হোম > জাতীয়

যমের দুয়ার থেকে ফখরুদ্দীনের ফেরা

কামরুল হাসান

কে একজন অফিসের নম্বরে ফোন করে বলেছেন, পিলখানায় খুব গন্ডগোল হচ্ছে। সেটা শুনে টেলিফোন অপারেটর সুফলা আমাকে ফোন দিলেন। মেয়েটির ফোন পেয়ে মনে হলো, পিলখানায় বিডিআরের দরবার হওয়ার কথা। সেখানে কি কোনো ঝামেলা হচ্ছে?

বিডিআরে তখন বেশ কয়েকজন কর্মকর্তা পরিচিত। তাঁদের মধ্যে সিলেটের সেক্টর কমান্ডার গুলজার উদ্দিন আহমেদ আর কুমিল্লার ব্যাটালিয়ন কমান্ডার ফখরুদ্দীন আহমেদের সঙ্গে ঘনিষ্ঠতা অনেক দিনের। প্রথমেই ফোন দিলাম গুলজার উদ্দিনকে। তিনি ফোন ধরলেন না। তাঁর ফোন লাগাতার ব্যস্ত। একটু পর অফিস থেকে আবার মেয়েটির ফোন। বললেন, সেখানে গোলাগুলি শুরু হয়ে গেছে। আশপাশের বাসিন্দারা বারবার পত্রিকা অফিসে ফোন করছেন।

এবার মনে হলো, ঘটনা বড় হয়ে যাচ্ছে। প্রথমে অফিসে কয়েকজন সহকর্মীকে ফোন দিলাম। মনে হলো আর দেরি না করে এখনই বের হওয়া উচিত। দ্রুত তৈরি হয়ে নিচে নামব, এমন সময় হঠাৎ ফোন—গুলজার উদ্দিন ফোন করছেন। ভয়ার্ত কণ্ঠ। বাঘের মতো সাহসী মানুষের এমন কণ্ঠস্বর শুনে আঁতকে উঠলাম। তিনি কথা বলছেন নিচু গলায়, ফিসফিসিয়ে। বললেন, ‘বিদ্রোহী সৈনিকেরা আমাদের ঘিরে ফেলেছে। বাঁচব কি না জানি না। প্লিজ, যাকে পারেন তাকে বলেন।’ শুনে রক্ত হিম হয়ে গেল। কী করব, কাকে ফোন দেব বুঝে উঠতে পারছি না। ফোন দিলাম ডিএমপির তখনকার কমিশনার নাঈম আহমেদকে। তাঁর ফোন ব্যস্ত। র‍্যাবের মহাপরিচালক হাসান মাহমুদ খন্দকারকে ফোন করতেই তিনি বললেন, ঘটনাস্থলের দিকে রওনা হচ্ছেন। ফোন দিলাম তখনকার আইজিপি নূর মোহাম্মদকে। তাঁর গলা কাঁপছে। বললেন, তাঁর সদ্য বিয়ে হওয়া মেয়ে বাঁধন ও জামাতা মাজহার ভেতরে আটকা পড়েছেন। মেয়ে বারবার ফোন করে কাঁদছেন। আইজিপির কণ্ঠে অসহায়ের সুর। মনে হতে লাগল, ভয়ংকর কিছু ঘটতে চলেছে। ছুটলাম পিলখানার দিকে।

ধানমন্ডি ২ নম্বর সড়কের শেষ মাথায় যেখানে আম্বালা ইন নামের একটি হোটেল আছে, সেখানে এসে দেখি, পিলখানার ভেতর থেকে প্রচণ্ড গোলাগুলির আওয়াজ আসছে। কিছু লোক আম্বালার সামনে জড়ো হয়েছে। জিগাতলার গেটে কেউ নেই, কিন্তু ভয়ে কেউ যাচ্ছে না। একটু পরে আম্বালার দিক থেকে কয়েকজন দৌড়ে রাস্তা পার হতে গেলেই কয়েকটি গুলি এসে পড়ে। দুজন আহত হলেন। অল্পের জন্য বেঁচে যান আরও কয়েকজন। একটু পরে একটি পিকআপে করে একদল সৈনিক সেখানে এসে গোলাগুলি শুরু করেন। আমরা বুঝতে পারছি না ভেতরে কী হয়েছে। আবার ফোন দিলাম গুলজার ও ফখরুদ্দীনকে। কিন্তু কেউই আর ফোন ধরছেন না। গুলির শব্দ বেড়েই চলেছে। পিলখানার ভেতর থেকে এসব কানফাটা শব্দ ভেসে আসছে।

খানিক বাদে ফখরুদ্দীনের ফোন। তিনিও ফিসফিস করে কথা বলছেন। বললেন, তাঁর খুব বিপদ, অল্পের জন্য প্রাণে বেঁচে গেছেন। আমি যেন হাজারীবাগের দিকে আসি। ২ নম্বর থেকে বেরিয়ে ধানমন্ডি ৮ নম্বর ব্রিজ ঘুরে এলাম জিগাতলার দিকে, সেখান থেকে হাজারীবাগের দিকে কিছুদূর যেতেই দেখি, একটি দেয়ালের পাশ থেকে বেরিয়ে আসছেন ফখরুদ্দীন। মনে হলো, তিনি সেখানে লুকিয়ে ছিলেন। তাঁর গায়ে জামা নেই, পরনের প্যান্টও ছেঁড়া। ফখরুদ্দীন ভালো করে কথা বলতে পারছেন না, থরথর করে কাঁপছেন। তিনি অনেক ভয় পেয়েছেন। ফখরুদ্দীন কাঁদছিলেন আর বলছিলেন, তিনি অল্পের জন্য প্রাণে বেঁচে গেছেন।

আমি তখনো বুঝতে পারিনি, ভেতরে আসলে কী হয়েছে। ফখরুদ্দীনকে কিছুটা শান্ত করে জানতে চাইলাম, সেখানে আসলেই কী ঘটেছে। ফখরুদ্দীন বললেন, সকাল সাড়ে ৯টার দিকে দরবার শুরু হয়। দরবারে বিডিআর মহাপরিচালক শাকিল আহমেদের বক্তব্য চলাকালে মঞ্চের বাঁ দিকের পেছন থেকে দুজন বিদ্রোহী অতর্কিতে মঞ্চে ঢোকেন। এঁদের একজন ছিলেন সশস্ত্র। এরপর পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণের বাইরে চলে যায়। বাইরে শুরু হয় গোলাগুলি। কিছুক্ষণ এভাবে চলার পর বিদ্রোহী সৈনিকেরা গুলি ছুড়তে ছুড়তে দরবার হলে ঢোকেন এবং কর্মকর্তাদের বের হয়ে আসার নির্দেশ দেন। এ সময় তিনিসহ কয়েকজন বের হয়ে আসেন। বের হওয়ার সময় একজন সৈনিক তাঁকে চিনতে পারেন। সেই সিপাহি বলেন, স্যার, দ্রুত র‍্যাংক খুলে সৈনিকের দলে মিশে যান। প্রাণ বাঁচাতে তিনি তা-ই করেন। পোশাক থেকে কর্মকর্তার র‍্যাংক ছিঁড়ে খুলে ফেলে দৌড় দেন। সোজা চলে আসেন রাইফেলস স্কুলের দিকে। কিন্তু সেখানে এসে দেখেন, শত শত জওয়ান অস্ত্র হাতে কর্মকর্তাদের চেনামাত্র গুলি করছেন। তিনি সিদ্ধান্ত নেন, দ্রুত তাঁকে প্রাচীর টপকে বাইরে যেতে হবে। কিন্তু এত উঁচু প্রাচীর টপকাবেন কী করে! এ সময় তাঁকে সাহায্য করতে এগিয়ে আসেন রাইফেলস স্কুলের এক পিয়ন। তিনি বলেন, স্যার, আমার কাঁধে চড়ে প্রাচীর টপকান। অগত্যা তা-ই করেন। সেই পিয়নের কাঁধে উঠে প্রাচীর থেকে লাফিয়ে পড়েন বাইরে। ফখরুদ্দীন বললেন, তাঁকে এভাবে প্রাচীর টপকাতে দেখে একজন ক্যাপ্টেনও সেই চেষ্টা করেন, কিন্তু তিনি আর বের হতে পারেননি। প্রাচীরের ওপরে ওঠার সঙ্গে সঙ্গে বিদ্রোহী সৈনিকেরা তাঁকে গুলি করেন। গুলি লেগে সেই কর্মকর্তা নিচে পড়ে যান।

জীবন হাতে নিয়ে ফখরুদ্দীন সেদিন ধানমন্ডিতে তাঁর বোনের বাড়িতে চলে যান, কিন্তু গুলজার উদ্দিনকে আর ফোনে পাইনি। অপেক্ষায় থেকেছি, ফোন আর বাজেনি। পরে বিডিআর বিদ্রোহের শিকার ৭৪ জনের সঙ্গে তাঁরও মরদেহ পাওয়া যায়।

ফখরুদ্দীনের সঙ্গে এখনো মাঝেমধ্যে দেখা হয়। সেদিনের কথা তুললেই কেমন যেন জড়সড় হয়ে যান। মনে হয় যমের দুয়ার থেকে ফিরে আসার ভয়াল স্মৃতি এখনো তাঁকে তাড়িয়ে বেড়াচ্ছে।

আরও পড়ুন

তত্ত্বাবধায়ক সরকার ফেরাতে রিভিউ শুনানি ৯ ফেব্রুয়ারি

রাজনীতিতে ঢুকতে চাই না, প্রধান উপদেষ্টার টাইমফ্রেমে কাজ করছি: সিইসি

রাজধানীর অপরাধজগতে নেতা-সন্ত্রাসীতে আঁতাত

ঢাকাকে ভারতের চোখে দেখার সম্ভাবনা কম

নবীন উদ্যোক্তাদের অভিজ্ঞতা শুনলেন প্রধান উপদেষ্টা

প্রিন্সিপাল স্টাফ অফিসারের পাকিস্তান সফর, প্রতিরক্ষা সচিবের সঙ্গে বৈঠক

প্রধান উপদেষ্টার কার্যালয় থেকে সরানো হলো পরিচালক মনিরুজ্জামানকে

গত বছর ৩১০ শিক্ষার্থীর আত্মহত্যা, ৬১ শতাংশই নারী: জরিপ

পাঁচ মাসে মাজার-দরগায় ৪৪ হামলা: প্রেস উইং

বিএফআইইউর সাবেক প্রধান মাসুদ বিশ্বাস গ্রেপ্তার

সেকশন