জয়া চাকমা
এই বিজয় অনেক দিনের স্বপ্ন। যে স্বপ্ন পূরণ হওয়া নিয়ে সন্দেহ থাকে, সেটা যখন পূরণ হয়, তখন আপনি মনের আনন্দে উদ্বেলিত হবেন। আমারও খুব ভালো লাগছে। সাফে জেতার আনন্দ আসলে অন্যরকম এক বিষয়।
আমি এক সময় জাতীয় দলের খেলোয়াড় ছিলাম। তখন আমাদের মনে স্বপ্ন ছিল, আমরা যদি সাফে চ্যাম্পিয়ন হতে পারতাম! এবার নেপালকে হারিয়ে আমাদের মেয়েরা সে স্বপ্ন পূরণ করেছে। এটি অভূতপূর্ব এক অনুভূতি। এ রকম অনুভূতি এর আগে কখনো হয়নি। এই আনন্দ ভাষায় প্রকাশ করার মতো নয়। ওরা ট্রফি জিতে আমাদের দেশের কথা সারা বিশ্বে ছড়িয়ে দিয়েছে। এই শিরোপা জয় আমাদের নারী ফুটবলারদের আরও অনেক দূর এগিয়ে নিয়ে যাবে। সারা দেশের নারী ফুটবলাররা এখন থেকে খেলার প্রতি আরও বেশি মনোযোগী হবে। গ্রাম-গঞ্জের সাবিনারা উৎসাহিত হবে। দেশের মুখ উজ্জ্বল করবে।
বাংলাদেশের নারীদের ফুটবল খেলা শুরু হয়েছে এক দশকের মতো হবে। আর ছেলেদের শুরু হয়েছে স্বাধীনতার পর থেকে। আমরা এমন কিছু চাই, যাতে আমরা সম্মানটা পাব, আর্থিকভাবে আমাদের নারী খেলোয়াড়েরা স্বাবলম্বী হতে চাই। অর্থাৎ, খেলাধুলা করে যে একটা জীবন বা একটা পরিবার প্রতিষ্ঠিত হতে পারে, সেই নিশ্চয়তা আমরা চাই। সেটা বোধ হয় আমরা পাচ্ছি না।
আমাদের মেয়েদের যা প্রয়োজন তা খুব একটা পূরণ হচ্ছে না। কারণ, বাংলাদেশে কিন্তু ১১ জন বা ২৩ জনের একটা দল খেলছে না। ১১ কিংবা ২৩ জনের উন্নতি দিয়ে পুরো বাংলাদেশের উন্নতি হচ্ছে—সেটাও বলতে পারা যায় না। নারীদের ফুটবলের উন্নতির কথা তখন বলা যাবে, যখন ফুটবলে নারীদের অংশগ্রহণের জায়গা বাড়বে এবং তারা সার্বিকভাবে সফল হবে। তখন হয়তো যুগান্তকারী উন্নতি হয়েছে বলা যাবে। এ ছাড়া ফেডারেশন বা সরকারের পক্ষ থেকে আর্থিক নিশ্চয়তার ব্যবস্থা করে বিভিন্ন ক্যাটাগরিতে ভাগ করে যদি বেতন-ভাতা প্রদান করা হয়, তাহলে হয়তো নারী খেলোয়াড়দের আর্থিক বৈষম্য কিছুটা হলেও দূর হবে।
আমাদের দেশে মেয়েরা ফুটবল খেলছে। এটা সবাই মেনে নিচ্ছে। এটা অনেক বড় বিষয়। বলতে পারেন এটি এক ধরনের বিপ্লব। এখন মেয়েরা দেশের বাইরে খেলতে যাচ্ছে। ট্রফি জিতে আনছে। তাই মেয়েদের সবাই চিনছে। আমার মনে হয়, আমাদের মেয়েরা এই পরীক্ষায় জিতেছে। বিশ্বব্যাপী দেশের নাম পৌঁছে দিয়েছে। এই জায়গায় তারা একদিনে পৌঁছায়নি।
সরকারের পক্ষ থেকে যদি স্কুলে স্কুলে ফুটবল টুর্নামেন্টের ব্যবস্থা করা না হতো, তাহলে মেয়েরা এই জায়গায় পৌঁছাতে পারত না। এ জন্য সরকারকে সাধুবাদ জানাই। সরকারের কাছে চাওয়া—এই ধারা যেন অব্যাহত থাকে। এ ছাড়া বহুজাতিক কোম্পানি বা করপোরেট হাউসগুলো থেকে স্পনসর চালু করতে হবে। সাবিনা, কৃষ্ণা, মারিয়াদের হয়তো ফেডারেশন থেকে ব্যক্তিগত পর্যায়ে স্পনসর করার লোক থাকবে। কিন্তু ফেডারেশনের পক্ষ থেকে যদি এদের সংসারের আর্থিক বোঝাটা নামানোর ব্যবস্থা করা যায়, তাহলে তারা নিশ্চিন্তে খেলাধুলাটা করতে পারবে। তা না হলে এই বছর ট্রফি জিতেছে, পরের বছর ট্রফি নাও জিততে পারে। এতে অবাক হওয়ার কিছু থাকবে না।
ফেডারেশনের পক্ষ থেকে ঘরোয়া ফুটবল লীগ বা ক্লাব লীগ চালু করা উচিত। এটা প্রতি বছর করতে হবে। সবাই মনোযোগ দিয়ে খেলাধুলা করবে। ফলে প্রতিনিয়ত অনুশীলনের কারণে খেলার মানও বাড়বে। এতে সাবেক খেলোয়াড়েরা হয়তো কোচ বা রেফারি হিসেবে আসবে। আর এই ব্যবস্থা চালু না থাকলে সাবেক খেলোয়াড়দেরও খুঁজে পাওয়া যাবে না।
লেখক: ফুটবল রেফারি ও প্রাক্তন ফুটবলার
অনুলিখন: মন্টি বৈষ্ণব