চলতি বছরের ৮ জানুয়ারি রাজধানীর কামরাঙ্গীরচরের কয়লাঘাট এলাকায় পায়ে পাড়া দেওয়ার মতো তুচ্ছ ঘটনায় সিফাত (১২) নামে এক শিশুকে হত্যা করা হয়। এ ঘটনায় করা মামলার ছয় আসামির সবার বয়স ১০-১৪ বছর। রাজধানীর মুগদায় কিশোর হাসান হত্যাকাণ্ডে জড়িত অভিযোগে গত ১৫ ফেব্রুয়ারি কিশোর গ্যাংয়ের সাত সদস্যকে আটক করে গোয়েন্দা পুলিশ।
এর আগে গত বছরের ৯ অক্টোবর নারায়ণগঞ্জের ফতুল্লায় দুই কিশোর গ্যাংয়ের বিরোধের জেরে নাঈম নামের এক কিশোর খুন হয়। ওই ঘটনায় হৃদয় ও হাবিব নামে দুই কিশোরকে গ্রেপ্তার করে পুলিশ। দুজনেরই বয়স ১৫-১৭ বছরের মধ্যে। মূলত ২০১৭ সালের ৬ জানুয়ারি উত্তরায় আদনান কবির (১৪) হত্যাকাণ্ডের পর কিশোর গ্যাংয়ের সহিংসতা প্রকাশ্যে আসে।
শুধু রাজধানী নয়, দেশের প্রত্যন্ত এলাকায়ও এখন কিশোর গ্যাং সক্রিয়। ছিনতাই, চাঁদাবাজি, ধর্ষণ, মাদক ব্যবসা, হত্যা, মানব পাচারসহ নানা অপরাধে জড়িত অভিযোগে কিশোর গ্যাংয়ের সদস্যরা আটক হচ্ছে।
করোনায় গত দেড় বছর স্কুল-কলেজ বন্ধ থাকায় টিকটক, লাইকিসহ বিভিন্ন গেম এমনকি পর্নোগ্রাফিতে আসক্ত হয়ে নতুন করে গড়ে উঠেছে কিশোর গ্যাং। অনেক কিশোর জড়িয়েছে জঙ্গিবাদে।
কিন্তু অপরাধ যত বড়ই হোক, তাদের কঠোর সাজা দেওয়া যায় না। কারণ, দেশের প্রচলিত আইনে ১৮ বছর পর্যন্ত শিশু হিসেবে গণ্য করা হয়।
গেল ২০১৩ সালের শিশু আইনের ৪ ধারা অনুসারে, ১৮ বছর পর্যন্ত সবাই শিশু হিসেবে গণ্য হবে। ৩৩ (১) ধারামতে, অন্য কোনো আইনে যা কিছুই থাকুক না কেন, কোনো শিশুকে মৃত্যুদণ্ড, যাবজ্জীবন কারাদণ্ড বা কারাদণ্ড দেওয়া যাবে না। আর ৩৪ (১) ধারা অনুযায়ী, কোনো শিশু মৃত্যুদণ্ড বা যাবজ্জীবন কারাদণ্ডে দণ্ডনীয় কোনো অপরাধে দোষী প্রমাণিত হলে শিশু আদালত তাকে অনূর্ধ্ব ১০ বছর এবং অন্যূন তিন বছর মেয়াদে আটকাদেশ দিয়ে শিশু উন্নয়ন কেন্দ্রে আটক রাখার আদেশ দিতে পারবেন।
সম্প্রতি এক অনুষ্ঠানে স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী আসাদুজ্জামান খান কামাল বলেন, শিশু হিসেবে ১৮ বছরের সময়সীমা নিয়ে চিন্তাভাবনার সময় এসেছে। একই অনুষ্ঠানে পুলিশের আইজি বেনজীর আহমেদ বলেন, আইন পরিবর্তনের ফলে এখন পূর্ণ যুবককেও শিশু ধরা হচ্ছে। ফলে কিশোর গ্যাং নিয়ন্ত্রণ করা কঠিন হয়ে পড়ছে।
এ কারণে কিশোরদের বয়সসীমা ১৮ থেকে কমিয়ে সর্বোচ্চ ১৬ করার পরামর্শ দিয়েছেন আইন বিশেষজ্ঞরা। তাঁরা মনে করেন, প্রযুক্তির কারণে আগের তুলনায় এখন ছেলে-মেয়েদের দ্রুত মানসিক বিকাশ হচ্ছে। আগে ২৫ বছরের তরুণ যা চিন্তা করতে পারত না, এখন ১৫ বছরের শিশু অনায়াসে তা করে ফেলছে। তারা চাইলেই সহজে অপরাধে জড়িয়ে পড়ার সুযোগ পাচ্ছে।
কিশোর উন্নয়ন কেন্দ্রের তথ্যমতে, কেন্দ্রে থাকা ২০ শতাংশ শিশু হত্যা ও ২৪ শতাংশ নারী ও শিশু নির্যাতন মামলার আসামি। ১৪-১৬ বছর বয়সী কিশোরেরাই বেশি অপরাধে জড়াচ্ছে।
জানতে চাইলে সুপ্রিম কোর্টের জ্যেষ্ঠ আইনজীবী জেড আই খান পান্না আজকের পত্রিকাকে বলেন, অপরাধের বিচারের ক্ষেত্রে ১৮ বছরের বয়সসীমা কমানো যেতে পারে। কিন্তু বিয়ের ক্ষেত্রে কমানো যাবে না। শুধু সাজা নয়, সামাজিক অবস্থার পরিবর্তন দরকার। কিশোরদের অপরাধ থেকে ফেরাতে বইপড়া, খেলাধুলার ব্যবস্থা থাকাও জরুরি।
সুপ্রিম কোর্ট আইনজীবী সমিতির সম্পাদক রুহুল কুদ্দুস কাজল বলেন, ১৮ বছরের আগেই ছেলে-মেয়েদের ম্যাচিউরিটি চলে আসে। সাবালকত্ব আইনে ১৮ বছর হলে তাকে সাবালক বলা হয়। নির্বাচন কমিশন আইন অনুযায়ী, ১৮ বছর হলে ভোটার তালিকায় নাম নিবন্ধন করা হয়। তাই ১৮ বছর বয়সে শিশু বলাটা প্রচলিত অন্যান্য আইনের সঙ্গে সাংঘর্ষিক।
বিশেষজ্ঞরা বলছেন, বিশ্বের বেশির ভাগ দেশেই ১৬ বছর পর্যন্ত শিশু হিসেবে গণ্য হয়। দেশের ১৯৭৩ সালের শিশু আইনেও ১৬ বছর পর্যন্ত শিশু বলা হতো। ২০১৩ সালে বয়স বাড়িয়ে ১৮ বছর করা হয়।
বরগুনায় জনসম্মুখে রিফাত শরীফকে কুপিয়ে হত্যার ঘটনায় ১১ কিশোরকে কারাদণ্ড দেন আদালত। রায়ে আদালত বলেন, ‘সারা দেশে কিশোর অপরাধ বেড়ে যাচ্ছে। গডফাদাররা এই কিশোরদের ব্যবহার করছে। কিশোরদের সাজা কমের সুযোগ নিয়ে বিভিন্ন অপকর্মে তাদের ব্যবহার করা হচ্ছে। এসব অপরাধ নির্মূলে কিশোর অপরাধীদের সাজা বাড়ানো উচিত।’
সুপ্রিম কোর্টের আইনজীবী ও সাবেক ডেপুটি অ্যাটর্নি জেনারেল মোতাহার হোসেন সাজু শিশু আইন সংশোধনের পরামর্শ দিয়ে বলেন, শিশু আইনে বিচার হলে সর্বোচ্চ শাস্তি ১০ বছর। ফলে কিছু লোক কিশোরদের অপরাধ এমনকি খুনোখুনিতে ব্যবহার করছে। আইন সংশোধন হলে কিশোর অপরাধের মাত্রা কমবে।