রাজধানীর ডেমরার পশ্চিম টেংরা ক্যানেল পাড় এলাকায় ১৬ বছর আগে রাজীবুল আলম ভূইয়া ওরফে রাজীবের দুই চোখ উপড়ে ফেলার সেই চাঞ্চল্যকর ঘটনায় দায়ের করা মামলায় আওয়ামী লীগ নেতাসহ ৫ জনকে যাবজ্জীবন কারাদণ্ড দেওয়া হয়েছে। আজ রোববার ঢাকার তৃতীয় অতিরিক্ত মহানগর দায়রা জজ আদালতের বিচারক শেখ ছামিদুল ইসলাম এই রায় ঘোষণা করেন।
সাজাপ্রাপ্ত আসামিরা হলেন বিজয় ওরফে শামীম আহম্মেদ, দ্বীন ইসলাম, মো. ইকবাল, নাসু ওরফে নাসির উদ্দিন ও রাজিব ওরফে মোটা রাজিব।
প্রত্যেককে ১০ হাজার টাকা জরিমানা করা হয়েছে। জরিমানার টাকা পরিশোধে ব্যর্থ হলে আরও তিন মাসের কারা ভোগ করতে হবে বলে রায়ে বলা হয়েছে।
রায়ে ওপর পাঁচ আসামি রিপন, রাশেদ, তপন, রাসেল ও মমিতুর রহমান ওরফে রোসেলকে বেকসুর খালাস দেওয়া হয়েছে।
রায় ঘোষণার সময় আসামি সবাই পলাতক ছিলেন। যে পাঁচজনকে যাবজ্জীবন কারাদণ্ড দেওয়া হয়েছে আদালত তাদের বিরুদ্ধে গ্রেপ্তারি পরোয়ানা জারি করেছেন। তারা গ্রেপ্তার হওয়ার পর অথবা আদালতে আত্মসমর্পণ করার পর এই রায় কার্যকর হবে বলে রায়ে উল্লেখ করা হয়েছে।
ওই আদালতের অতিরিক্ত পিপি আবুল কালাম আজাদ রায়ের বিষয়টি নিশ্চিত করেন।
সাজাপ্রাপ্ত আসামি ইকবাল ডেমরা থানার ৬৮ নম্বর ওয়ার্ড আওয়ামী লীগের সভাপতি। অন্য আসামিরা সবাই আওয়ামী লীগ ও যুবলীগের রাজনীতির সঙ্গে জড়িত।
এই মামলার ভিকটিম রাজিবের স্ত্রী অ্যাডভোকেট সোহাগী রীতা আদালতে উপস্থিত ছিলেন। তিনি আজকের পত্রিকাকে বলেন, ১৬ বছর পরে তিনি বিচার পেলেন। সাজাপ্রাপ্তরা পালিয়ে গেছেন। তাদের অবিলম্বে গ্রেপ্তার করে সাজা কার্যকর করার দাবি জানান তিনি।
ঘটনার বিবরণে জানা যায়, ২০০৮ সালের ২৭ নভেম্বর আনুমানিক ৯টার দিকে রাজধানীর ডেমরার পশ্চিম টেংরা ক্যানেল পাড় এলাকার প্রধান সড়ক ধরে রিকশায় যাচ্ছিলেন দুই যুবক রাজীবুল আলম ভূঁইয়া ওরফে রাজীব ও তার বন্ধু রোমেল। বড়ভাঙ্গা ক্যানেল পাড় আনোয়ার ভিলার কাছে সেই রিকশার গতিরোধ করে ১০ জন অস্ত্রধারী। অস্ত্রের মুখে রিকশায় বসে থাকা দুই যুবককে টেনে নামানো হয়। নিয়ে যাওয়া হয় পাশের গলিতে। ছিনিয়ে নেওয়া হয় দুজনের হাতে থাকা মোবাইল ফোন। এরপর রাজীবকে হাত-পা বেঁধে মাটিতে চিৎ করে শুইয়ে ফেলা হয়। মুখের ভেতর গুঁজে দেওয়া হয় গামছা। ধারালো অস্ত্র দিয়ে তুলে ফেলা হয় রাজীবের একটি চোখ। এই দৃশ্য দেখে প্রাণভয়ে ছুটে পালানোর চেষ্টা করেন রাজীবের বন্ধু রোমেল। তাকে আবার ধরে আনা হয়। বন্ধুর অবস্থা দেখে তখন জ্ঞান হারানোর মতো অবস্থা তার।
এবার রোমেলের সামনেই রাজীবের অপর চোখও উপড়ে ফেলা হয়। অদূরে দাঁড়িয়ে থেকে পুরো ঘটনাটি দেখছিলেন কয়েকজন। কিন্তু ভয়ে কেউই এগিয়ে আসেননি। এরই মধ্যে একজন চিৎকার করে বললেন, র্যাবকে খবর দাও, ফোন কর। অস্ত্রধারীরা তখন প্রস্তুতি নিচ্ছিল রক্তাক্ত যুবককে পাশের ডোবায় ফেলে দেওয়ার। কিন্তু ‘র্যাব’ শব্দটি শুনে থেমে যায় দুর্বৃত্তরা। দ্রুত পালিয়ে যায় ঘটনাস্থল থেকে। এরপর ছুটে আসেন এলাকাবাসী। তাদের ফোন পেয়ে আসে র্যাব-১০ এর একটি দল। আহত যুবককে নেওয়া হয় হাসপাতালে। চিকিৎসকেরা জানান, তার দুটি চোখ এমনভাবে উপড়ে ফেলা হয়েছে, এতে করে ভবিষ্যতে আর সেটা প্রতিস্থাপনও সম্ভব নয়। চিরদিনের মতো চোখের আলো নিভে যায় টগবগে সেই যুবক রাজীবের।
ভিকটিম রাজীব ‘স্নিগ্ধা মাল্টিপারপাস’ নামে ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠানের মালিক। ছিল ইট-বালুর ব্যবসা, কয়েকটি টেম্পো আর মাছের খামার। এলাকার মাদক ব্যবসা ও সন্ত্রাসী কার্যক্রমের বিরোধিতা করায় তার চোখ উপড়ে ফেলা হয় বলে মামলার তদন্তে প্রকাশ পায়।
ওই ঘটনার পরদিন রাজীবের বাবা শাহ আলম বাদী হয়ে ডেমরা থানায় মামলা করেন। পুলিশ উল্লিখিত ১০ জনকে আসামি করে ২০০৯ সালের ২৬ সেপ্টেম্বর আদালতে চার্জশিট দাখিল করে। মামলা চলাকালে ২৪ সাক্ষীর মধ্যে ১২ জনের সাক্ষ্যগ্রহণ করেন আদালত। ১৬৪ ধারায় স্বীকারোক্তিমূলক জবানবন্দিও দেন আসামি রুবেল। ২০১০ সালের ১৬ মার্চ র্যাবের ক্রসফায়ারে মারা যান রুবেল। এ কারণে তাকে মামলা থেকে অব্যাহতি দেওয়া হয়েছে আগেই।