মাধ্যমিক পর্যায়ে গণিত, বিজ্ঞান ও পঠন বিষয়ে সিঙ্গাপুরের শিক্ষার্থীরা বিশ্বে সবচেয়ে পারদর্শী। প্রতিবেশী দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ার আরও চারটি দেশও এ ক্ষেত্রে সেরাদের তালিকায় আছে। কিন্তু ইউরোপের শিক্ষার্থীদের পারদর্শিতা অনেকটাই নেমে গেছে। প্যারিসভিত্তিক সংস্থা অর্গানাইজেশন ফর ইকোনমিক অ্যান্ড ডেভেলপমেন্ট (ওইসিডি) পরিচালিত পিআইএসএ জরিপে এসব তথ্য উঠে এসেছে।
এশিয়া কিছু বিষয়ে ভালো করলেও বিশ্বজুড়ে শিক্ষার্থীদের সার্বিক পারদর্শিতায় ‘নজিরবিহীন অবনতি’ দেখছেন ওইসিডির শিক্ষা বিশ্লেষক ইরেন হু। গতকাল মঙ্গলবার প্রকাশিত জরিপে এই অবনতির পেছনে করোনা মহামারি অন্যতম কারণ হলেও অন্য কারণকেও দায়ী করা হয়।
বার্তা সংস্থা এএফপির খবরে বলা হয়েছে, ১৫ বছর বয়সী শিক্ষার্থীরা বাস্তব সমস্যা সমাধানে কতটুকু পারদর্শী, সেটাই যাচাই করা হয় ওইসিডির জরিপে। ২০২২ সালে ৮১টি দেশে ৬ লাখ ৯০ হাজার শিক্ষার্থীর ওপর জরিপ চালিয়ে দেখা গেছে, শিক্ষার্থীদের মানের দিক থেকে সবার শীর্ষে সিঙ্গাপুর। গণিত, বিজ্ঞান ও পঠন—জরিপের তিনটি বিষয়েই সর্বোচ্চ নম্বর পেয়েছে দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ার দেশটির শিক্ষার্থীরা।
সিঙ্গাপুরের শিক্ষার্থীরা তাদের চেয়ে তিন থেকে পাঁচ বছরের বড় শিক্ষার্থীদের সমান পারদর্শী বলেও জানা হয়েছে এই প্রতিবেদনে। এশিয়ার আরও পাঁচটি দেশের শিক্ষাব্যবস্থাও ভালো নম্বর পেয়েছে এই মূল্যায়ন জরিপে। গণিতে সিঙ্গাপুরের পরের অবস্থানেই আছে ম্যাকাউ, তাইওয়ান, হংকং, জাপান ও দক্ষিণ কোরিয়া। বিজ্ঞান ও পঠনে শীর্ষ নম্বরের কাছাকাছি পেয়েছে এই পাঁচ দেশ।
এশিয়া ভালো করলেও সার্বিক পারফরম্যান্সকে ‘নজিরবিহীন অবনতি’ হিসেবে দেখছে ওইসিডি। গণিতে জার্মানি, আইসল্যান্ড, নেদারল্যান্ডস, নরওয়ে ও পোল্যান্ড আশানুরূপ ভালো করতে পারেনি।
করোনা মহামারির কারণে শিক্ষার মানে নেতিবাচক প্রভাব পড়েছে, এটা সত্যি। তবে শিক্ষার মানের অবনতির পেছনে করোনা ছাড়াও রয়েছে অন্য কিছু কারণ। ফিনল্যান্ড, আইসল্যান্ড ও সুইডেনের পারফরম্যান্স আগে ছিল শীর্ষে। কিন্তু কয়েক বছর ধরেই তাদের পারফরম্যান্সে অবনতি দেখা যাচ্ছে।
ওইসিডির প্রতিবেদনে বলা হয়, শিক্ষার্থীদের কর্মক্ষমতা কমে যাওয়ার জন্য শিক্ষাব্যবস্থায় দীর্ঘমেয়াদি সমস্যাগুলো দায়ী। শিক্ষক ও বিদ্যালয়ের কর্মচারীদের কাছ থেকে পাওয়া সহায়তার মানকে এ ব্যাপারে গুরুত্বপূর্ণ কারণ বলছেন শিক্ষাবিষয়ক বিশ্লেষক ইরেন হু।
ওইসিডির শিক্ষাবিষয়ক আরেকজন বিশ্লেষক এরিক চারবোনিয়ার বলেছেন, ‘কিছু শিক্ষাব্যবস্থা শিক্ষার্থীদের সহায়তার জন্য পর্যাপ্ত সংস্থান রাখেনি। কিছু দেশ গত ১০ বছরে শিক্ষায় বিনিয়োগ করেছে। কিন্তু সম্ভবত তারা সেটা দক্ষতার সঙ্গে করেনি। ২০১৮ সালের তুলনায় শিশুদের অগ্রগতির সঙ্গে অভিভাবকদের সম্পৃক্ততাও কম দেখছি আমরা।’
ব্যয়ের সঙ্গে শিক্ষার মানের সম্পর্ক থাকলেও প্রতিবেদনটিতে বলা হয়েছে, যে দেশগুলো প্রথম শ্রেণির শিক্ষাব্যবস্থা গড়ে তুলতে দৃঢ়প্রতিজ্ঞ, তারা প্রতিকূল অর্থনৈতিক পরিস্থিতিতেও তা অর্জন করতে পারে। উদাহরণস্বরূপ বলা যায়, গণিতে ডেনমার্ক, ফ্রান্স, গ্রিস, পর্তুগাল ও সুইডেনের ১৫ বছর বয়সীরা ২০২২ সালে যে স্কোর করেছে, তা ২০১৮ সালে ১৪ বছর বয়সীরা করত।
ইউরোপের সেরা পারফরম্যান্স দেখিয়েছে এস্তোনিয়া। ইইউয়ের দুই বৃহত্তম দেশ জার্মানি ও ফ্রান্স রয়েছে সুইজারল্যান্ড, আয়ারল্যান্ড, বেলজিয়াম ও যুক্তরাজ্যের নিচে। এরিক চারবোনিয়ারের কাছে জার্মানির অবস্থা ফ্রান্সের চেয়েও শোচনীয়।
যুক্তরাষ্ট্রের শিক্ষাব্যবস্থায় গতবারের জরিপের তুলনায় এবার তেমন কোনো পরিবর্তন দেখা যায়নি। সেখানকার শিক্ষার্থীরা গণিতে দুর্বল এবং বিজ্ঞান ও পঠনে গড়পড়তার চেয়ে কিছুটা ভালো।
প্রথমবারের মতো ওইসিডি দেখতে চেয়েছে যে শিক্ষার্থীরা ভালো আছে কি না। সে জন্য ৯টি বিষয়কে প্রাধান্য দেওয়া হয়েছে; যেগুলোর মধ্যে বিদ্যালয় ও শিক্ষা-সম্পর্কিত অন্য বিষয়ের সঙ্গে সংশ্লিষ্টতা, সাংস্কৃতিক আবহ, বৈচিত্র্যের প্রতি কতটা খোলামেলা তারা এবং মানসিক সুস্থতাও রয়েছে।
এখানে দেখা গেছে, গণিতে ভালো করা সিঙ্গাপুর, ম্যাকাউ ও তাইওয়ানের শিক্ষার্থীরা ব্যর্থতাকে ভয় পায়। খেলাধুলার মতো পাঠ্যক্রম-বহির্ভূত কার্যক্রমেও তারা খুব বেশি জড়িত নয়।
উল্টো চিত্রও দেখা গেছে স্পেন, পেরুর মতো যেসব দেশ এই জরিপে খুব বেশি ভালো করতে পারেনি, সেসব দেশের শিক্ষার্থীরা খেলাধুলায় অনেক বেশি মনোযোগী। আর তাদের দুশ্চিন্তাও কম।