হোম > মতামত > উপসম্পাদকীয়

টানাপোড়েনের মধ্যে সংস্কার ও নির্বাচন

অরুণ কর্মকার

প্রধান উপদেষ্টার সঙ্গে রাজনৈতিক দলের বৈঠক। ছবি: পিআইডি

টানাপোড়েন যে একটা সৃষ্টি হবে, সে ইঙ্গিত শুরু থেকেই ছিল। সুনির্দিষ্ট ধারাবাহিকতায় এখন তা স্পষ্টতর হয়েছে। মূল প্রতিপাদ্য একটাই। সংস্কার করে জাতীয় নির্বাচন, নাকি জাতীয় নির্বাচনের পরে সংস্কার? যদি সংস্কার করে নির্বাচন হয়, তাহলে সব দলের কাছে গ্রহণযোগ্য সব সংস্কার কার্যক্রম শেষ করার পরে নির্বাচন, নাকি আংশিক সংস্কারের পরে? বাকিটা জাতীয় নির্বাচনের পরে, নির্বাচিত সরকারের মাধ্যমে হবে?

আপাতদৃষ্টিতে, শুরুর দিকে বিষয়টি এ রকম সহজ-সরলই ছিল। তবে এখন তা নেই। থাকার কথা কেউ ভাবেওনি। যেমনটি ভাবা হয়েছিল, তেমন প্রক্রিয়ার মধ্য দিয়েই সংস্কার এবং জাতীয় নির্বাচনের মাঝখানে চলে এসেছে স্থানীয় সরকার নির্বাচনের কথা এবং সংবিধান সংস্কার কিংবা প্রণয়ন যা-ই বলা হোক না কেন, সে জন্য প্রয়োজন গণপরিষদ নির্বাচন। কাজেই বিষয়টি আগের তুলনায় একটু কঠিন হয়েছে। তবে এখনো তা একেবারে জটিল কোনো সমীকরণে পরিণত হয়নি। যেহেতু বিষয়টি নির্ভেজাল রাজনীতিসংশ্লিষ্ট, তাই তেমনটি হওয়ার সম্ভাবনা উড়িয়েও দেওয়া যায় না। কারণ, রাজনীতির দাবার ঘুঁটি সব সময় জটিল চালেই চলতে অভ্যস্ত।

একটু গভীর বিশ্লেষণী দৃষ্টিভঙ্গি যাঁদের, তাঁরা বর্তমান টানাপোড়েনের বিষয়টির মধ্যে আরও একটু জটিলতা দেখতে পান। যেমন, গত বুধবার রাজধানীর তেজগাঁওয়ে প্রধান উপদেষ্টার কার্যালয়ে চারটি সংস্কার কমিশনের প্রতিবেদন হস্তান্তর অনুষ্ঠানে প্রধান উপদেষ্টা ড. মুহাম্মদ ইউনূস বলেছেন, ‘সংস্কার কমিশনের প্রতিবেদনের ওপর মতৈক্যের ভিত্তিতে তৈরি হবে গণ-অভ্যুত্থানের চার্টার (সনদ)। সেই চার্টারের ভিত্তিতে পরবর্তী নির্বাচন হবে।’ কথাটির সঙ্গে প্রথমত নির্বাচনের সময়সূচির কোনো প্রত্যক্ষ যোগ নেই। তা ছাড়া, উক্তিটির সঙ্গে প্রধান উপদেষ্টার ইতিপূর্বেকার নির্বাচনসংক্রান্ত বক্তব্যেরও সাযুজ্য রয়েছে। তারপরও উক্তিটি নতুন। মতৈক্যের ভিত্তিতে চার্টার তৈরি করা এবং সেই চার্টারের ভিত্তিতে নির্বাচন অনুষ্ঠান কিন্তু একটি নতুন বন্দোবস্তের বিষয় হবে। নির্বাচন কমিশনের বর্তমান ম্যান্ডেট এবং প্রস্তুতিতে সেই নির্বাচন আয়োজন সম্ভব হবে কি না, তা নিশ্চিত নয়।

এরপর আমরা মনে করতে পারি ১৫ জানুয়ারি ফরেন সার্ভিস একাডেমিতে অনুষ্ঠিত একটি প্রেস ব্রিফিংয়ের কথা। চারটি সংস্কার কমিশনের প্রদত্ত প্রতিবেদন এবং সে সম্পর্কে তথ্যাদি অবহিতকরণ ছিল ওই প্রেস ব্রিফিংয়ের বিষয়বস্তু। সেখানে কোনো একজন সাংবাদিকের প্রশ্নের জবাবে আইন উপদেষ্টা আসিফ নজরুল বলেছেন, ‘সব সংস্কার শেষ করতে আগামী বছরের (২০২৬ সাল) মাঝামাঝি পর্যন্ত সময় লাগবে।’ সুতরাং সব সংস্কার শেষ করে নির্বাচনের বিষয়ে রাজনৈতিক ঐকমত্য হলে নির্বাচন আয়োজন করতে আগামী বছরের শেষ পর্যন্ত সময় লাগতেই পারে। অবশ্য এর কোনোটিই একেবারে সুনির্দিষ্ট সময় নয়। কিন্তু কথাগুলো নিয়মিত বিরতিতে ঘুরেফিরে আসছে। যেমন এসেছে স্থানীয় সরকার কিংবা গণপরিষদ নির্বাচনের কথা।

এ প্রসঙ্গে আমরা আরও স্মরণ করতে পারি প্রধান উপদেষ্টার একটি মন্তব্য। আল জাজিরার সঙ্গে এক সাক্ষাৎকারে তিনি বলেছিলেন, সংস্কারের জন্য তিনি কোনো তারিখ দিতে চান না। এ ক্ষেত্রে চার বছর পর্যন্ত সময় লাগতে পারে। এই মন্তব্য থেকে এ কথা ধরে নেওয়ার কোনো কারণ নেই যে চার বছরই লাগবে। কিন্তু কত দিন লাগবে তা সত্যিই নির্দিষ্ট করে বলা সম্ভব নয়। কিন্তু যে রাজনৈতিক দলগুলো নির্বাচনের জন্য নির্দিষ্ট সময় চায়, তারা তো তা চাইতেই থাকবে। কাজেই টানাপোড়েন অবশ্যম্ভাবী এবং অনিবার্য। সেটাই আমরা এখন দেখতে পাচ্ছি।

একটা বিষয় লক্ষণীয় যে নির্বাচনের দিন-তারিখ নিয়ে নিয়মিত কথা বলছে শুধু বিএনপি। হয়তো এটাই স্বাভাবিক। কারণ, ক্ষমতায় যাওয়ার নিশ্চিত সম্ভাবনা তাদেরই। তাই অন্যদের তত তাড়া নেই। তবে শেখ হাসিনার পতনের আন্দোলনে সব রাজনৈতিক দল কিন্তু এককাট্টা হয়েই ছাত্রদের সঙ্গে মাঠে ছিল। সংস্কার এবং নির্বাচনের সময়ের প্রশ্নে তারা সেভাবে থাকতে পারছে না। এটাও রাজনীতির কঠোর বাস্তবতা। বিএনপি এখন দাবি করছে এ বছরের মাঝামাঝি সময়ে অর্থাৎ জুলাই-আগস্টের মধ্যেই জাতীয় সংসদ নির্বাচন অনুষ্ঠানের। ১৪ জানুয়ারি এক সংবাদ সম্মেলনে বিএনপির মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর এই দাবি করে বলেছেন, ‘এটা (জাতীয় সংসদ নির্বাচন) গণতন্ত্রের সবচেয়ে ইম্পর্টেন্ট বিষয়। সে ক্ষেত্রে আমরা মনে করি এই বছরের মাঝামাঝি সময়ে অর্থাৎ জুলাই-আগস্টের মধ্যেই নির্বাচন সম্ভব।’ তিনি সরকার, নির্বাচন কমিশন এবং রাজনৈতিক দলগুলোর প্রতি এই আহ্বান জানিয়েছেন যে ‘দেশের বৃহত্তর স্বার্থে এ বছরের মাঝামাঝি সময়ে নির্বাচন অনুষ্ঠানের জন্য যেন আমরা ব্যবস্থা নিতে পারি।’

বিএনপির মহাসচিবের এই বক্তব্য এসেছে দলের স্থায়ী কমিটির সভায় আলোচনার সূত্র ধরে। ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান তারেক রহমানের সভাপতিত্বে অনুষ্ঠিত ওই সভায় জাতীয় নির্বাচনের বিষয়ে প্রধান উপদেষ্টার যে বক্তব্য ছিল, এই বছরের শেষের দিকে অথবা পরবর্তী বছরের অর্থাৎ ২০২৬ সালের মাঝামাঝি সময়ে নির্বাচন, সে বিষয়ে দীর্ঘ আলোচনা শেষে বিএনপির বক্তব্য হলো—নির্বাচন এতটা বিলম্বিত করার কোনো কারণ নেই। নির্বাচন যত বিলম্বিত হবে ততই রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিক সংকট বৃদ্ধি পাবে। বাস্তবেও তা-ই দেখা যাচ্ছে। কিন্তু বিএনপির আহ্বানে রাজনৈতিক কোনো দলেরই খুব একটা সাড়া নেই। এমনকি বিএনপির সঙ্গে ঐক্যবদ্ধভাবে রাজনীতির মাঠে থাকা নাগরিক ঐক্যের সভাপতি মাহমুদুর রহমান মান্না পর্যন্ত বলেছেন, নির্বাচনের জন্য সরকারকে কোনো চাপ তাঁরা দিচ্ছেন না। তাঁর মতে, প্রয়োজনীয় সংস্কার করেও নির্বাচন করা সম্ভব এবং সেটা দ্রুতই সম্ভব। এ জন্য তাঁরা কোনো চাপ দিচ্ছেন না। একটা গ্রহণযোগ্য, কোয়ালিটি নির্বাচন করার জন্য যা যা করা দরকার, সেগুলোই তাঁরা বলে যাবেন। সরকার নির্বাচনের যে সময় জানিয়েছে তাতে কোনো সমস্যা ছিল না বলেও মনে করেন তিনি।

ওদিকে প্রয়োজনীয় সংস্কার সম্পন্ন করে নতুন সংবিধান রচনা করার পর নির্বাচন চায় চব্বিশের গণ-অভ্যুত্থানে নেতৃত্ব দেওয়া বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলন। বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের মুখ্য সমন্বয়ক আব্দুল হান্নান মাসউদ সংবাদমাধ্যমকে বলেছেন, বাংলাদেশে নির্বাচিত সরকার এলে ভারতের সঙ্গে সম্পর্ক স্বাভাবিক হবে—ভারতের সেনাপ্রধানের এমন বক্তব্যের পরদিনই বিএনপির দ্রুত নির্বাচনের দাবি একই সূত্রে গাঁথা বলে মনে করেন তিনি। মাসউদ বলেন, ভারতও চাপ দিচ্ছে যে বাংলাদেশে দ্রুত নির্বাচন দরকার। সংস্কার ছাড়াই। হঠাৎ করে বিএনপিও ছয় মাসের মধ্যে নির্বাচন চাইছে। এত দিন তারা বলেছে ২০২৫ সালের মধ্যে নির্বাচন দিতে। এই দুটোর মধ্যে একটা যোগসূত্র আছে বলে মনে করেন তিনি। অর্থাৎ ভারতীয় অ্যাজেন্ডা বাস্তবায়নে বিএনপি দ্রুত নির্বাচন চাইছে। তবে ভবিষ্যতে আর কোনো ফ্যাসিস্ট যাতে ক্ষমতায় আসতে না পারে, সে জন্য নতুন একটি গণপরিষদ ও নতুন সংবিধান রচনার মাধ্যমেই এটা

নিশ্চিত করা সম্ভব। তিনি মনে করেন, সেটাই অন্তর্বর্তী সরকারকে করতে হবে। এটা না করে নির্বাচন দেওয়া হলে নির্বাচিত সরকার আদৌ কিছু করবে কি না, সেই অনিশ্চয়তা আছে।

একই সঙ্গে জাতীয় সংসদ নির্বাচনের আগে স্থানীয় সরকার নির্বাচনেরও দাবি জানান বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের মুখ্য সমন্বয়ক। তিনি মনে করেন, বিএনপি চাইছে ক্ষমতায় এসে নিজেদের অধীনে স্থানীয় সরকার নির্বাচন দেবে। এইভাবে স্থানীয় সরকারকে কুক্ষিগত করার চেষ্টায় আছে বিএনপি। তাই জাতীয় সংসদ নির্বাচনের আগেই স্থানীয় সরকার নির্বাচন দিতে হবে। স্থানীয় সরকারকে শক্তিশালী করেই জাতীয় নির্বাচন বা গণপরিষদ নির্বাচনের দিকে এগোনো যায়।

নির্বাচন প্রসঙ্গে জামায়াতে ইসলামী এবং অন্যান্য ইসলামি দল অনেকটা চুপচাপ। ধারণা করা যায় তারা সরকারের দেওয়া সময়সূচির সঙ্গে একমত। সংস্কার সম্পন্ন না করে কোনো তাড়াহুড়োর নির্বাচন তারা চায় না।

নির্বাচনের আগে অন্তর্বর্তী সরকারের আরেকটি অগ্রাধিকারের বিষয় হলো জুলাই গণহত্যার বিচার। অন্তর্বর্তী সরকার এবং বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের দিক থেকে বিচারিক আদালতে এই বিচারকাজ শেষ করার ওপরও নির্বাচনের সময় নির্ধারণ নির্ভর করে। এ ছাড়া বিভিন্ন সংস্কার কমিশনের প্রতিবেদন নিয়ে রাজনৈতিক দলসমূহের সঙ্গে আলোচনা এবং জাতীয় ঐকমত্য সৃষ্টির বিষয়টি তো রয়েছেই। সুতরাং নির্বাচনমুখী রাজনৈতিক দল, বিশেষ করে বিএনপি এবং অন্তর্বর্তী সরকার ও বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের লক্ষ্য অভিন্ন নয়। কাজেই টানাপোড়েন অব্যাহত থাকবে বলেই ধরে নেওয়া যায়।

লেখক: জ্যেষ্ঠ সাংবাদিক

‘ধর্মের কল বাতাসে নড়ে’

বার্ধক্য শুরু হয় পা দিয়ে

নির্বাচনবিষয়ক ভাবনা

টিউলিপ সিদ্দিকের পতন ঘটাতে বাংলাদেশি ও ব্রিটিশ রাজনীতির আঁতাত

নো ওয়ান কিলড তিন্নি!

শিক্ষার কোনো বিকল্প নেই

ভ্যাট বৃদ্ধি ও জনজীবনে চাপ

সংবিধান সংস্কার

মানুষ কী চায়

ভুল ও ভোগান্তি

সেকশন