত্রের কোপ দিয়েছে। তবে ফারুক মেম্বারের ভয়ে এলাকার লোকজন প্রকাশ্যে মুখ খুলছে না।
হামলার ঘটনায় আজ শনিবার জৈন্তাপুর থানায় মামলা হয়েছে। পুলিশ এখনো কাউকে ধরতে পারেনি।
এর আগে গতকাল শুক্রবার জুমার নামাজের পর হামলার ঘটনা ঘটে। মামলার অন্যতম আসামি ইউপি সদস্য ফারুক আহমদের ভাই ছালেহ আহমদ ও ভাতিজা পারভেজ বিদেশে পালানোর চেষ্টা করছেন বলে অভিযোগ পাওয়া গেছে।
পুলিশ ও স্থানীয় সূত্রে জানা যায়, গত ১৩ জুন রাতে সড়ক দুর্ঘটনায় মারা যান সিলেট গ্যাস ফিল্ডের কর্মকর্তা মঈনুল হোসেন আয়ানী। দুর্ঘটনার পর পরিবারের লোকজন আইনি প্রক্রিয়া মেনে ময়নাতদন্ত ছাড়াই লাশ দাফন করেন। গ্যাস ফিল্ডের কর্মকর্তার মৃত্যু নিয়ে পরিবারের পক্ষ থেকে এখনো কারও বিরুদ্ধে কোনো অভিযোগ করা হয়নি।
ব্যর্থ হয়ে নানাভাবে ভয়ভীতি দেখিয়ে তাহের আলীর পরিবারের লোকজনকে বাড়িছাড়া করে তাঁর মালিকানাধীন একটি স’মিল ও দুটি ফার্নিচারের দোকানে তালা দেন। গত ২১ জুন ফারুক আহমদ স্থানীয় মসজিদে জুমার নামাজের পর বৈঠক ডাকেন। ওই বৈঠকে মঈনুল হোসেনের মৃত্যুর জন্য তাহের আলীর পরিবারকে দায়ী তাঁদের সমাজচ্যুত করেন। তাহের আলীর ছেলের বন্ধু ইউসুফকে ধরে এনে জিজ্ঞাসাবাদও করা হয়। এরপর দাবি করা হয়, ইউসুফের বক্তব্যে মঈনুল হোসেনকে পরিকল্পিতভাবে হত্যা করা হয়েছে বলে উঠে এসেছে।
তবে এ ব্যাপারে ইউসুফ বা নিহত মঈনুলের পরিবারের কেউ মুখ খুলছেন না।
তাহের আলীর অভিযোগ, ওই বৈঠকে ফারুক মেম্বার ঘোষণা দেন, এলাকার কেউ তাঁর পরিবারের কোনো সদস্যের সঙ্গে কথা বললে ৫০ হাজার টাকা জরিমানা এবং কোনো ব্যবসায়ী সদাইপাতি বিক্রি করলে ৫ হাজার টাকা জরিমানা দিতে হবে। এসব ঘটনায় গত ২৩ জুন তাহের আলী উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা (ইউএনও) ও উপজেলা পরিষদের চেয়ারম্যান বরাবর লিখিত অভিযোগ দেন। একই দিন মামলা দিতে গেলে থানা–পুলিশ ফিরিয়ে দেয়।
আজ মামলায় তাহের আলী অভিযোগ করেন, গতকাল শুক্রবার জুমার নামাজের পর ফারুক মেম্বার উমনপুর কেন্দ্রীয় জামে মসজিদে বৈঠক ডাকেন। ফারুক মেম্বার ওই বৈঠকে অন্যায়ভাবে তাহের আলীর পরিবারকে সাড়ে ৫ লাখ টাকা জরিমানা করেন। ভয়ে তিনি ৫০ হাজার টাকা পরিশোধ করে বাকি টাকা দেওয়ার জন্য সময় চান। কিন্তু ফারুক মেম্বার উত্তেজিত হয়ে মসজিদের মাইকে ঘোষণা দিয়ে তাঁর লোকজন নিয়ে বাড়িতে হামলা চালান। হামলায় তাহের আলী ও তাঁর ভাইদের কয়েকটি বসতঘর ভাঙচুর করে ঘরের ভেতরে আসবাবপত্র ও মোটরসাইকেলে আগুন ধরিয়ে দেওয়া হয়। পরিবারের নারী সদস্যদের মারধরের পাশাপাশি শ্লীলতাহানি এবং ঘর থেকে নগদ অর্থ ও স্বর্ণালংকার লুট করা হয়। হামলা থেকে দুই বছরের শিশু ও অন্তঃসত্ত্বা নারীও বাদ যায়নি। রিহান নামের দুই বছরের শিশুর মাথায় দা দিয়ে কোপ দিয়েছে হামলাকারীরা। এ ছাড়া হামলায় ৭ শিশু ও ৭ নারীসহ অন্তত ২০ জন আহত হয়েছেন।
এ বিষয়ে অভিযুক্ত ইউপি সদস্য ফারুক আহমদের বক্তব্য জানতে একাধিকবার কল করা হলেও তিনি রিসিভ করেননি। এসএমএস পাঠিয়েও সাড়া মেলেনি।
তবে গত ২৩ জুন লিখিত জানানোর বিষয়টি অস্বীকার করেছেন জৈন্তাপুরের ইউএনও উম্মে সালিক রুমাইয়া। তিনি আজকের পত্রিকাকে বলেন, ‘ঘটনার সূত্রপাত গ্যাস ফিল্ডের কর্মকর্তার মৃত্যুর পর থেকেই। তখন মৃত্যুর ঘটনাটি দুর্ঘটনা নয়, অন্য কিছু হতে পারে— এমন অনেকেই বলেছিল। কিন্তু ওনার (নিহত মঈনুল) পরিবারের কেউ মামলা বা কোনো অভিযোগ দেয়নি। যেকারণে ওসিরও কিছু করার সুযোগ ছিল না। সেটা নিয়ে গতকাল যে তাঁরা (মেম্বার) সালিস করবে এটা আমরা জানতাম না। পরে যখন সালিস কন্ট্রোল করতে পারে নাই। তখন বাইরে থেকে আমার কাছে খবর আসে।’
তবে উপজেলা চেয়ারম্যান লিয়াকত আলী ২৩ জুন তাহের আলীর লিখিত অভিযোগ পাওয়ার বিষয়টি স্বীকার করে জানান, তিনি ইউপি চেয়ারম্যানকে ঘটনাটি দেখার জন্য বলেছিলেন।
টিকনাগুল ইউনয়ন পরিষদের চেয়ারম্যান মো. কামরুজ্জামান চৌধুরী বলেন, এ রকম কিছু তাঁকে জানানো হয়নি। তবে কয়েক দিন আগে তাহের আলীর পরিবার যোগাযোগ করলে তিনি বলেছিলেন, ‘গ্রামবাসী ডাকলে আপনারা চিন্তাভাবনা করে সিদ্ধান্ত নেন। (সালিসে) যাবেন কিনা এটা আপনাদের বিষয়।’
আরও খবর পড়ুন: