রোজা রাখা অনেক ধর্মের একটি সাধারণ কর্ম। রোজা রাখার নিয়ম সর্বযুগেই প্রচলিত ছিল। আদি মানব প্রথম নবী হজরত আদম (আ.) থেকে শুরু করে শেষ নবী ও রাসুল হজরত মুহাম্মদ (সা.) পর্যন্ত সব নবী-রাসুলগণ রোজা পালন করেছেন। রোজা শুধু নবী করিম (সা.)-এর প্রতি ফরজ করা হয়নি, পূর্ববর্তী নবী-রাসুলদের প্রতিও ফরজ করা হয়েছিল। হজরত আদম (আ.) থেকে হজরত নূহ (আ.) পর্যন্ত চান্দ্র মাসের ১৩, ১৪ ও ১৫ তারিখ রোজা ফরজ ছিল, যাকে ‘আইয়্যামে বিজ’ বলা হতো। ইসলামের প্রাথমিক যুগে তিন দিন রোজা রাখার বিধান ছিল। পরে দ্বিতীয় হিজরি সালে উম্মতে মুহাম্মদীর ওপর পবিত্র মাহে রমজানের রোজা ফরজ হলে তা রহিত হয়ে যায়।
রোজা নামাজের মতো একটি পুরোনো অনুশাসন এবং পূর্ববর্তী বিভিন্ন ধর্মে রোজার ব্যবস্থা রাখা হয়েছে। ইতিহাস সাক্ষ্য দেয়–চীন, জাপান, কোরিয়া, মিসর ও গ্রিসে রোজার প্রচলন ছিল। হজরত মুসা (আ.) তুর পাহাড়ে আল্লাহর কাছ থেকে তাওরাত প্রাপ্তির আগে ৪০ দিন পানাহার ত্যাগ করেছিলেন। হজরত ঈসা (আ.) তাঁর ধর্ম প্রচারের শুরুতে ইঞ্জিল পাওয়ার আগে ৪০ দিন রোজা রেখেছিলেন। হজরত মুসা (আ.), হজরত ঈসা (আ.) এবং তাঁদের অনুসারীরা সবাই রোজা পালন করেছেন। ইহুদি ও খ্রিষ্টানদের জন্য রোজা পালনের বিধান ছিল। ইহুদিদের ওপর প্রতি শনিবার বছরের মধ্যে মহররমের ১০ তারিখে আশুরার দিন এবং অন্যান্য সময় রোজা ফরজ ছিল। খ্রিষ্টানদের ওপর মুসলমানদের মতো রোজা ফরজ ছিল। বাইবেলে রোজাব্রত পালনের মাধ্যমেই আত্মশুদ্ধি ও কঠোর সংযম সাধনার সন্ধান পাওয়া যায়। বিভিন্ন জাতি-ধর্মনির্বিশেষে সবার মধ্যেই রোজা পালনের ইতিহাস পাওয়া যায়। এ ছাড়া অন্য ধর্মাবলম্বীদের মধ্যেও রোজা পালনের ধারা অব্যাহত ছিল। মানবশুদ্ধির জন্য আদিম যুগ থেকেই অনেক গোত্র, বর্ণ, সম্প্রদায় এবং বিভিন্ন ধর্মাবলম্বীর মধ্যে রোজা প্রচলিত ছিল। যদিও ধরন ও প্রক্রিয়াগতভাবে এতে কেবল সংখ্যা, নিয়মকানুন ও সময়ের ব্যবধান কিছুটা ভিন্নতর ছিল। ইসলাম প্রত্যেক বয়ঃপ্রাপ্ত, সক্ষম, সুস্থ, মুকিম ও বুদ্ধিমান মুসলমান নর-নারীর ওপর বছরে এক মাসব্যাপী চরম ধৈর্য্যর সংযম ও কঠিন উপাসনামূলক কার্যাবলিসহ রোজা পালনের বিধান আবশ্যক করেছে, যা দ্বারা ইসলামের তৃতীয় অবশ্যকরণীয় মৌলিক ভিত্তি গঠিত হয়।
রোজার অন্তর্নিহিত তাৎপর্য এই যে–এটি নারী-পুরুষের মনকে প্রশিক্ষণ দেয় এবং তাঁদের নৈতিক মূল্যবোধকে উন্নত করে। রোজা সংযমের মাধ্যমে রিপু দমন করে এবং রোজাদারদের দেহ ও মনের ওপর নিয়ন্ত্রণ প্রতিষ্ঠা করে। রোজা নর-নারীকে স্বার্থপরতা, জাগতিক মন্দ চিন্তাভাবনা থেকে বিরত রাখে। প্রাথমিকভাবে রোজা হচ্ছে একটি আত্মিক অনুশাসন, নিয়ম শৃঙ্খলাপূর্ণ ইবাদত–যার উদ্দেশ্য হচ্ছে, আল্লাহতাআলার সন্তুষ্টি অর্জন। রোজার বহুবিধ শারীরিক উপকারিতাও রয়েছে। রোজাকালীন প্রত্যেক রোজাদারের স্বাস্থ্যের উন্নতি এবং দৈহিক সুস্থতা হাসিল হয়। মানুষের পরিপাক অঙ্গসমূহের ক্ষমতা উন্নয়ন হয় এবং বুদ্ধি-বিবেক জাগ্রত হয়। রোজার সময় পরিপাক অঙ্গসমূহ বিশ্রামে থাকার ফলে রোজাদারদের অধিক কাজকর্ম করার শক্তি ও ক্ষমতা বৃদ্ধি পায়। রোজার সময় একজন রোজাদার ক্ষুধা ও তৃষ্ণার জ্বালা-যন্ত্রণা তীব্রভাবে বহন করেন এবং এভাবে যেকোনো কঠিন সময়ে জীবনকে কঠিন কাজের জন্য অভ্যস্ত করে নেওয়ার দীক্ষা নেন। রোজা অবস্থায় রোজাদারের দেহের রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা বৃদ্ধি পায় এবং তিনি সহাস্যবদনে কঠিন কষ্টের মোকাবিলা করতে পারেন। কেননা যে ব্যক্তি কোনো দিন ক্ষুধার্ত ও পিপাসার্ত থাকেননি, তিনি কখনো ক্ষুধার্ত মানুষের দুঃখ-কষ্ট বুঝতে পারেন না। অপরদিকে কোনো ব্যক্তি যখন রোজা রাখেন এবং উপবাসে থাকেন, তখন তিনি যথাযথভাবে উপলব্ধি করতে পারেন যে যারা অর্ধাহারে-অনাহারে দিন কাটাচ্ছেন, তারা যে কত দুঃখ-কষ্টে ও বিপদ-আপদে দিনাতিপাত করছেন। আর তখনই অনাহারক্লিষ্ট দৈহিক-মানসিকভাবে দুর্বল অসহায় মানুষের প্রতি ধনী রোজাদারদের অন্তরে সাহায্য-সহানুভূতির উদ্রেক হয়। রোজার নৈতিক তাৎপর্য এই যে একজন রোজাদার মুসলিম সাধক তখন শুধু অপকর্মসমূহ থেকে বিরত থাকেন না, বরং অন্যসব মন্দ কাজ ও বাক্যালাপ থেকেও বিরত থাকেন।
পবিত্র রমজান মাস আত্মিক অগ্রগতি এবং আল্লাহর নৈকট্য অর্জনের জন্য বিশেষভাবে সহায়ক ও উপযোগী। রোজা বাস্তবিকই আত্মিক নিয়মানুবর্তিতার একটি উপায়। রোজার চূড়ান্ত লক্ষ্য হচ্ছে–স্রষ্টার ঐশী আনন্দ অন্বেষণ করা, তাঁর দয়া, অনুগ্রহ, ক্ষমা ও নরকাগ্নি থেকে নিষ্কৃতি লাভ করা। এভাবে রোজা মানুষের আত্মিক উন্নতি জাগ্রত করে। রোজা মানুষকে নৈতিক শৃঙ্খলার ব্যাপারে প্রকৃত শিক্ষা ও প্রশিক্ষণ দেয়। কঠোর সিয়াম সাধনা, ত্যাগ-তিতিক্ষা ও জীবনের চরম কঠিন পরীক্ষার জন্য আগত দুঃখ-কষ্ট সহ্য করতে প্রস্তুত থাকার শিক্ষা দেয়। পবিত্র রমজান মাসে একজন রোজাদার লোক তাঁর মন্দ চাহিদাগুলো জ্বালিয়ে দেন। এ ছাড়া তাঁর শারীরিক চাহিদাগুলোর নিয়ন্ত্রণসহ অসৎ কার্যাবলি পরিত্যাগ করার নৈতিক শিক্ষা লাভ করেন। মানুষকে দয়া, ক্ষমা ও মুক্তির দিকে ফিরিয়ে আনার লক্ষ্যে এবং আত্মিক, নৈতিক ও চারিত্রিক কল্যাণের ধারক বানানোর নিমিত্তে আল্লাহতাআলা উম্মতে মুহাম্মদীর ওপর রোজা ফরজ করেছেন। এমনিভাবে মাহে রমজানে রোজা সমগ্র মুসলিম বিশ্বে সাম্য, মৈত্রী, ঐক্য, সংযম ও সহনশীলতা প্রদর্শনের শিক্ষা দেয়। পবিত্র রমজান মাসে সমাজের ধনী-দরিদ্র সবাই সমানভাবে বিশেষত পানাহারের ব্যাপারে একই মর্যাদায় উপনীত হন এবং তা মানুষকে ভোগে বিতৃষ্ণ, ত্যাগে উদ্বুদ্ধ এবং আত্মবিশ্বাসে বলীয়ান করে নিঃসন্দেহে।