সম্পাদকীয়
নীলফামারীর সৈয়দপুরে বিসমিল্লাহ সেলুন বলে যে চুল ছাঁটার দোকানটি রয়েছে, তা অন্য সেলুন থেকে ব্যতিক্রম একটি কারণে—এখানে রয়েছে পাঠাগারের আবহ। কেউ চাইলে এখানে এসে দিব্যি পড়ে যেতে পারেন বই। চুল ছাঁটার প্রয়োজন না থাকলেও জ্ঞানপিপাসা মেটানোর জন্য আসতে পারেন সেলুনে।এটা খুবই গুরুত্বপূর্ণ একটা ব্যাপার।
এ কথা অনেকেই মেনে নেবেন, একটা হাহাকার আমাদের মনের মধ্যে কাজ করছে দীর্ঘদিন ধরে। অনেকগুলো বছর পার হয়েছে মুক্তিযুদ্ধের পর; আর আমরা ক্রমান্বয়ে লক্ষ করছি, আমাদের সাংস্কৃতিক অর্জনগুলো জোর করে হটিয়ে দেওয়ার চেষ্টা করা হচ্ছে আমাদের জীবনাচরণ থেকে।
কাজটা করা হচ্ছে অতি সূক্ষ্মভাবে। হঠাৎ করে তা নজরে পড়ে না। রেমিটেন্স হিসেবে আরব বিশ্বের টাকা-পয়সা এ দেশে ঢুকছে। আমাদের অর্থনীতিকে তা অনেকখানি স্বাবলম্বী করে তুলছে। কিন্তু ইদানীং সেই টাকা-পয়সার সঙ্গে সালাফি মতবাদও প্রবলভাবে ঢুকে পড়েছে। আর তাতেই মগজ ধোলাই হয়ে যাচ্ছে অনেকের। নিজস্ব সংস্কৃতিকে জীবনাচরণ থেকে সরিয়ে দিয়ে ভিন্ন সংস্কৃতির কাছাকাছি হতে চাইছে অনেকেই। নিজ অস্তিত্বকে অস্বীকার করার এ এক সুকৌশলী ষড়যন্ত্র।
স্মৃতি হাতড়ালে দেখা যাবে, শুধু রাজধানীতে নয়, ছোটখাটো মফস্বল শহরগুলোতেও একসময় নানা ধরনের সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান হতো। আবৃত্তি, নাচ, গানের প্রতিযোগিতা হতো শিশু-কিশোরদের মধ্যে। সে প্রতিযোগিতার পুরস্কার ছিল মূলত বই। সবখানেই থাকত ছোটখাটো একটা পাঠাগার। ক্লাবগুলোতে শুধু খেলাধুলা হতো না, হতো সংস্কৃতি চর্চা।
সকালবেলায় প্রায় প্রতিটি বাড়ি থেকেই ভেসে আসত হারমোনিয়ামের সুর। সেই সাংস্কৃতিক আবহ থেকে সুকৌশলে সরিয়ে দেওয়া হয়েছে নতুন প্রজন্মকে। এই প্রেক্ষাপট মনে রাখলে সৈয়দপুরের তুলসীরাম সড়কের শাহজাদা ইসলামের সেলুন পাঠাগারকে একটি দৃষ্টান্তমূলক কাজ বলেই মেনে নিতে হবে।
একটাই শুধু কথা বলার ছিল। যে সেতুবন্ধ পাঠাগারের সহযোগিতায় শাহজাদা ইসলাম তাঁর সেলুন পাঠাগারটি চালু করতে পেরেছেন, তাঁরা যদি বই নির্বাচনে একটু সতর্ক হন, পরিকল্পনা করে বই দেন—তাহলে মানসগঠনের পর্বটি সুচারুভাবে সম্পন্ন হতে পারে। গল্প-উপন্যাসের পাশাপাশি বাংলাদেশের ইতিহাস, মুক্তিযুদ্ধবিষয়ক বই যেন থাকে, সে রকম একটা পরিকল্পনা থাকা দরকার। বইপ্রেমী শাহজাদা ইসলামের এই অভিনব উদ্যোগকে আমরা স্বাগত জানাই।