হোম > ইসলাম

জাকাতের গুরুত্ব ও বণ্টনব্যবস্থা

রায়হান রাশেদ

জাকাত ইসলামের ফরজ ইবাদত ও মূল স্তম্ভ। কোরআনের ১৯টি সুরায় ৩২ বার জাকাতের কথা এসেছে। ইসলামে নামাজের পরেই জাকাতের প্রতি সবচেয়ে বেশি গুরুত্ব দেওয়া হয়েছে। ধনীর অর্থবৈভবে গরিবের অধিকার নিশ্চিত করে জাকাত। ধনী-গরিবের মধ্যে তৈরি করে সম্প্রীতির সেতুবন্ধ। সমাজে তৈরি করে সাম্যের চিত্র। হাসি ফোটে গরিবের মুখে। জাকাত সম্পদকে পবিত্র করে। পরিচ্ছন্ন করে ব্যক্তির মনন। অন্তরের কলুষ দূর করে তাকে মহীয়ান করে সমাজে, পৃথিবীতে এবং আখেরাতে। জাকাত শব্দটিই পবিত্রতার পাঠ দেয়। জাকাত অর্থ পবিত্রতা, ক্রমবৃদ্ধি ইত্যাদি। সম্পদশালী মুসলিম নর-নারীর সম্পদ থেকে আল্লাহর সন্তুষ্টির জন্য উপযুক্ত ব্যক্তিকে সম্পদের আড়াই শতাংশ দেওয়ার নাম জাকাত। 

জাকাত আদায়ের গুরুত্ব
জাকাতকে পবিত্রতার মাধ্যম ঘোষণা করে আল্লাহ বলেন, ‘তাদের ধনসম্পদ থেকে সদকা গ্রহণ করো, যার সাহায্যে তুমি তাদের গুনাহমুক্ত করবে এবং তাদের পবিত্র করে দেবে।’ (সুরা তওবা: ১০৩) অন্য আয়াতে বলেন, ‘তোমরা নামাজ কায়েম কোরো, জাকাত দাও এবং রুকুকারীদের সঙ্গে রুকু কোরো।’ (সুরা বাকারা: ৪৩) 

জাকাত আদায় না করাকে মুশরিকদের বৈশিষ্ট্য ঘোষণা করে আল্লাহ বলেছেন, ‘যেসব মুশরিক জাকাত দেয় না, যারা আখিরাতকে অস্বীকার করে, তাদের ধ্বংস অনিবার্য।’ (সুরা হামিম সাজদা: ৬-৭) 

যাদের ওপর জাকাত ফরজ
মুসলমান, স্বাধীন, সুস্থ মস্তিষ্ক, প্রাপ্তবয়স্ক, ঋণের অতিরিক্ত নিসাব পরিমাণ সম্পদের মালিকের ওপর জাকাত ফরজ। সাড়ে সাত ভরি (৮৭ দশমিক ৪৫ গ্রাম) সোনা বা সাড়ে বায়ান্ন ভরি (৬১২ দশমিক ১৫ গ্রাম) রুপা বা সমমূল্যের নগদ অর্থ, বন্ড, সঞ্চয়পত্র, শেয়ার, ব্যাংকে জমাকৃত যেকোনো ধরনের টাকা, ফিক্সড ডিপোজিট হলে মূল জমা টাকা অথবা সমমূল্যের ব্যবসার পণ্য থাকলে জাকাত আদায় করতে হবে। আয়কৃত সম্পদের ওপর এক বছর অতিবাহিত হওয়া জরুরি। এসব সম্পদ বর্ধনশীল হওয়া শর্ত। 

যেসব সম্পদে জাকাত দিতে হয়

  • সোনা-রুপা, টাকাপয়সা, পালিত পশু (নির্ধারিত নিয়ম অনুযায়ী) এবং ব্যবসার পণ্যে জাকাত ফরজ হয়। (আবু দাউদ: ১/২৫৫)
  • মৌলিক প্রয়োজন থেকে উদ্বৃত্ত টাকাপয়সা নিসাব পরিমাণ হলে জাকাত ফরজ। (মুসান্নাফে আবদুর রাজ্জাক: ৭০৯১)
  • টাকাপয়সা ব্যবসায় না খাটিয়ে এমনি রেখে দিলেও তাতে জাকাত আসে। (আদ্দুররুল মুখতার: ২/২৬৭)
  • সঞ্চিত অর্থ পৃথকভাবে কিংবা অন্যান্য জাকাতযোগ্য সম্পদের সঙ্গে যুক্ত হয়ে নিসাব পরিমাণ হলে জাকাত দিতে হবে। (মুসান্নাফে আবদুর রাজ্জাক: ৭০৩২)
  • ব্যবসার উদ্দেশ্যে দোকানে রাখা পণ্য। (আবু দাউদ: ১/২১৮)
  • ব্যবসার নিয়তে কোনো কিছু ক্রয় করলে তা স্থাবর সম্পত্তি যেমন—জমি, ফ্ল্যাট কিংবা অস্থাবর সম্পত্তি যেমন—মুদি সামগ্রী, কাপড়, অলংকার, নির্মাণসামগ্রী, গাড়ি, ফার্নিচার, ইলেকট্রনিকস সামগ্রী, হার্ডওয়্যার সামগ্রী, বইপুস্তক ইত্যাদি বাণিজ্যদ্রব্য বলে গণ্য হবে এবং মূল্য নিসাব পরিমাণ হলে জাকাত দেওয়া ফরজ হবে। (মুসান্নাফে আবদুর রাজ্জাক: ৭১০৩)
  • নিসাবের অতিরিক্ত সোনা-রুপা, টাকাপয়সা ও বাণিজ্যদ্রব্যের জাকাত আনুপাতিক হারে দিতে হবে। (মুসান্নাফে আবদুর রাজ্জাক: ৭০৩২-৭০৭৪) 
  • আগের সম্পদের সঙ্গে বছরের মাঝে সম্পদ পাওয়া গেলে নতুন প্রাপ্ত সম্পদ পুরোনো সম্পদের সঙ্গে যোগ হবে এবং পুরোনো সম্পদের বছর পূর্ণ হওয়ার পর সমুদয় সম্পদের জাকাত দিতে হবে। (মুসান্নাফে আবদুর রাজ্জাক: ৬৮৭২) 

যাদের জাকাত দেওয়া যাবে

  • আল্লাহ তাআলা সুরা তওবার ৬০ নম্বর আয়াতে যাদের জাকাত দেওয়া যাবে, তাদের নাম উল্লেখ করেছেন। যথা—
  • গরিব—যার নিসাব পরিমাণ সম্পদ নেই।
  • মিসকিন—যার মালিকানায় কোনো সম্পদ নেই।
  • ইসলামি সরকারের পক্ষ থেকে জাকাত সংগ্রহে নিয়োজিত ব্যক্তি
  • ইসলামের দিকে চিত্ত আকর্ষণের জন্য জাকাত দেওয়া। এই খাত সাহাবায়ে কিরামের ইজমায় রহিত হয়ে যায়। 
  • ঋণগ্রস্ত ব্যক্তি।
  • নির্দিষ্ট পরিমাণ সম্পদের বিনিময়ে স্বাধীন হওয়ার চুক্তিতে আবদ্ধ দাস-দাসী। 
  • আল্লাহর পথে থাকলে।
  • মুসাফির—সফর অবস্থায়  অভাবগ্রস্ত মানুষ। যাদের জাকাত দেওয়া উত্তম 
  • জাকাতের হকদার দ্বীনি জ্ঞান চর্চাকারী ছাত্র ও শিক্ষক।
  • আত্মীয়স্বজন।
  • বন্ধুবান্ধব ও প্রতিবেশী। 
  • তারপর জাকাতের অন্যান্য হকদার।

যে খাতে জাকাত দেওয়া যায় না

  • যার কাছে নিসাব পরিমাণ অর্থ-সম্পদ আছে। 
  • সাইয়েদ অর্থাৎ যারা রাসুল (সা.)-এর বংশধর। 
  • জাকাতদাতার মা-বাবা, দাদা-দাদি, পরদাদা-পরদাদি, পরনানা, পরনানি ইত্যাদি ওপরের সিঁড়ি। 
  • জাকাতদাতার সন্তান, নাতি, নাতির ছেলে ইত্যাদি নিচের সিঁড়ি। 
  • জাকাতদাতার স্বামী বা স্ত্রী। 
  • অমুসলিম। 
  • সম্পদশালী লোকের নাবালক সন্তান। 
  • মসজিদ, মাদ্রাসা বা স্কুল, কলেজ, হাসপাতাল প্রভৃতি নির্মাণকাজের জন্য। 
  • মৃত ব্যক্তির দাফন-কাফনের জন্য বা মৃত ব্যক্তির ঋণ ইত্যাদি আদায়ের জন্য। 
  • রাস্তাঘাট, পুল ইত্যাদি নির্মাণ ও স্থাপন কাজে যেখানে নির্দিষ্ট কাউকে মালিক বানানো হয় না। 

জাকাত দেওয়ার আদব
জাকাত যেহেতু ধনীর সম্পদে গরিবের অধিকার, তাই গরিবের কাছে নিজ দায়িত্বে জাকাত পৌঁছে দেওয়া ইমানি দায়িত্ব। গরিবকে ডেকে এনে কষ্ট দেওয়া গুনাহের কাজ। জাকাত আনতে গিয়ে তারা মৃত্যুর মুখে পড়েছে—এমন ঘটনাও ঘটেছে দেশে। সবাই যদি জাকাত ফরজ হওয়ার নির্ধারিত সময়ে আদায় করে, তাহলে গরিব-অসহায়ের বড় কল্যাণ হবে। কারণ সারা বছরই কারও না কারও ওপর জাকাত ফরজ হয়। 
একজনকে কতটুকু জাকাত দিতে হয়

জাকাত দিয়ে ব্যক্তিকে স্বাবলম্বী করা উত্তম। ৫০০ বা হাজার টাকায় কারও অভাব দূর হয় না। অল্প টাকায় স্বাবলম্বী হওয়া যায় না। সমাজে এমন বহু লোক আছে, যারা ১৫ থেকে ২০ বছর ধরে জাকাত গ্রহণ করছে। তাদের অবস্থার পরিবর্তন হচ্ছে না। কারণ, তাদের অল্প পরিমাণ দেওয়া হচ্ছে। সে ক্ষেত্রে যদি তাদের দক্ষতার ওপর ভিত্তি করে বা তাদের সঙ্গে আলাপ করে দোকান, ব্যবসা, নৌকা, অটোরিকশা বা সেলাই মেশিন কিনে দেওয়া যায়, তাহলে জাকাতের ভালো সুফল পাওয়া যাবে। সমাজে জাকাতগ্রহীতার সংখ্যা কমবে। সেদিনের জাকাতগ্রহীতা একদিন জাকাত দেবে। 

লেখক: ইসলামবিষয়ক গবেষক

হালাল-হারাম নিয়ে সংশয় থাকলে করণীয়

আসরের নামাজ যে কারণে গুরুত্বপূর্ণ

কোরআন জীবনের অপরিহার্য অনুষঙ্গ

রমজানের প্রস্তুতি শুরু হোক এখনই

মুসলিম ঐতিহ্যে টুপির গুরুত্ব

ব্যবসা-বাণিজ্যে নিষিদ্ধ ৮ কাজ

নামাজে সতর ঢাকা সম্পর্কে সতর্কতা

সীমান্ত পাহারা দেওয়া শ্রেষ্ঠতম ইবাদত

কবরে যে ২ গুনাহের শাস্তি দেওয়া হবে

মুমিনের চমৎকার ৪ চারিত্রিক বৈশিষ্ট্য

সেকশন