দেরাজ খুলতেই এক জায়গায় চোখ আটকে গেল। না, তেমন কিছু নয়—তিনটে পাসপোর্ট। তার একটি সবুজ রঙের বাংলাদেশের পাসপোর্ট-আমার এখনকার ভ্রমণ ছাড়পত্র। বাকি দুটো বাতিল—আমার জাতিসংঘের কর্মজীবনের কর্মময় সময়ের চিহ্ন।
নীলটি ছিল প্রথম দিকে, তারপর পদোন্নতির সঙ্গে সঙ্গে লাল পাসপোর্টে রূপান্তর। না, কোনো দেশে নেয়নি তারা আমাকে? বিশ্বের ৮৫টি দেশে তারা আমাকে পৌঁছে দিয়েছে কোনো প্রশ্ন ব্যতিকেকেই। শক্তিশালী এবং ক্ষমতাবান ছাড়পত্র তারা সন্দেহ নেই। তবে তার মধ্যে ঐ সবুজটিই হৃদয়-নাড়ানিয়া—যতবারই সবুজ পাসপোর্টটির দিকে চোখ যায়, ততবারই বুকের মধ্যে রক্ত ছলকে ওঠে। আহ্, একটুকরো বাংলাদেশ সর্বদা হৃদয়ে বহন করি।
ওই ছাড়পত্রগুলোর দিকে তাকিয়ে মনে হলো, বড় কম দিন তো প্রাতিষ্ঠানিক কাজ করিনি—৪৩ বছর। এমএ পরীক্ষার ফল বের হওয়ার আগেই ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে ১৯৭৫ সালের অক্টোবর মাসে। ফল বের না হওয়ায় প্রভাষক হিসেবে নিয়োগ দেওয়া যায়নি। ৫০ বছর আগে একই পরিস্থিতিতে অধ্যাপক অমিয় কুমার দাশগুপ্তের নিয়োগের উদাহরণ টেনে আমাকেও প্রথম নিয়োগ দেওয়া হয়েছিল মাসিক ৪০০ টাকায় টিউটর হিসেবে। ১৯৭৬ সালের মার্চ নাগাদ ফল বেরোলে আমার নিয়োগের রূপান্তর ঘটে প্রভাষকে।
প্রায় দুই দশক বিশ্ববিদ্যালয়ে শিক্ষকতা শেষে কাজ করতে এলাম আন্তর্জাতিক বলয়ে ১৯৯২ সালে—জাতিসংঘে। কর্মস্থল নিউইয়র্কে। এ কাজেও তো প্রায় তিন দশক কাটালাম। হাসি-আনন্দে, সুখে-দুঃখে, শোকে-বেদনায় এতগুলো বছর কেটে গেল! কর্মক্ষেত্রে কত বিচিত্র অভিজ্ঞতা, কত অনন্যসাধারণ মানুষকে সহকর্মী হিসেবে পেয়েছি, কত প্রতিভাবান উদ্দীপ্ত তরুণ-তরুণী কাজ করেছে আমার সঙ্গে।
বাংলাদেশের ছোট্ট একটি মফঃস্বল শহরের ছেলে আমি। মধ্যবিত্ত পরিবারের সন্তান। বাবা কলেজশিক্ষক ছিলেন, মায়ের পড়াশোনা প্রাইমারি অবধি। না, কোনো অভিজাত স্কুল কলেজে যাইনি, বাংলা মাধ্যমেরই ছাত্র। উচ্চশিক্ষা ঢাকা আর ম্যাকগিল বিশ্ববিদ্যালয়ে। যেখান থেকে যেসব কর্মক্ষেত্রে কাজ করার সুযোগ পেয়েছি, সে আমার ভাগ্য বলে মানি, নমিত হই বারবার। আন্তর্জাতিক অঙ্গনে যখন নোবেল বিজয়ীদের সঙ্গে কাজ করেছি, রাজা-রানি, যুবরাজ-রাজকুমারী, রাষ্ট্রপ্রধান-প্রধানমন্ত্রী কিংবা বিশ্বনেতাদের সঙ্গে একই মঞ্চে বসেছি, অথবা বিশ্বের বিখ্যাত নামী-দামী সংবাদ মাধ্যমগুলোর সঙ্গে কথা বলেছি, তখন প্রায়ই সবকিছু অবিশ্বাস্য মনে হয়েছে—উৎপল দত্তের ভাষায় ‘প্রেত্যয় হয়নি’।
কিন্তু সবচেয়ে ভালো লাগে এটা ভাবতে যে, এ জীবনে পৃথিবীর কত দেশে গিয়েছি। আমার মতো মানুষের জন্যে সে যে কত বড় সৌভাগ্য! কি সব আশ্চর্য্য সেসব ভূখণ্ড—দক্ষিণ আফ্রিকার উত্তমাশা অন্তরীপ, জর্ডানের মৃত সমুদ্র, ব্রাজিলের আমাজন অরণ্য, জাম্বিয়ার ভিক্টোরিয়া জলপ্রপাত। সাহারার গরমে গা পুড়ে গেছে, আইসল্যান্ডের তুষারঝড়ে পড়েছি, জাম্বিয়ার অরণ্যে পথ হারিয়েছি, কেপটাউনের লাঙ্গা বস্তিতে গিয়ে ভয়ে কেঁপেছি। রবেন দ্বীপে ম্যান্ডেলার কারাবাসে গিয়ে মাথা নুয়ে গেছে, সেনেগালের গোরি দ্বীপে গিয়ে দাসপ্রথার কথা ভেবে মন কেমন যেন হয়ে গেছে, ইয়েমেনের সন্ত্রাসের জায়গাগুলো দেখে সন্ত্রাসের বিরুদ্ধে তীব্র ঘৃণায় মন বিষিয়ে গেছে।
কত রাজধানী থেকে রাজধানীতে গিয়েছি। ২০১৭ সালে মানব উন্নয়ন প্রতিবেদন উপস্থাপনকালে ১৫ দিনে ১২টি রাজধানীতে উপস্থিত ছিলাম। তার মধ্যে ঢাকাও ছিল। এক বিমানবন্দর থেকে আরেক বিমানবন্দরে পাড়ি দিয়েছি। কত শত হোটেলে যে থেকেছি, তার গোনাগুনতি না করাই ভালো—রাত্রিবাস নম্বরে পরিণত হয়েছিল। সেসবের কোনো কিছুই মনে নেই । নানান রাজধানীর দ্রষ্টব্য স্থানগুলো ভুলে গেছি। বিস্মৃত হয়েছি কোথায় কোন হোটেলে ছিলাম। মনে নেই কোন সব বিখ্যাত ব্যক্তিদের সঙ্গে ওঠা-বসা করেছি।
আসলে পৃথিবীর যেখানেই গেছি, সেখানেই সবচেয়ে বেশি আকর্ষিত হয়েছি মানুষের প্রতি। মস্কোর শেষ বিকেলের মেয়েটিকে মনে আছে, সিরিয়ার সেই শরণার্থী শিশুটির কথা ভুলিনি । আলেপ্পো থেকে নিয়ে আসা তার ছেঁড়া পুতুলটি ছাড়বে না, মনের চোখে চীনের সেই ছেলেমেয়ে দুটোকে দেখতে পাই, যারা মুখোমুখি দুটো সাইকেলের হাতল ধরে তাদের ভালোবাসার যতি টানছিল, মুষলধারে বৃষ্টির মধ্যে ইউক্রেনের যে মা নিজে ভিজে জবজবে হয়ে তিনটে বাচ্চাকে নিজের ছেঁড়া কোট দিয়ে রক্ষা করছিলেন, তাঁর ছবি এখনও আমাকে তাড়া করে। আসলে স্মৃতিতে রয়ে গেছে সেইসব মানুষ, যাঁদের সঙ্গে দেখা পথে-ঘাটে, বাজারে-বন্দরে, অরণ্যে-লোকালয়ে। মনের মধ্যে তাঁদের ‘নিত্য আনাগোনা’।
দেশে দেশে আমার দেখা নানান মানুষের কেউ কেউ আমার লেখায় উঠে এসেছে—কিন্তু লেখা হয়নি বহু মানুষের কথা। লন্ডনের এক মেমসাহেবের কথা এখনও তো লিখে উঠতে পারিনি। লিখিনি মলদোভার সেই তরুণী বধূটির কথা, যে পরম মমতায় যত্ন করে রাখে তার পঙ্গু স্বামীটিকে; বাহরাইনের সেই ডাক্তারের কথা, যিনি প্রতিদিন ২৫ থেকে ৩০ মাইল ঘুরে ঘুরে রোগী দেখেন। লেখা হয়নি আয়ারল্যান্ডের সেই ঋষিতুল্য বৃদ্ধের কথা, যিনি আমাকে বলেছিলেন—‘গ্রন্থই আমার জীবন’। রুমানিয়ার সেই জিপসি নারীর কথা, যিনি দাবি করেছিলেন যে আমি তার হারিয়ে যাওয়া ভাই, কিংবা দক্ষিণ সুদানের সেই শিশুটির কথা, যে আমার চশমাটি চেয়েছিল। এদের সবাইকে নিয়ে মনের মধ্যে একধরনের আর্তি আছে। লিখতে কি পারব সবার কথা? কে জানে?
জানি, এই দীর্ঘ ভ্রমণযাত্রায় যেসব জায়গায় গিয়েছি, সেসব জায়গায় আর যাওয়া হবে না। আর গেলেই বা কি? এক নদীতে যেমন দুবার পা দেওয়া যায় না, এক শহরেও দুবার যাওয়া যায় না। তার চেয়েও বড় কথা, এ পথ চলায় নানান শহরে যাদের দেখা পেয়েছিলাম, দেখা হবে না হয়তো তাদের কারও সঙ্গেই আর এ জীবনে। এ জীবনে কতজনের কাছে যে কত যে ঋণ—দিয়েছি যা, নিয়েছি তো তার চেয়ে অনেক বেশি। ও নিয়ে বেশি ভাবি না—জগতের সব ঋণ শুধবার নয়, আর তা শোধ করাও যায় না একজীবনে।