অধ্যাপক আনু মুহাম্মদ বলেছেন, ‘গণ-অভ্যুত্থানের সময় দেয়ালের গ্রাফিতিতে যে আকাঙ্ক্ষার কথা প্রকাশ করা হয়েছে, তার সঙ্গে যাঁরা সরকারে বসেছেন বা তাঁদের ঘনিষ্ঠদের চিন্তায় সেটা নেই। তাঁদের মধ্যে বৈষম্যবাদী রাজনীতি, সংস্কৃতি দেখতে পাচ্ছি। অন্যান্য জনগোষ্ঠীকে সম্পূর্ণভাবে অগ্রাহ্য করার প্রবণতা দেখতে পাচ্ছি।’
আজ শুক্রবার বিকেলে রাজধানীর শাহবাগে জাতীয় জাদুঘরের সামনে গণতান্ত্রিক অধিকার কমিটি আয়োজিত ‘আদিবাসী শিক্ষার্থীদের ওপর সন্ত্রাসী হামলা ও সংক্ষুব্ধ ছাত্র-জনতার ওপর পুলিশি হামলার বিরুদ্ধে প্রতিবাদ সমাবেশে’ তিনি এসব কথা বলেন।
আনু মুহাম্মদ বলেন, ‘শেখ হাসিনা সরকার যখন নির্বিচার হত্যাকাণ্ড চালিয়েছে, সে সময় ঢাকাসহ বিভিন্ন শহরে কিশোর-তরুণ ছেলেমেয়েরা কাঁচা হাতে, কেউ দক্ষ হাতে দেয়ালে অনেক গ্রাফিতি তৈরি করেছে, ছবি এঁকেছে, অনেক কথা লিখেছে। সেই ছবি ও কথার মধ্যে আকাঙ্ক্ষা ও প্রত্যাশা তৈরি হয়েছে। সেখানে যে চিন্তাটা প্রধান হয়েছে, আমরা এমন একটা বাংলাদেশ চাই, যেখানে স্বৈরশাসক, নির্যাতন থাকবে না। মানুষের যে অধিকার, প্রয়োজন, আকাঙ্ক্ষা এবং তাঁদের জীবন, সেটার একটা পরিবর্তন ঘটবে। এতে প্রকাশিত হয়েছে, বৈচিত্র্য আছে। বিভিন্ন ধর্মের, ভাষার মানুষ আছে—তাঁদের সবার অধিকার থাকবে এবং সবাই মিলেই বাংলাদেশকে বৈষম্যহীন, আধিপত্য ও নিপীড়নবিরোধী রাষ্ট্র গড়ে তোলা। কিন্তু কিছুদিনের মধ্যেই হতাশার সঙ্গে লক্ষ করলাম, বর্তমান সরকারের সময় শ্রমিক আন্দোলনসহ বিভিন্ন সময় নারীবিদ্বেষী তৎপরতা ও বিভিন্ন ভাষার মানুষের ওপর নির্যাতন হচ্ছে। এরই ধারাবাহিকতায় গত দুই দিনে হামলা হয়েছে বলে জানান আনু মুহাম্মদ।
যেই গ্রাফিতিটা পাঠ্যবইয়ে আনা হয়েছিল, সেটা গণ-অভ্যুত্থানের গ্রাফিতি ছিল জানিয়ে তিনি বলেন, ‘গণ-অভ্যুত্থানের একটা চিত্র হিসেবে এটা দেওয়া হয়েছিল। কিন্তু সেটা বাদ দেওয়া হলো আদিবাসী শব্দটা থাকার কারণে। আদিবাসী শব্দ নিয়ে অনেক ভুল-বোঝাবুঝি, বিভ্রান্তি আছে। আবার একটা রাজনীতি, দমনপীড়ন ও আধিপত্যের জাল আছে।’
আদিবাসী মানে আদি বাসিন্দা নয়—জানিয়ে আনু মুহাম্মদ বলেন, ‘আদিবাসী যেখানেই থাকুক, তিনি আদিবাসী। তাঁর নিজস্ব একটা সংস্কৃতি, ইতিহাস, ঐতিহ্য ও আইনি কাঠামো আছে। আলাদা একটা জাতিগত বৈশিষ্ট্য আছে। সেটা বাংলাদেশের মানুষ স্বীকার করে। পার্বত্য চট্টগ্রামে সমস্যা হয়েছে শেখ মুজিব থেকে। যাঁরা বলছেন, শেখ মুজিব ফ্যাসিবাদী শাসনের সূচনা করেছেন, সেই ফ্যাসিবাদের অন্যতম উপাদান হলো অন্যান্য জাতিকে অস্বীকার করা। এটা পরবর্তী সময়ে আওয়ামী লীগ যখন বিরোধী দলে ছিল, তখন আদিবাসী বলত। কিন্তু ২০০৯ সালে যখন ক্ষমতায় এল, তখন হঠাৎ করেই বলল, আদিবাসী ব্যবহার করা যাবে না। তার মানে হচ্ছে, রাষ্ট্রক্ষমতার সঙ্গে আদিবাসী এ ধারণাকে অস্বীকার করার একটা রাজনৈতিক সম্পর্ক আছে। ফলে যাঁরা ক্ষমতায় যান, তাঁরা অস্বীকার করতে চান। তাঁদের একটা যুক্তি, আদিবাসী বলে স্বীকার করলে বাংলাদেশ থেকে আলাদা হয়ে যাবে। অথচ যাদের বিরুদ্ধে এই অভিযোগ, তারা বারবার বলছে, আমরা বিচ্ছিন্ন হতে চাই না। আমরা বাংলাদেশের নাগরিক, বাংলাদেশে থাকতে চাই।’
আদিবাসীদের ওপর নিপীড়নের বিরুদ্ধে প্রতিটি সচেতন মানুষের নাগরিক দায়িত্ব বলে উল্লেখ করেন অধ্যাপক আনু মুহাম্মদ। তিনি বলেন, ‘মানুষ তাঁর নাগরিক অধিকার নিয়ে চলাফেরা করবেন, কেন সব সময় ভয়ে ভয়ে চলতে হবে, গণতান্ত্রিক পরিবেশ ও প্রতিষ্ঠান যাতে তৈরি হয়, সেটাই হওয়া উচিত। অন্তর্বর্তী সরকারের এটা দায়িত্ব ছিল, যেন এই অবস্থার পরিবর্তন হয়। কিন্তু পার্বত্য অঞ্চলে এখনো আগের অবস্থা বিরাজ করছে।’
আদিবাসী শব্দ বাদ দেওয়ার বিষয়ে তিনি বলেন, ‘আদিবাসী শব্দ নিয়ে আপত্তি থাকলে সেটা নিয়ে আলোচনা করতে পারেন। তাদের ডেকে একসঙ্গে বসতে পারতেন। কিন্তু কোনো আলোচনা নেই। তারা প্রতিবাদ করল আর একটা গোষ্ঠী তাদের ওপর সন্ত্রাসী হামলা করল। আর সরকারকে দেখা যাচ্ছে, তাদের বিষয়ে খুবই নমনীয়। আবার সেটার বিষয়ে যখন আপত্তি জানাল, প্রতিবাদ করল আগের মতোই পুলিশ চড়াও হলো। এর দায়দায়িত্ব সরকারের ওপরেই বর্তায়। এটি নিয়ে আমরা উদ্বিগ্ন এবং প্রতিবাদ জানাতে বাধ্য হচ্ছি। যদিও আমরা দেখতে পাচ্ছি, বলা হচ্ছে এ সরকার গণ-অভ্যুত্থানের সরকার, তাঁদের সমালোচনা করা মানে যাঁরা সমালোচনা করেন, তাঁরা ফ্যাসিবাদের দোসর। এটা যাঁরা বলেন, তাঁরাই ফ্যাসিবাদ বা আওয়ামী লীগের প্রত্যাবর্তনের ব্যবস্থা করবেন।’
হঠাৎ কারও সঙ্গে আলোচনা না করে, জনগণের সুবিধা-অসুবিধার কথা না ভেবে ভ্যাট নামক একটা জিনিস জনগণের ওপর চাপিয়ে দেওয়া হয়েছে বলেও মনে করেন অর্থনীতিবিদ আনু মুহাম্মদ। তিনি বলেন, ‘গত পাঁচ মাসে জিনিসপত্রের দামের কোনো উন্নতি হয়নি। শ্রমিক ও মধ্যবিত্ত মানুষের আয় কমে গেছে। ডলার ও টাকার বিনিময় হারের তারতম্যের কারণে নানা অর্থনৈতিক সংকট সৃষ্টি হচ্ছে। জনগণের ওপর বোঝা তৈরি হচ্ছে। মূল্যস্ফীতি কমার কোনো লক্ষণ দেখা যাচ্ছে না। যাঁরা এমন করেছেন, তাঁদের বিরুদ্ধে সরকার কিছু করতে পারেনি বা সরকারের কোনো ইচ্ছা আছে বলেও মনে হয় না। তাঁরা আগের মতোই বলেন, রাতারাতি কিছুই করা সম্ভব নয়। কিন্তু আপনাদের তো লক্ষণ দেখা যাবে, কোন পথে হাঁটছেন।’
ইচ্ছেমতো ভ্যাট বসাচ্ছে। সরকার কোনো গণতান্ত্রিক প্রক্রিয়ায় হাঁটছে না। এ প্রক্রিয়ায় চলতে পারে না বলে মনে করেন আনু মুহাম্মদ।
জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের অর্থনীতি বিভাগের শিক্ষক মাহা মির্জা বলেন, ‘শিক্ষার্থীদের ওপর হামলা, একের পর এক গণবিরোধী কাজ করছে ইউনূস সরকার। আবার সরকার আশা করছে, আমরা তাদের সমর্থন দিয়ে যাব। পাশাপাশি বলা হচ্ছে, গণ-অভ্যুত্থানের সরকারের সমালোচনা বা প্রতিবাদ করা যাবে না।’
গণতান্ত্রিক অধিকার কমিটির সমন্বয়ক রাফিকুজ্জামান ফরিদ বলেন, ‘যে আকাঙ্ক্ষা নিয়ে গণ-অভ্যুত্থান হয়েছে, সেই আকাঙ্ক্ষার সঙ্গে সরকার বেইমানি করেছে। গত ১৫ জুলাই ছাত্রলীগ ক্যাম্পাসে যে হামলা করেছিল, একইভাবে ১৫ জানুয়ারি মতিঝিলে ন্যক্কারজনক হামলা করা হয়েছে। আওয়ামী লীগের শাসনের সময় মুক্তিযুদ্ধ মঞ্চ যেমন লাঠিয়াল বাহিনীর মতো কাজ করেছে, ঠিক একইভাবে বর্তমানে বিভিন্ন ধরনের লাঠিয়াল বাহিনী গড়ে উঠেছে।’
প্রতিবাদ সমাবেশ শেষে মশাল মিছিল করে গণতান্ত্রিক অধিকার কমিটি। মিছিলটি শাহবাগ থেকে কাটাবন, নীলক্ষেত হয়ে টিএসসিতে গিয়ে শেষ হয়। এ সময় জাতিগত বিভাজন রুখে দেবে জনগণ, স্বরাষ্ট্র উপদেষ্টার পদত্যাগ, ভ্যাট আরোপের সিদ্ধান্ত প্রত্যাহারসহ বিভিন্ন স্লোগান দেন তাঁরা।