ফিলিপাইনের জলাভূমি অঞ্চলে বাস মানোবো আদিবাসীদের। প্রতিবছর কয়েক ডজন ঝড়-বন্যার মুখোমুখি হয় তারা। কিন্তু দক্ষতার সঙ্গে এ ধরনের প্রাকৃতিক বিপর্যয়গুলো সামলেও নেয়। কিন্তু কী কৌশল ব্যবহার করে সফল হচ্ছে মানোবোরা? এখান থেকে কী অন্যদেরও শেখার কিছু আছে? ব্রিটিশ সংবাদমাধ্যম বিবিসির এক প্রতিবেদন অবলম্বনে এসব প্রশ্নের উত্তর খোঁজা হয়েছে এ লেখাটিতে।
দক্ষিণ ফিলিপাইনের মানোবো আদিবাসীদের একজন দলনেত্রী মারিতেস বাবানতোর মনের পর্দায় এখনো উজ্জ্বল ২০১২ সালে তাঁদের গ্রামে আঘাত হানা টাইফুনের স্মৃতি।
নদী, হ্রদ আর জলা নিয়ে গঠিত আগুসান মার্শল্যান্ডে বাবানতো এবং তাঁর সম্প্রদায়ের লোকেদের বাস। ওই সময় প্রবল বৃষ্টিতে জলাভূমির পানির উচ্চতা বেড়ে যায় ১০ মিটার (৩৩ ফুট)। অর্থাৎ একটি তিনতলা দালানের সমান। তবে গ্রামবাসীর বাড়িগুলো এই পরিস্থিতিতেও জলের ওপর ভেসে থাকে। প্রাচীন পন্থাই তাদের বাঁচিয়ে দিল ডুবে যাওয়া থেকে।
‘আমাদের সম্প্রদায়ের লোকেরা কখনো এমন ঝড় দেখিনি। বাতাসের গর্জন ছিল প্রচণ্ড। ঘণ্টার পর ঘণ্টা তুমুল বৃষ্টি হচ্ছিল। বেশি নিরাপত্তার আশায় সবাইকে ভাসমান হলের মধ্যে জড়ো করেছিলাম আমরা।’ বলেন মারিতেস বাবানতো।
মানোবোদের ভাসমান বাড়িসহ অন্য উদ্ভাবন এবং অনুশীলন তাদের ডাঙা ও জলের রাজ্যের মিশ্রণে গড়ে ওঠা আশ্চর্য এক অঞ্চলে বাস করতে সহায়তা করে। গবেষকদের এর প্রতি আগ্রহ ক্রমেই বাড়ছে। অন্য সম্প্রদায়ের জন্যও বৈরী আবহাওয়ায় মানিয়ে নিতে এবং এর জন্য প্রস্তুতি নিতে এটা গুরুত্বপূর্ণ পাঠ হিসেবে কাজ করবে বলে মনে করেন তাঁরা।
বাবানতোর দিন শুরু হয় বারোতো নামে পরিচিত তাদের ঐতিহ্যবাহী ক্যানু বা নৌকা নিয়ে যাত্রার মাধ্যমে। একটার পর একটা বাড়ি, আদিবাসীদের একত্রিত হওয়ার হল, স্কুল, উপাসনালয়, পশুর খোঁয়াড়কে পাশ কাটিয়ে নৌকা চালান তিনি। আর তার পেরিয়ে আসা প্রতিটি কাঠামোই ভাসমান। নৌকাতে চেপেই নিজের হাঁস, মুরগি ও শূকরের ছোট খোঁয়াড়গুলোয় যান খাবার দিতে। ভাগনে ও ভাগনিদের তাঁদের ছোট ছোট বারাতোতে চাপিয়ে পাঠান স্কুলে।
এ ধরনের জলা জায়গায় বসবাস করা সম্প্রদায়ের মানুষের জন্য বন্যা একটি অতি স্বাভাবিক ঘটনা। বৃষ্টির মৌসুমে ডিসেম্বর থেকে মার্চ পর্যন্ত পানির উচ্চতা যায় বেড়ে। এদিকে শুকনো মৌসুমে পানির উচ্চতা কমে যায়। পানির এই ওঠানামার সঙ্গে খাপ খাইয়ে নিতে বাঁশ ও কাঠ দিয়ে বানানো ভেলার মতো প্ল্যাটফর্ম বা মঞ্চের ওপর নিজেদের একতলা বা দোতলা ঘরগুলো তৈরি করে মানোবোরা। এই মঞ্চগুলো ভেসে থাকে, সেই সূত্রে ভেসে থাকে ঘরগুলিও।
বাবানতো জানান, নিয়মিত বন্যার চেয়ে বরং ক্রমেই বাড়তে থাকা বাতাসের গতি নিয়ে বেশি আতঙ্কে থাকেন। বন্যার একটি উপকারও তাঁর চোখে পড়ে, ‘পানি যত বেশি থাকে, তত বেশি মাছ আমরা ধরতে পারি।’
বিজ্ঞানীরা সতর্ক করেছেন, জলবায়ু পরিবর্তন ঝড় ও বন্যাকে আরও তীব্র, শক্তিশালী এবং নিয়মিত ঘটনায় পরিণত করেছে। সে ক্ষেত্রে ভাসমান বাড়ির সম্ভাব্য সুবিধাগুলো এগুলোর উদ্ভাবক সম্প্রদায়টির বাইরে অন্যদেরও মনোযোগ আকর্ষণ করছে। এমন ভাসমান বাড়ি বন্যা এবং সমুদ্রপৃষ্ঠের উচ্চতা বৃদ্ধির কারণে ফিলিপাইন ও ইন্দোনেশিয়ার মতো দ্বীপদেশগুলোতে হুমকির মুখে থাকা শহরের বাসিন্দাদের জন্য একটি সম্ভাব্য সমাধান হিসেবে বিবেচিত হচ্ছে।
ফিলিপাইনের দ্বিতীয় বৃহত্তম দ্বীপ মিন্দানাওয়ের কেন্দ্রে জলাভূমি, পিটল্যান্ড ও ৫৯টি হ্রদের সমন্বয়ে ১৪ হাজার ৮০০ হেক্টরের আগুসান মার্শল্যান্ড বন্য প্রাণী অভয়ারণ্যের অবস্থান। আর এখানে বাস ভাসমান এই বসতির।
মানোবো এবং জলাভূমির অন্য স্থানীয় সম্প্রদায়ের কাছে মাছ ধরা হলো জীবিকার প্রধান উৎস। এখানকার বাস্তুতন্ত্র এবং এতে তাদের নিজস্ব জায়গাকে সম্মান জানানো আধ্যাত্মিক ও সাংস্কৃতিক অনুশীলনও এর সঙ্গে জড়িত। তারা গান ও প্রার্থনার মাধ্যমে তাদের চারপাশের জলাভূমির প্রাণীদের প্রতি শ্রদ্ধা প্রকাশ করে।
তাদের বাড়িঘর ঝড় ও বন্যা প্রতিরোধ করলেও মানোবোরা বৈশ্বিক উষ্ণায়নের বিস্তৃত পরিণতির বাইরে নয়। গবেষকেরা দীর্ঘায়িত খরার মতো হুমকির কথা বলেছেন। যেমন পাম তেলের চাহিদার কারণে পিটল্যান্ডগুলো (গাছপালা পচে মাটির সঙ্গে মিশে যে গাঢ় বাদামি জমি তৈরি হয়) বাগানে পরিণত হয়েছে। কাঠ চোরাচালান বিপন্ন এবং স্থানীয় গাছকে হুমকির সম্মুখীন করছে।
সাম্প্রতিক সময়ে মানোবোরা, যাদের গোটা অস্তিত্ব পানির ওপর নির্ভরশীল, আরেকটি হুমকির মুখে পড়েছে। সেটি বছরের কখনো কখনো পানির স্বল্পতা।
উচ্চ তাপের কারণে সৃষ্ট খরায় আশপাশের ভাসমান আবাসস্থল এবং মূলভূমির বিভিন্ন বাজার, খামার ও শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে জলপথে চলাচলে সমস্যায় পড়ছে।
আগুসান জলাভূমির পানলাবুহাস হ্রদের মানাবো বসতির ২৫ বছরের বেশি সময় ধরে গোত্রপ্রধানের দায়িত্ব পালন করছেন দাতু বয়েস রেয়েজ। তিনি মানোবো ছাড়া অন্যদেরও প্রাকৃতিক সম্পদ ব্যবহারে যত্নবান হওয়ার এবং এটি আদিবাসী সম্প্রদায়গুলোর ওপর কী ধরনের প্রভাব ফেলে তা উপলব্ধির চেষ্টা করার অনুরোধ জানিয়েছেন।
তিনি মনে করিয়ে দেন, অন্যরা যে ঘরগুলো তৈরি করে তা এখনো একই মাটি, গাছ ও জল থেকে আসে। ‘যদি আমরা পানিকে রক্ষা করার উপায় খুঁজে বের করি, তাহলে এটিও আমাদের সাহায্য করার উপায় খুঁজে নেবে। এটিই এর প্রকৃতি।’ বলেন তিনি, ‘কারণ জলাভূমিটির নামের অর্থ এটাই, আগুসান মানে যেখানে জল প্রবাহিত হয়।’